ভাবের জগতে বড়ই ভালো লাগে, অভাবের জগত ভালো লাগে না ।
****
সকাল থেকেই মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। আকাশের কোথাও খুলে গেছে একরাশ ঝর্নাধারা। চারপাশটা কেমন অন্ধকার হয়ে এসেছে। সবুজ ঘাসগুলো বহুদিন পর পানি পেয়ে ঝলমল করে হেসে উঠেছে।
মজিদের আজ অনেক বিপদ। ঘরে চাল ডাল সব শেষ। এমন দিনে রাস্তায় মাটি কাটা বন্ধ থাকে। হাতে এক টাকাও নেই। রশিদ ঠিকাদারের কাছে ধার চাওয়া যায়। ঠিকাদার দিলখোলা মানুষ। তবে তাকে একা পাওয়াই মুশকিল। সবার সামনে টাকা চাইতে খুব লজ্জা লাগে মজিদের। লজ্জা বড়লোকের জিনিস। গরিব মানুষের লজ্জা মানায় না, অথচ মজিদের লজ্জা একটু বেশি। দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে ঠিকাদারের খুজে বেরিয়ে পড়ল মজিদ।
-----
রশিদ ঠিকাদার রাস্তার পাশের চায়ের দোকানে একটা চেয়ারে বসে খোশ-গল্প করে। 'মেলা দিন আগের গপ' বলে সে আশ্চর্যসব কথা বলতে শুরু করে। এই সব গল্প শুনে অষ্টধার গ্রামের বৃদ্ধরা পর্যন্ত হা করে থাকে আর বলে 'তাইজ্জব ব্যাপার !'
আজকেও সেখানে পাওয়া গেল তাকে। আড্ডা বেশ জমে উঠেছে । রাস্তায় মটরসাইকেলের ভনভন আওয়াজ শোনা যায়।
-হুন্ডাত অইডা কেডা ?
-আনন্দর নাতি, সুরুইজ্জার পুলা।
-পিছে মাইয়া কেডা।
-বউ।
-বেয়া করলো কবে ?
- বিষুদ বাইরে ঈদ অইছে না, শুক্কুরবারে বিয়া অইছে।
-অ আইচ্ছা।
-অহন আর এদিক লুকজন ঘুরবার আয়ে না ?
-আয়ে আয়ে ।
-তয় চইত্রি মাসে বেশি আয়ে।
- না না , বেশি আইয়ে শীত মরসুমে।
-অহন ঘুরুনের জাইগা মেলা ।
-বাঘের বাজার বানাইছে কি একটা। বড় চিড়িয়াখানা।
-ভালা নি।
- হ ভালা, দুইটা সাপযে আছে, জটলা দিয়া বইয়া আছে।
-জেতা ?
-হ , জেতা মানে ? পালতাসে।
-কসকি? বনমানুষ নাই ?
-আছে না মাইনে ?
-পাও কি উল্টা দিহে ?
-হ।
-ল্যাংটা ?
-কাফর পাইবো কই ?
-একবার দেহন লাগত।
-হুম। লুকমাইনে কি অহন আটতারে ?
-না, অহনও না।
-ডাকতর দেহায় নাই।
-না হে নিজেই এক্সরা করছে।
-বেক্কল একডা।
-হ।
-আমিযে এক্সরা করছিলাম, মগবাজারের এক ডাকতর করতে কইছিলো। আআটশো ট্যাহা ভিজিড। বিরাইট ডাকতর , এক্সরা দেইখাই কইছে কুন পবলেম নাই। নাচতে নাচতে বাইত জান।
ঝিম মেরে অনেকক্ষন গল্প শুনল মজিদ। অনেকবার টাকা ধারের বিষয়টা বলতে চেয়েও বলতে পারল না। লজ্জা বড় শক্ত জিনিস। জুম্মা ঘরের ঈমাম সাহেব গেল জুম্মা বারে লজ্জার উপর কি আলোচনাটাই না রাখলেন।
''ভাই সব, মুসলিম শরীফের কিতাবে লেখা আছে, লজ্জার মইধ্যে খালি মঙ্গল আর মঙ্গলই আছে।
কি বুঝলেন ?
ভাল ভাবে বুইজা লন, লজ্জার মইধ্যে যা আছে তা শুধু ভাল আর ভাল। সাহাবারা ছিলেন লজ্জাশীল। এর মধ্যে উসমান (রাঃ) ছিলেন একটু বেশি লাজুক। তার মর্যাদাও ছিল বেশি। আর এখন, মানুষের লজ্জা শরম নাই, মসজিদের পেশাবখানায় দাড়ায়া দাড়ায়া পেশাব করে। জিগাইলে কয়, জিন্সের প্যান্টতো হুজুর। বওন যায় না।
তো বেটা, যেই প্যান্টে বসুনই যাইনা, ওইডা পড়স ক্যা। এমন প্যান্ট পড়ে, নামাজে সামনে থাকলে সিজদার সময় পিছনে যারা বসে তাগো সামনে বেবাক সতর দেখা যায়। আর মা-বোনগো বেলাজের কথা নাই কইলাম।
দিলের মইদ্যে ভাল করে মিশায়া লন, কিয়ামতের আলামত হইতেছে, দুনিয়া থেকে লজ্জা শরম উইঠা যাইব। এখন উইঠা যাইতাসে কিনা ?''
ভাবের জগৎ থেকে ফিরে আসে মজিদ। আজ আর উপায় নেই। পরিবার নিয়ে না খেয়ে থাকতে হবে। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে বাড়ী ফেরে মজিদ। হাত খালি দেখেই আয়েশা বুঝতে পারে আজ উপোস দিতে হবে। গামছাটা দিয়ে মজিদের মাথাটা মুছে দেয় সে। কেমন একটা অপরাধী মুখ করে আছে মজিদ। 'লুকটার লইজ্জা বেশি' ভাবে আয়েশা। একটা অব্যক্ত মায়া লাগে লোকটার উপর। হাত ধরে অনেক কথাই বলতে ইচ্ছে করে আয়েশার। এর নামই কি ভালবাসা ?
দরজায় ঠকঠক আওয়াজ হয়। মজিদ দরজা খুলে দেয়। বাইরে রশিদ ঠিকাদার, হাতে একটা বাজারের ব্যাগ। ব্যাগের এক কোনা দিয়ে উঁকি দিচ্ছে একটা বড় লাউ।
'বৃষ্টির মইদ্যে লাউ দিয়া লাডি মাছের ছালুন খাইতে মন চাইলো , হেল্লিগা মাছ চাইল সব লয়া আইলাম। ভাবীরে কউ ঝাল কইরা রানতে' -হাসতে হাসতে বলে ঠিকাদার।
মজিদের কানে কোন কথা ঢুকে না। কেবল ঈমাম সাহেবের কথাটা কানে বাজে , 'লজ্জার মইধ্যে খালি মঙ্গল আর মঙ্গলই আছে। মুসলিম শরীফের কিতাবে লেখা আছে।'
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে জুলাই, ২০১৬ বিকাল ৩:১৩