ব্লগে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনার জোয়ার ওঠে ....ড. ইউনুস, শাহরুখ, এয়ারটেল বর্তমানে সাহারা খাতুন .... ইত্যাদি ইত্যাদি।
ব্লগ বিভিন্ন সময় প্রায় সারাদিন পড়ি সেই সাথে গুরুত্বপূর্ণ খবরগুলোও পাওয়া হয়ে যায় ব্লগের মাধ্যমেই। তবে.. নিচের লেখাটা না পড়ে থাকলে মিস করবেন।
এটা প্রথম আলোতে প্রকাশিত একটি লেখা যেটা ভবিষ্যতেও সংরক্ষণের জন্যও আমার ব্লগে প্রকাশ করা।
===========================================
আমরা কীভাবে আমাদের মান-মর্যাদা রক্ষা করব
===========================================
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হওয়ার কিছুদিন পরই তৎকালীন অর্থমন্ত্রী এস এ এম এস কিবরিয়া আমাকে গ্রামীণ ব্যাংক বোর্ডের চেয়ারম্যান পদ গ্রহণের আমন্ত্রণ জানান। প্রতিষ্ঠানটিতে সরকারের শেয়ার পাঁচ শতাংশ। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার আগে আমার মেয়াদ শেষ হওয়া পর্যন্ত আমি সেই পদে অধিষ্ঠিত ছিলাম।
সেই সময়টা গ্রামীণ ব্যাংকের ইতিহাসে এক উৎপাদনশীল সময়। শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বব্যাপী তখন ক্ষুদ্রঋণের বিস্তৃতি ঘটে চলেছে। ১৯৯৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত বিশ্ব ক্ষুদ্রঋণ সম্মেলনে ক্ষুদ্রঋণ বিস্তারে বাংলাদেশের পথিকৃতের ভূমিকার স্বীকৃতিস্বরূপ আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানানো হয় যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন ফার্স্ট লেডি হিলারি ক্লিনটন ও স্পেনের রানি সোফিয়ার সঙ্গে সম্মেলনে কো-চেয়ার হওয়ার জন্য। ক্ষুদ্রঋণ-ব্যবস্থার অনুকূলে শেখ হাসিনা চমৎকার যুক্তি তুলে ধরে সম্মেলনটিতে জোরালো ছাপ রাখতে সক্ষম হন।
গ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে আমার সংশ্লিষ্টতার সময়ে সরকারের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির সম্পর্কের মধ্যে কোনো সমস্যা যে ছিল না, তা নয়। কিন্তু সামগ্রিকভাবে সম্পর্কটা ছিল ফলপ্রসূ ও ইতিবাচক। তাই গ্রামীণ ব্যাংক-সম্পর্কিত সাম্প্রতিক মিডিয়া-উন্মত্ততা আমাকে বিষাদগ্রস্ত করেছে।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত বেশির ভাগ মতামত দেখে মনে হয়েছে, খুব কম জনই নরওয়ের টেলিভিশনে প্রচারিত কট ইন মাইক্রোক্রেডিট প্রামাণ্যচিত্র দেখেছেন কিংবা গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যাখ্যাসংবলিত দীর্ঘ প্রতিক্রিয়াটি পড়েছেন। ফলে প্রকাশিত মতামতগুলোতে এমন ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যে ড. মুহাম্মদ ইউনূস গুরুতর অপকর্ম প্রশ্রয় দিয়েছিলেন।
মনে হচ্ছে, গণমাধ্যমের এক অংশ এই উন্মত্ততা উসকে দিচ্ছে। এমনকি এমন সংবাদও পরিবেশন করা হয়েছে যে ইউনূসের বিরুদ্ধে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং প্রশ্নসাপেক্ষ কর্মকাণ্ডের অভিযোগ করেছেন। এমন প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার ভারতীয় হাইকমিশন বাধ্য হয়েছে বলতে যে তাদের প্রধানমন্ত্রী এমন কোনো কথা বলেননি।
দরিদ্রদের সহায়তার জন্য গ্রামীণ ব্যাংককে দাতাদের দেওয়া তহবিল ‘স্থানান্তর’ করার মতো শব্দ ব্যবহার করতে দেখা যায় কিছু কিছু বৈরী সমালোচনায়। এসব কথা আমাদের গণমাধ্যমের সাধারণ পাঠকদের এমনও ভাবতে উৎসাহিত করেছে যে ইউনূস কোনো না কোনোভাবে দাতাদের তহবিল ব্যক্তিগত সুবিধার জন্য সরিয়ে নিয়েছেন।
গ্রামীণ ব্যাংক ও ক্ষুদ্রঋণ-ব্যবস্থা কাবুলিওয়ালাদের মতো, ‘যা গরিবের রক্ত চুষে খায়’—এই পুরোনো বিতর্ককেই পুনরুজ্জীবিত করেছে নরওয়ে টিভির অনুষ্ঠানটি। এ অভিযোগ তুলে ধরতে সেই অনুষ্ঠানে বলা হয়েছে ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে কিস্তি আদায়ের প্রক্রিয়ায় নিপীড়নের কথা; খেলাপি ঋণগ্রহীতাদের ঘরের টিন খুলে নেওয়ার কথাও জানানো হয়েছে।
গ্রামীণ ব্যাংকের বড় সমালোচনা মনে করিয়ে দেয় যে যদিও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপ অনুযায়ী ১৯৯৬ সালে দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থানরত পরিবারের হার ৫১ শতাংশ থেকে ২০০৫ সালে ৪০ শতাংশে নেমে এসেছে, তবু বাংলাদেশে দারিদ্র্যের স্তর এখনো সহনীয় মাত্রার চেয়ে অনেক ওপরে।
গ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে আমার সম্পৃক্ততা থাকা সত্ত্বেও আমি কোনো অন্ধ সমর্থক নই যে মনে করব, ক্ষুদ্রঋণ দারিদ্র্য বিমোচনের জাদুকরি দাওয়াই। যখন গ্রামীণ ব্যাংকের প্রশংসা করাই ফ্যাশন, তখনো আমি এর সমালোচনা করেছি। আমার সর্বশেষ বই চ্যালেঞ্জিং দ্য ইনজাস্টিস অব পোভার্টিতে আমি এ বিষয়ে আরও বিশদ আলোচনা করেছি।
ক্ষুদ্রঋণ-ব্যবস্থার আরও নানা যৌক্তিক সমালোচনা রয়েছে, তেমন সমালোচনা যাঁরা করেন, তাঁরা যে অসদুদ্দেশ্যেই তা করেন, এমন নয়। তবে বাংলাদেশে দারিদ্র্য ও ক্ষুদ্রঋণ-গ্রহীতার জীবনের ওপর ক্ষুদ্রঋণের প্রভাব নিয়ে আলোচনার পথ সুগম করার সময় বা জায়গা এটা নয়। সেই বিতর্ক চলা উচিত। কিন্তু তা হওয়া উচিত শালীন ও পেশাদারি বিতর্ক। স্বল্প সম্পদের অধিকারী লাখ লাখ মানুষের জীবিকা এর সঙ্গে জড়িত। এই আলোচনাকে যথাযথ ওয়াকিবহাল নয়, এমন কথামালায় গুরুত্বহীন করে তোলা হলে তা এসব অরক্ষিত মানুষের জীবনের মানোন্নয়নে বিশেষ কাজে আসবে না।
ক্ষুদ্র অর্থায়ন প্রতিষ্ঠানগুলোর (এমএফআই) কর্মকাণ্ড তদারকের জন্য বহু প্রত্যাশিত মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি (এমসিআরএ) গঠন করে বর্তমান সরকার একটি প্রশংসনীয় কাজ করেছে। এমএফআইগুলো মাত্রাতিরিক্ত কিংবা শোষণমূলক মাত্রায় সুদ নিচ্ছে কি না, তা দেখার ভার এমসিআরএর ওপর ন্যস্ত। সে হিসেবে এমসিআরএর জন্যও উচিত হবে ঋণের কিস্তি আদায়ের ক্ষেত্রে এমএফআই কর্তৃক অসহায় ঋণগ্রহীতার ওপর নিপীড়নের অভিযোগ তদন্ত করা।
অধিকন্তু, ঋণগ্রহীতার জীবনযাত্রার ওপর ক্ষুদ্রঋণের প্রভাব কী, তা নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ও পল্লীকর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) নিয়ন্ত্রণাধীন মাইক্রো-ফিন্যান্স রিসার্চ ইনস্টিটিউটটি বিআইডিএসের সহযোগিতায় হালনাগাদ গবেষণা চালিয়ে দেখতে পারে। গবেষণাটি হতে হবে নির্মোহ ও পেশাদারি। বঞ্চিত মানুষের জীবনে ক্ষুদ্রঋণের প্রভাবের আরও উৎকর্ষবিধানের পথ নিয়ে বাস্তবায়নযোগ্য সুপারিশ তুলে আনার লক্ষ্যে গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্য তখন আরও তথ্যবহুল আলোচনার পথ করে দেবে।
গ্রামীণ ব্যাংকের অনৈতিক কাজ করার যে অভিযোগ উঠেছে, তা অনেক গুরুত্বের দাবি রাখে। আশা করি, নরওয়ে সরকারের বিবৃতি এবং সম্প্রতি অধ্যাপক ইউনূসের সংবাদ সম্মেলন এই প্রশ্নের সার্থক পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছে।
৭ ডিসেম্বর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে নরওয়ের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাদের উন্নয়ন সহযোগিতাবিষয়ক মন্ত্রী এরিক সোলহেইমকে উদ্ধৃত করে জানিয়েছে, তাদের প্রতিবেদন বলছে, ‘নরওয়ের দেওয়া তহবিল অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো কাজে ব্যবহার কিংবা দুর্নীতিমূলক কাজে জড়িত থাকা অথবা তহবিল তছরুপের মতো কাজে গ্রামীণ ব্যাংকের জড়িত থাকার কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। ১৯৯৮ সালের মে মাসে তৎকালীন সরকারের অধীনে সেই তহবিল ফেরত দেওয়ার বিষয়ে সমঝোতার মাধ্যমেই বিষয়টি শেষ হয়ে যায়।’
সংবাদ সম্মেলনে ইউনূস আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন যে গ্রামীণ ব্যাংকের অবৈধ কর্মকাণ্ড বিষয়ে নরওয়ের সরকার কখনোই কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করেনি; বরং প্রশ্ন উঠেছিল যে কেমন করে নরওয়ের সহায়তা ব্যবহূত হওয়া উচিত সেই পদ্ধতির বিষয়ে। নরওয়ের উল্লিখিত প্রতিবেদনটিতে কোনো অবৈধ কাজ না হওয়ার পূর্বস্বীকৃতি আছে।
আর টিভি অনুষ্ঠানের প্রযোজক হেইনেম্যানও এক বিবৃতিতে সেটি স্বীকার করেছেন। যেহেতু গ্রামীণকে যেসব দেশ অর্থ দান করেছিল, তাদের কেউই গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মকাণ্ডের বিষয়ে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করেনি; তাই মনে হয়, বিষয়টির এখানেই পরিসমাপ্তি ঘটবে।
এই ঘটনায় উঠে আসা আরেকটি বিষয় কোনো অংশে কম প্রাসঙ্গিক নয়। সেটি হলো গণমাধ্যম ও সমাজের কিছু অংশের ব্যাপক প্রতিক্রিয়া। টিভি অনুষ্ঠানটির সত্যতার ব্যাপারে শুরুতেই গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যাখ্যা ও প্রতিক্রিয়া না চেয়ে গণমাধ্যম ও সমাজের কিছু অংশ অত্যন্ত সম্মানিত একটি প্রতিষ্ঠানের অপকর্মের কথা বলার এই সুযোগটি ব্যবহারের অশোভনীয় উৎসাহ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
সত্য ও যুক্তিকে কবর দিয়ে অধ্যাপক ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যাপারে অতিরিক্ত অনুমানমূলক বক্তব্য প্রকাশ করা হয়েছে। ইউনূসের প্রতি নিন্দাপ্রবাহের কেন্দ্রে ছিল এমন অনুমান যে গ্রামীণ ব্যাংক আসলে অধ্যাপক ইউনূসের ব্যক্তিগত সম্পত্তি আর বিদেশি সহায়তা ও ঋণের সুদ কোনো না কোনোভাবে ইউনূস ও তাঁর পরিবারের ব্যক্তিগত অর্থসম্পদ বাড়িয়ে চলেছে।
সমালোচক/বিশ্লেষকদের কেউই গ্রামীণ ব্যাংকের মালিকানা কিংবা বাস্তবিক করপোরেট স্ট্যাটাস নিশ্চিত হওয়ার সামান্যতম চেষ্টাও করেননি। সেই চেষ্টা করলে দেখতে পেতেন, বাদবাকি বেশির ভাগ এমএফআইয়ের বিপরীতে গ্রামীণ ব্যাংক কোনো এনজিও নয় বরং একটি বাণিজ্যিক ব্যাংক, যার মালিক নিম্ন আয়ের ঋণগ্রহীতা লাখ লাখ মানুষ। বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গ্রামীণ ব্যাংক তার অস্তিত্ব ও বিকাশের জন্য বিদেশি সহায়তার ওপর আর নির্ভরশীল নয়।
বাণিজ্যিকভাবে টিকে থাকতে গ্রামীণ ব্যাংককে ঋণগ্রহীতাদের কাছ থেকে সুদ হিসেবে পাওয়া রাজস্ব থেকে মুনাফা অর্জন এবং কার্যকর ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ব্যয় কমাতেই হতো। গ্রামীণ ব্যাংকের আয় ইউনূসের পকেটে কিংবা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনার হাতে যায় না, বরং ব্যাংকটির নিম্ন আয়ের মালিকদের কাছে লভ্যাংশ আকারে ফিরে যায় কিংবা ব্যাংকের ঋণদান কার্যক্রমের বিস্তার ঘটাতে তা রিসাইকেল করা হয়।
কর অব্যাহতি কিংবা কর বাঁচানোর পদক্ষেপগুলোর সুবিধা নেওয়া একইভাবে গ্রামীণের সদস্যদের উপকারেই লাগে। নিম্ন আয়ের অংশীদারদের দ্বারা নির্বাচিত নয়জন প্রতিনিধি গ্রামীণ ব্যাংকের বোর্ডে বসেন। আমার জানা নেই, বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কিংবা বেসরকারি কোনো ব্যাংকের নিম্ন আয়ের ঋণগ্রহীতা কিংবা আমানতকারী সেসব ব্যাংকের বোর্ডে বসেন কি না কিংবা কতগুলো এনজিওর বোর্ডে তাদের সুবিধাভোগীদের প্রতিনিধি থাকেন।
গ্রামীণের ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি হয়তো ঋণগ্রহীতাদের দারিদ্র্য পুরোপুরি দূর করতে পারেনি, কিন্তু তাঁদের দারিদ্র্য লাঘবে সহায়ক হয়েছে। ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচির মাধ্যমে দারিদ্র্য একদম দূর হয়ে যাবে, এমন উচ্চাভিলাষী চিন্তা এই কর্মসূচির পেছনে ছিল না, কারণ ক্ষুদ্রঋণ দারিদ্র্য কমানোর একটি উপায় মাত্র। গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্যরা দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে এসেছেন কি না, তা নিরূপণের লক্ষ্যে অধ্যাপক ইউনূস ১০টি মানদণ্ড স্থির করেছেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংকের অধিকাংশ সহযোগী সংস্থার লক্ষ্য দারিদ্র্যের অন্য মাত্রাগুলো মোকাবিলা করা। গ্রামীণ কল্যাণ নামের প্রতিষ্ঠানটি, যেখানে নরওয়ের অর্থ স্থানান্তর করা হয়েছিল, সেটির লক্ষ্য গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্যদের স্বাস্থ্য ও শিক্ষাসংক্রান্ত চাহিদাগুলো মেটানো।
নানামুখী উদ্যোগের মাধ্যমে বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর সেবা করার মধ্য দিয়ে অধ্যাপক ইউনূস বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন এবং দেখিয়ে দিয়েছেন যে এসব নিম্ন আয়ের মানুষের টিকে থাকার জন্য কোনো দান-খয়রাতের প্রয়োজন নেই। তারা বরং ব্যাংকের গ্রাহক, যারা ঋণ পাওয়ার যোগ্যতা রাখে, তারা উৎপাদনশীল কাজে নিয়োজিত হতে পারে এবং এভাবে তাদের ঋণের চাহিদা মেটানো বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক হতে পারে। ঋণগ্রহীতাদের অর্থনৈতিক লাভের কারণেই গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষুদ্রঋণের পরিধি চট্টগ্রামের এক জোবরা গ্রাম থেকে বাংলাদেশের ৮১ হাজার ২৭৩টি গ্রামের ৮৩ লাখ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে এবং গ্রামীণ ব্যাংক পরিণত হয়েছে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ক্ষুদ্র অর্থায়ন প্রতিষ্ঠানে।
নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোর মালিকানায় এবং তাদেরই সেবার লক্ষ্যে একটি বিশাল স্বনির্ভর সংস্থা গড়ে তোলার এই সাফল্যই বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়েছে। এই স্বীকৃতি অধ্যাপক ইউনূস ও তাঁর গ্রামীণ ব্যাংককে এনে দিয়েছে নোবেল শান্তি পুরস্কার। এ ছাড়া প্রেসিডেন্ট ওবামার হাত থেকে ইউএস প্রেসিডেনশিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম, মার্কিন কংগ্রেস কর্তৃক প্রদত্ত কংগ্রেসনাল গোল্ড মেডেল এবং ভারতীয় লোকসভা ও রাজ্যসভার যৌথ অধিবেশনে বক্তৃতা করার আমন্ত্রণের মতো বিরল সম্মানও তিনি লাভ করেছেন একই সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ।
প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের মতো যেকোনো বড় আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব যিনিই বাংলাদেশ সফরে আসেন, তিনি অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং তাঁর গ্রামীণ ব্যাংক পরিদর্শন না করে ফিরে যান না। আর কিছু আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব, যেমন—রাহুল গান্ধী ও প্রিয়াঙ্কা গান্ধী তো বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন বিশেষভাবে গ্রামীণ ব্যাংক ও ব্র্যাকের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানার জন্য।
অধ্যাপক ইউনূস ও তাঁর গ্রামীণ ব্যাংক এসব আন্তর্জাতিক পুরস্কার ও অনন্যসাধারণ স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে বিশ্বজুড়ে যেমন অধ্যাপক ইউনূসের স্বীকৃতি প্রতিষ্ঠা করেছে, তেমনই বাংলাদেশকেও মর্যাদাবান করেছে। আজকে বিশ্বব্যাপী মানুষের কাছে বাংলাদেশ সম্পর্কে যে সামান্য কয়েকটি ইতিবাচক উদ্যোগ স্বীকৃতি পেয়েছে, আমাদের ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি তার অন্যতম। তাই যখন কোনো কোনো বাংলাদেশি অধ্যাপক ইউনূস ও তাঁর গ্রামীণ ব্যাংককে খাটো করার চেষ্টা করেন, তখন আমাদের মনে রাখতে হবে যে এটা করার মধ্য দিয়ে আমরা বিশ্বের কাছে নিজেদেরও খাটো করছি।
সারা বিশ্বের মানুষ যেটাকে বাংলাদেশের মহান অর্জন বলে মনে করে, সেটা তা নয় বলে আমরা নিজেদেরই খাটো করছি। আমাদেরই একজন নাগরিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলার মধ্য দিয়ে আমরা অভিযুক্ত করছি নোবেল কমিটি, ভারতীয় পার্লামেন্ট, মার্কিন কংগ্রেস, মার্কিন প্রেসিডেন্ট এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীকে, বিশেষভাবে যাঁরা বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন গ্রামীণ ব্যাংক সম্পর্কে জানতে অথবা যাঁরা তাঁর কর্মসূচি সম্পর্কে জানতে নিজেদের দেশে অধ্যাপক ইউনূসকে আমন্ত্রণ করেছেন বক্তৃতা করতে। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলার মধ্য দিয়ে আমরা বোঝাতে চাইছি, এই সব বিশ্বনেতাকে আমরা নির্বোধ মনে করি, যাঁদের যা বোঝানো হয় তা-ই বোঝেন, নিজেরা কিছুই জানেন না, গ্রামীণ ব্যংকের ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচির মতো একটি অসার কর্মসূচি দেখিয়ে অধ্যাপক ইউনূস তাঁদের বোকা বানিয়েছেন, তাঁরা নিজেরা এ সম্পর্কে কোনোই খোঁজখবর নেননি।
এই বিখ্যাত ব্যক্তিরা কেউই শিশু বা বেকুব নন যে অধ্যাপক ইউনূসের স্বদেশি কিছু মানুষ তাঁর সম্পর্কে কিছু নেতিবাচক কথাবার্তা বলছেন বলেই তাঁর সম্পর্কে তাঁদের ভালো ধারণা খারাপ হয়ে যাবে। তাঁরা বরং এটা ভেবে অবাক হতে পারেন, যে ব্যক্তি ও তাঁর গড়া প্রতিষ্ঠান বিশ্বজুড়ে শুধু সম্মানিতই নন, তাঁর কর্মসূচি দেশে দেশে অনুসৃতও হচ্ছে, তেমন একজন মানুষকে তাঁর নিজের দেশেই এমন অসম্মান করা হচ্ছে!
সুতরাং এখানে দাঁড়িয়ে আমরা কোন দিকে হাঁটব? গ্রামীণ ব্যাংক ও তার প্রতিষ্ঠাতার বিরুদ্ধে প্রতিকূল কথাবার্তা চালিয়ে যাব? হয়তো এই নোংরা অধ্যায়ও (এখনো পর্যন্ত বাংলাদেশের বৈশ্বিক ভাবমূর্তির উন্নতিতে কোনো ভূমিকা রাখেনি) আমাদের জন্য কোনো ইতিবাচক ফলাফল নিয়ে আসতে পারে।
যদিও গ্রামীণ ব্যাংক বিশ্বব্যাপী অত্যন্ত শ্রদ্ধার পাত্র, তবে তাতেই এটি সমালোচনার ঊর্ধ্বে উঠে যায় না। এত বড় একটি প্রতিষ্ঠান ত্রুটিমুক্ত নয়। দ্বিতীয় ধাপের বহু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি, সেসবের দিকে এখনই দৃষ্টি দেওয়া দরকার। গ্রামীণ ব্যাংকের কার্যক্রম নিয়ে যেখানে বাংলাদেশ সরকারের নিজেরই উদ্বেগ আছে, সেখানে সবার জন্য মঙ্গলজনক হবে, যদি আমাদের জ্যেষ্ঠ নীতিনির্ধারকদের ও অধ্যাপক ইউনূসের মধ্যে সংলাপের সূচনা করা যায়। সেই সংলাপে তাঁরা এসব বিষয়ে আলোচনা করতে পারেন এবং এসব উদ্বেগ কীভাবে মোকাবিলা করা যায়, সে ব্যাপারে বোঝাপড়ায় উপনীত হতে পারেন। গ্রামীণ ব্যাংক দারিদ্র্য বিমোচনের মূল কাজটি আরও কার্যকরভাবে কীভাবে করতে পারে, সেই পথ খোঁজার গঠনমূলক আলোচনা এখানে হতে পারে।
একইভাবে, গণমাধ্যমের একাংশ কিংবা পেশাজীবী সমাজ যদি গ্রামীণ ব্যাংকের কিছু কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে প্রশ্ন তোলে, তাহলে তাদের অধ্যাপক ইউনূস ও তাঁর সহকর্মীদের সঙ্গে বসার ব্যবস্থা করা হোক; গ্রামীণের কর্মসূচি তারা দেখুক এবং তারপর সিদ্ধান্তে পৌঁছাক। এতে সবচেয়ে ভালো ফল পেতে পারে সরকার। দারিদ্র্য বিমোচনে সরকারের নিজস্ব ভিশন আছে। গ্রামীণ ব্যাংক এবং এ-জাতীয় যেসব প্রতিষ্ঠান সারা দেশের স্বল্প আয়ের লাখ লাখ মানুষকে নিয়ে কাজ করছে, সেসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সরকারের কার্যকর অংশীদারি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তা উপকারে আসবে। এমন অংশীদারি দেশকে উজ্জীবিত করতে পারে এবং বিশ্বে আলোড়ন তুলতে পারে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
রেহমান সোবহান: অর্থনীতিবিদ; সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের চেয়ারম্যান।
===========================================
সূত্র: এখানে
===========================================
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে ডিসেম্বর, ২০১০ রাত ১০:২৪