ডিভোর্স, একটি মেয়ে ও সমাজ (পর্ব -১)
ডিভোর্স শব্দটি ইংরেজি শব্দ। এর বাংলা অর্থ তালাক। তথাপি শুহুরে সমাজ থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রামীণ এলাকাতেও আমরা তালাক শব্দটির পরিবর্তে ডিভোর্স শব্দটিই শুনতে পাই বেশি। তালাক শব্দের অর্থ ছেড়ে দেওয়া বা মুক্ত হওয়া। বিবাহ বিচ্ছেদের সমাজ স্বীকৃত আইনি প্রক্রিয়াই হচ্ছে তালাক।
আমাদের দেশে পূর্বে ডিভোর্সের ক্ষেত্রে পুরুষদের একতরফা ক্ষমতা ছিল। আর নারীদের ক্ষমতা ছিল খুবই সীমিত। তবে মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদ আইন ১৯৩৯ ও মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ ১৯৬১ ডিভোর্সের ক্ষেত্রে নারীদের ক্ষমতা ও দেনমোহর প্রাপ্তির বিষয়টি শক্ত করে। ১৯৩৯ সালের মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদ ৮নং আইনের ধারা (২) অনুযায়ী নারীরা যেসব ক্ষেত্রে ডিভোর্স প্রদানের ক্ষমতা রাখে সেগুলো হল :
১) মুসলিম আইন মোতাবেক কোন বিবাহিতা নারী নিম্নলিখিত এক বা একাধিক কারণে তার বিবাহবিচ্ছেদের ডিক্রি পাওয়ার অধিকারিণী হবে। যথা:
ক. চার বছর কাল পর্যন্ত স্বামী নিখোঁজ থাকলে;
খ. দুই বছর কাল পর্যন্ত স্বামী তার ভরণপোষণে অবহেলা করলে বা ব্যর্থ হলে;
২) (ক) ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশের বিধান লঙ্ঘন করে স্বামী অতিরিক্ত স্ত্রী গ্রহণ করলে ।
৩) সাত বছর বা ততোধিক সময় স্বামী কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলে ।
৪) যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়া স্বামী তিন বছরকাল যাবৎ তার বৈবাহিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে।
৫) বিবাহের সময় স্বামী পুরুষত্বহীন থাকলে এবং তার ঐরূপ অবস্থা বর্তমানে বিরাজ করলে।
৬) দুই বছর পর্যন্ত স্বামী অপ্রকৃতিস্থ হলে বা কুষ্ঠরোগ অথবা মারাত্মক যৌন রোগে আক্রান্ত থাকলে।
৭) বয়স ষোল বছর পূর্ণ হওয়ার আগে তাকে তার বাবা অথবা অন্য কোন অভিবাবক কর্তৃক বিবাহ দেওয়া হলেও বয়স আঠার বছর পূর্ণ হওয়ার আগে স্ত্রী উক্ত বিবাহ মেনে না নিলে। তবে বিবাহে যৌন মিলন হলে তালাক কার্যকর হবে না।
৮) স্বামীর কর্তৃক শারিরীক নির্যাতন বা নিঃষ্ঠুর আচরণের শিকার হলে।
৯) মুসলিম আইন অনুযায়ী বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে কারাদণ্ডাদেশ চূড়ান্ত না হলে সে দাম্পত্য দায়িত্ব পালনে প্রস্তুত আছে মর্মে ৬ মাসের মধ্যে স্বামী আদালতে সন্তোষজনক জবাবদিহি এবং এক বছরের মধ্যে পরুষত্বহীনতা সমস্যা নেই বলে প্রমাণ করতে পারলে স্ত্রী বিবাহবিচ্ছেদের ডিক্রি পাবে না।
আবার ৮নং উপধারায় উল্লিখিত আদালত কর্তৃক স্বীকৃত স্বামীর নিঃষ্ঠুর ব্যবহারসমূহ নিম্নরূপ :
ক) অভ্যাসগতভাবে আঘাত করলে বা নিঃষ্ঠুর আচরণ করলে, উক্ত আচরণ দৈহিক পীড়নের পর্যায়ে না পড়লেও তার জীবন শোচনীয় করে তুলেছে এমন হলে;
খ) স্বামী খারাপ মেয়ের সাথে জীবনযাপন করলে; গ) স্ত্রীকে অনৈতিক জীবনযাপনে বাধ্য করলে;
ঘ) স্ত্রীর সম্পত্তি নষ্ট করলে;
ঙ) স্ত্রীকে ধর্মপালনে বাধা দিলে;
চ) একাধিক স্ত্রী থাকলে পবিত্র কুরআন অনুযায়ী সকলের সাথে সমান ব্যবহার না করলে;
ছ) এছাড়া অন্য যে কোন কারণে (যে সকল কারণে মুসলিম আইনে বিয়ের চুক্তি ভঙ্গ করা যায়) ।
দেনমোহর প্রাপ্তির বিষয়টি ১৯৩৯ সালের মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদ ৮নং আইনের ৫নং ধারায় ও মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ ১৯৬১ এর ১০ নং ধারায় পাকাপোক্ত করা হয়েছে।
১৯৩৯ সালের মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদ ৮নং আইনের ৫নং ধারায় বলা হয়েছে, "মুসলিম আইন অনুসারে বিবাহিতা কোন মহিলার প্রাপ্ত দেনমোহর অথবা তার কোন অংশের অধিকার তার বিবাহবিচ্ছেদ জনিত কারণে হরণ করা যাবে না।"
১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ এর ১০নং ধারায় বলা হয়েছে, "দেনমোহরের অর্থ পরিশোধের পদ্ধতি বিবাহের চুক্তিতে সুস্পষ্ট উল্লেখ না থাকলে স্ত্রী চাহিবামাত্র সমগ্র অর্থ পরিশোধ করতে বাধ্য থাকবে।"
এতো গেল আইন কর্তৃক প্রদত্ত নারীদের তালাক দেয়ার ক্ষমতার কথা। কিন্তু পরবর্তিতে একজন ডিভোর্সড মেয়েকে আমাদের সমাজ কতটুকু মূল্যায়ন করে? কতটা ইতিবাচক চোখে দেখে তাকে? আমি বলছি না ডিভোর্স কোন ভাল কথা। শুধু বৈবাহিক সম্পর্কের বিচ্ছেদই নয়, যে কোন সম্পর্কের বিচ্ছেদই যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলা উচিৎ। ইসলামে ডিভোর্সকে নিকৃষ্টতম হালাল বলা হয়েছে। তথাপি একটি মেয়ে বাধ্য হয়ে যখন তার স্বামীকে তালাক দেয়, তখন বা পরবর্তিতে আমাদের সমাজ কি সেই মেয়েটিকে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে গ্রহণ করতে পারে?
এক্ষেত্রে আমি আমার দেখা অনেক কাহিনীর মধ্যে একটি কাহিনী বলি।
আয়মান নামের মেধাবী ছাত্রীটি এক মফস্বল এলাকায় থাকতো। একাদশ শ্রেণীতে পড়াকালীন তার বিয়ে হয় এক প্রবাসী পাত্রের সাথে। মেয়েটিকে প্রথমে তার পরিবার বিয়ে দিতে রাজি না থাকলেও পরবর্তিতে পাত্রপক্ষের অতি কদরে বিয়ে দেয়। তবে কথাবার্তা পাকাপোক্ত করার সময় বলে নেয়, মেয়ে যতদূর পড়তে চায় ততদূর পড়ার স্বাধীনতা দিতে হব। তারা পাত্রীপক্ষের সকল আবদার মেনে নিয়ে মেয়েটিকে বৌ করে নিয়ে যায়। বিয়ের প্রথম সাত আট মাস মোটামুটি ভাল চললো। কিন্তু এইচএসসি পরীক্ষার মাস দু'এক আগে থেকে একটু একটু করে ঝামেলা শুরু হল। পড়ালেখার ইস্যু ও তার চেয়েও বড় এক ইস্যু জমির মালিকানা নিয়ে ঝামেলা দলা পাকাতে শুরু করল। মেয়েটির এইচএসসি পরীক্ষার মাস তিনেক আগে মেয়ের বাবা ও তার স্বামী অর্ধেক অর্ধেক টাকা দিয়ে এক মফস্বল এলাকায় জমি কিনে। মেয়ের বাবা তার মেয়ের নামে অর্ধেক জমির মালিকানা চায়, যেহেতু সে অর্ধেক টাকা দিয়েছে। প্রথমে ছেলে ও ছেলের বাড়ির সবাই এই কথায় রাজি না থাকলেও পরবর্তিতে অর্ধেক মালিকানা দিতে রাজি হয়। এরপর থেকেই মেয়েটি প্রতিনিয়ত মানসিক নিপীড়নের শিকার হতে থাকে। পরীক্ষা চলাকালীন সময়েও প্রবাস থেকে ফোন করে মেয়েটিকে কথা শোনানো হত। বিনা কারণে মেয়েটিকে সন্দেহ করা, প্রতিনিয়ত মেয়েটির সাথে ঝগড়া করা, নামেমাত্র টাকা-পয়সা দেয়া হয়। ফলাফলে একসময়কার মেধাবী ছাত্রী কোনরকম টেনেটুনে এইচএসসি পাশ করলো। মেয়েটি ভাবে স্বামী দেশে আসলে হয়তো কিছুটা হলেও পরিবর্তন হবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেলো তার উল্টো। স্বামী দেশে আসার পর শ্বশুড় বাড়িতে গেলে প্রতিনিয়ত ভাসুর জায়ারা পর্যন্ত কথা শোনাত। পরবর্তিতে অনার্সে ভর্তি হওয়ার জন্য যখন মেয়েটি টাকা চাইলো, তাকে তার স্বামী ঘর থেকে টেনে বের করে দিতে চাইলো।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে মে, ২০১৪ সকাল ৯:২০