ফরিদ সাহেবের চা খেতে খুব ইচ্ছে করছে।
কড়া লিকারের মধ্যে দুধ আর চিনি দিয়ে এক
কাপ চা। অনেক দিন হলো খায় না। মাস
খানেক তো হবেই। কিন্তু আজকের এই
ঠাণ্ডা আবহাওয়াতে এক কাপ ধোয়া উঠা গরম
গরম দুধ চায়ের সাথে দুইটা গরম গরম
সিঙ্গারা খেতে খুব ইচ্ছে করছে। তাই
তিনি শার্টের পকেট হাতড়াচ্ছেন। বিশ
পনেরো টাকা হলেই খাওয়া যাবে। বিশ
টাকা তার পকেটে অবশ্যই থাকবে। গত পড়শু
বাজার করে তিনি বিশ টাকার হিসেব
বেশি দেখিয়েছেন স্ত্রীকে। সেই বিশ
টাকা সযতনে পুরাতন শার্টের
পকেটে লুকিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু এখন
খুঁজে পাচ্ছেন না। বিশ
টাকা না পাওয়াটা এখন বিশ হাজার
টাকা না পাওয়ার মত কষ্ট দিচ্ছে ফরিদ
সাহেবকে। কাচুমাচু ভঙ্গিতে তিনি স্ত্রীর
সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন।
- তুমি কি আমার পুরান শার্টটা গতকাল
ধুয়েছিলে?
- না। কেন? কি হয়েছে সেই শার্টের?
ঐটাতে কি সাত রাজার ধন ছিলো?
- ও। আচ্ছা। পরিষ্কার পরিষ্কার
দেখাচ্ছে তো, তাই জিজ্ঞেস করলাম।
ফরিদ সাহেব সেই সাত রাজার ধনের গুদাম
গায়ে চড়িয়েই বেড়িয়েছেন। অসহায়ের মত
হাঁটতে হাঁটতে মোড়ের হোটেলটার
দিকে যাচ্ছেন। তিনি জানেন টাকাটা তার
স্ত্রী মিনুই পকেট থেকে সরিয়েছে। হঠাৎ
কোন কিছু খেতে ইচ্ছে করলে ঘরে বললে মিনু
তৈরি করে দেয় না। বরং কিছু
বাঁকা কথা শুনিয়ে দেয়।
মেয়েকে গিয়ে বললে সেও তার মায়ের মতই
করে। তার মাঝে মাঝে আফসোস হয়
মেয়েটা কেন তার মত হলো না!
তাহলে তো মেয়ের কাছে গিয়েই আবদার
করতে পারতেন। কিন্তু তাও তো পারেন না।
তাই তিনি মাঝে মাঝে বাজার
করতে গেলে দশ বিশ টাকা মেরে দেন। সেই
টাকাও আবার মাঝে মাঝে কাপড় ধোয়ার
সময় স্ত্রীর হাতে চলে যায়। তারপর তাকেও
ধোয়া হয়, কাপড় ধোয়ার মত করেই। তবে আজ
বেশি কিছু বলে নাই এটাই কপাল ভালো।
মোড়ের হোটেলের মালিকটা বড্ড ভালো।
গরীব মানুষ। টিনের তৈরি ঘরে বাপ
ছেলে মিলে হোটেল খুলে বসেছে।
তারা কখনো ফরিদ
সাহেবকে বাকি খেতে দিতে কুণ্ঠাবোধ
করে না। কারণ
তারা জানে তিনি টাকা মেরে দেয়ার মত
লোক না। অথচ তারা কি আর জানে তাদের
হোটেলে শখের বসে খাওয়ার জন্য নিজের
ঘরের, নিজের টাকাই মেরে দিতে হয়।
কি সুন্দর গরম গরম সিঙ্গারা! চায়ের
সাথে খেতে কি স্বাদই না লাগছে! যখন ফরিদ
সাহেবের চাকরি ছিলো, তখন
প্রতি সন্ধ্যাতেই তার পছন্দের
নাশতা তৈরি করে দিত মিনু। খাওয়ার
ব্যাপারে ফরিদ সাহেব বরাবরই শৌখিন। তার
নতুন নতুন রান্না খেতে ভালো লাগে। মিনু
বেগমেরও রান্নার হাত ভালো। তাই
রিটায়ার্ড হওয়ার আগে তার
ভোজনবিলাসটাও ভালই চলতো।
ভালো ভালো রান্না খেয়ে তার এই
বিলাসিতা অনেক বেড়ে গিয়েছে।
তবে অতিথি আসলে মিনুর রান্নার হাত
খারাপ হয়ে যায়। এই অতিথি বলতে শুধু ফরিদ
সাহেবের বোনের বাড়ির লোকজন। তার বোন
ভাগ্নিদের আসাটা পছন্দ করেনা মিনু।
তারা আসলে তার মুখে রিংকেলস
দেখা দিতো। সেই যুবতী বয়সেও তখন
তাকে দেখতে বুড়ি বুড়ি লাগতো। তবুও
তিনবেলা তাদের খেতে দিত সেটাই ফরিদ
সাহেবের ভাগ্য।
বাবা মা মারা গিয়ছে বোনের বিয়ের
পরেই। এখন তিনকুলে তার কেবল এই একটি বড়
বোনই আছে। আর তার দুই ছেলেমেয়ে। কিন্তু
ওদের দেখলে মিনুর বুড়িয়ে যাওয়া ফরিদ
সাহেবের একদম ভালো লাগতো না। তাই
তিনি চাইতেন বোন ভাগ্নিরা যেন ঐ
বুড়িয়ে যাওয়া চেহারা না দেখে।
মনে মনে প্রার্থনা করতেন তারা যেন আর
না আসে। তারপর ধীরে ধীরে ফরিদ
সাহেবের সেই ইচ্ছাটা পূরণ হয়ে যায়। এখন আর
তারা কেউ আসে না। প্রায় বছর দশ হবে।
খাওয়া শেষে হোটেল থেকে বের হওয়ার সময়
বলে আসলো টাকাটা পরে দিবে।
এটা বলতে এখন আর খারাপ লাগে না। প্রথম
প্রথম কথাটা মুখ দিয়ে আসতে চাইতো না।
কেমন যেন জিহ্বাটায় জড়তা কাজ করতো।
আটকে যেতে চাইতো কথাটা। তবে গত দুই
বছরে এটা অভ্যেস হয়ে গেছে লোকটির।
আজকে বোন ভাগ্নিদের কথা কেন জানি খুব
মনে পড়ছে ফরিদ সাহেবের। তাই
ভেবেছে বাসায় গিয়েই টেলিফোন করবে।
আসতে বলবে তাদের। এতদিন
পরে দেখলে মিনু নিশ্চয় কোন
হাঙ্গামা বাঁধাবে না। হয়তো তাকে দু
একটা কথা শোনাবে। কিন্তু অতিথিদের
সাথে নিশ্চয় খারাপ ব্যবহার করবে না।
ওরা তিনজন এসেছিলো। কিন্তু সময়ের
সাথে মিনু বেগমের চেহারার রিংকেলস
আরো বেশি পরিমাণে বেড়ে গিয়েছে।
তাই দুই দিন পরে ফরিদ সাহেব নিজেই
এসেছেন বাস স্ট্যান্ডে তাদেরকে টিকিট
করে দিতে। আজকে টিকিটের
টাকাটা তিনিই দিবেন। গতকাল
বাড়ি ভাড়ার টাকা দিয়ে গেছে সবাই
মিনুর কাছে। সেই কর্ত্রী কিনা! মিনু
প্রতিমাসে আলাদা করে টাকা জমা রেখে
দেয়
নিজের আলমারিতে। সেই
আলাদা করে রাখা টাকা থেকেই ফরিদ
সাহেব এক হাজার
টাকা লুকিয়ে নিয়ে এসেছেন।
গাড়ি ছেড়ে দিয়েছে। তিনি পেছন
ঘুরে হাঁটতে শুরু করেছেন। চোখের
দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে আসছে। চশমার
কাঁচে কেমন যেন বৃষ্টির ফোঁটার মত
পড়ছে মনে হচ্ছে। বড়ই অদ্ভুত পৃথিবী। এখন
চাকুরীজীবী নামক পদবীটা নেই
বলে তাকে নিজের বাড়ির টাকা থেকেও
চুরি করতে হয়। নিজের ঘরেও
আসামী হয়ে থাকতে হয়।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জুলাই, ২০১৪ বিকাল ৩:১২