রেললাইন ঘেসে মেঠো রাস্তা। মেঠো রাস্তার পাশেই বড় বিল। সবাই বলে কেউড়ার বিল। বিলের পাশ ঘেষেই বুনো ঝোপঝাড়। দিনের বেলাই কেমন অন্ধকার। বেশ স্যাতস্যাতে হয়ে আছে। শুকনো মৌসুমে অবশ্য বিলের জমিতে ধান লাগানো হয়। চারপাশ হলুদ ধানের সারিতে ভরে যায়। বর্ষায় নদীর পানি খাল দিয়ে ঢোকে। শাপলা ফুল ফুটে থাকে অগভীর পানিতে। পাটের কাঠিতে ছোট ছোট সুতায় লাগানো বরশি পেতে রাখে কেউ কেউ । ভাগ্য ভাল হলে প্রায়ই টেংরা, পুটি ধরা পড়ে। সকালে আমিও সবার সাথে তিনটা বঁরশি পেতে রেখেছি। দেখি কি হয় ? রোদের আচে বিলের উপরের পানি বেশ গরম হয়ে ওঠেছে। তবে নিচের পানি ঠান্ডা। ডুব দিলে ভাল লাগে। আর উঠতে ইচ্ছে করে না। আমরা কয়েকজন মিলে একটা ভেলা বানানোর প্ল্যান করেছি। শরিফ ভাই আমাদের লিডার। বিলের পাশের বিশাল ভিটাজমির দক্ষিনের ঝোপঝাড়ে কিছু কলা গাছ আছে। চুপিচুপি বাড়ি থেকে দুটি দাঁ নিয়ে এল নিমাই। কয়েকটা কলা গাছ সন্তপর্নে কেটে ফেলা হল। একটা গাছে এক কাদি কাচা কলা ছিল। লবন দিয়ে মেখে হামিদ আর শাহীন কাচাকলা খাওয়া শুরু করলো। ওরা দুজন বেশ ছোট। ছোটখাট কাজে সাহায্যের জন্য ওদেরকে দলে নেয়া হয়েছে। গড়িয়ে গড়িয়ে কলা গাছগুলো বিলের পাড়ে আনা হয়েছে। এরপর বাশের ফালি দিয়ে কান্ডগুলো জোড়া দেয়া হচ্ছে। পুরো গ্রুপের একমাত্র অকর্মন্য ব্যাক্তি আমি। পাশেই কড়ই গাছের ছায়ায় একটা কলাপাতার উপর বসে বসে সবার কর্মকান্ড গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখছি। এতে অবশ্য কেউ তেমন কিছু মনে করছে না, কারন ভেলা বানানোর আইডিয়াটা আমিই দিয়েছি। অল্প কিছুক্ষনের মধ্যে ভেলা তৈরী হয়ে গেল। হৈ হৈ করতে করতে আমরা সবাই ভেলায় উঠে পড়লাম। শরীফ ভাইয়ের হাতে একটা বড় বাশের লগি। আমাদের কয়েকজনের হাতে বৈঠা। আমাদের ভেলা দ্রুত চলতে লাগল বিলের গভীরে। আগে কখনো ওপাশে যাওয়া হয়নি আমার। সেখানে বিলের পানি একটু গভীর। বড় বড় মাছ আর শাপলা-শালুকও বেশি ওখানে। লাফালাফি করতে করতে কখন যে বেলা গড়িয়ে গেল টেরই পেলাম না। সবাই যখন উঠতে যাব, তখন দেখা গেল হামিদকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না।
***
পড়ন্ত বিকেলে কেউড়ার বিলের পাশে অসংখ্য মানুষ ভীড় করেছে। এত লোকের জমায়েত হাটবার ছাড়া সাধারনত দেখা যায় না। জমায়েতের একেবারে মাঝখানে কবীর মুনশী বিষন্ন হয়ে দাড়িয়ে আছে। সে এই গ্রামের একমাত্র এলএমএএফ পাশ করা ডাক্তার। লোকে বলে কবীর মুনশীর হাতজশ ভালো। তার সাথে লড়াই করে আজরাইলকে অনেকবার খালি হাতে ফেরত যেতে হয়েছে। আজ এ বিপদের দিনে তাই সবার আগে তার ডাক পড়ে। হামিদের নিথর দেহটা দুই হাতে ধরে আছে সে। আশায় বুকবেধে থাকা হামিদের মা তার চোখের দিকে তাকিয়ে কিছু আঁচ করার চেষ্টা করে। আস্তে আস্তে বিকেল শেষ হয়ে নেমে আসছে নিশুতি। মাটি থেকে চোখ না সরিয়ে বড় করে শ্বাস নিয়ে কবীর মুনশী বলে উঠে . . ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন . .
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জুন, ২০১৫ বিকাল ৪:১৬