যদি জিজ্ঞেস করা হয় "এবারে শীতের তীব্রতা কেমন"? সবাই একবাক্যে বলবেন "তেমন একটা নেই"। গত বছর শীত যেখানে বিগত পঞ্চাশ বছরের রেকর্ড ভেঙে ফেলেছিল সেখানে এ বছর শীত নেই বললেই চলে। গত ৫০ বছরে বাংলাদেশে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায়৷ ২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের সেই শীতের মধ্যে যারা কাজকর্ম করেছেন তারা বলতে পারবেন শীত কাকে বলে। তবে এ বছর দিনের বেলা তো শীতের কাপড় ছাড়াই দিব্যি চলাফেরা করা যাচ্ছে। রাতেও তেমন শীত অনুভূত হয় না। কিন্তু আমাদের অবস্থার সাথে পৃথিবীর একটি দুর্গম এলাকার কিছু মানুষের জীবনযাত্রা মেলাতে গেলে নিশ্চিত ভিরমি খাবেন। আমার বা আপনার মনে হতে পারে যে, শীত আর এমন কী জিনিস? যত শীতই আসুক কুছ পরোয়া নেই। কিন্তু পরোয়া না করতে চাইলেও কিছুটা চমকিত যে হবেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। তাহলে আর দেরি কেন? চলুন, মানুষ কতটুকু শীত সহ্য করতে পারে তার একটি সামান্য নমুনা দেখা যাক।
"ওই মিয়া কন"। আরে না না, এটার অর্থ কাউকে কিছু বলতে বলা নয়। আসলে শব্দটা হল "ওইমিয়াকন"। গ্রাম বাংলায় একটি কথা প্রচলিত আছে যে, “মাঘের শীতে বাঘেও ভয় পায়”। কথাটি মিথ্যা কিছু নয়। মাঘ মাসে আমরা কিছুতেই ঘর থেকে বের হতে চাই না। মন চায় সারাদিন লেপের নিচেই শুয়ে থাকি। এই অল্প শীতে যদি আমাদের এই অবস্থা হয়, তাহলে পৃথিবীর একটি বিশেষ স্থানের বাসিন্দাদের অবস্থা চিন্তা করুন; দুনিয়ার সবচেয়ে ঠাণ্ডা স্থান হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া এই জায়গার বাসিন্দাদের শীতে কী অবস্থা হয়?
এই শীতলতম স্থানটির নাম হচ্ছে ওইমিয়াকন। আধা গ্রাম আধা শহর। মাত্র পাঁচ শতাধিক লোকের জনপদ। সবেধন নীলমনি একটি মাত্র হোটেল; যেখানে গরম পানির ব্যবস্থা তো নেইই, মরার ওপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে অতি প্রয়োজনীয় নিত্যদিনের প্রাকৃতিক কাজকর্ম সারার অত্যাবশ্যকীয় বস্তু বাথরুমও রয়েছে হোটেলের বাইরে। পৃথিবীর সবচেয়ে শীতল স্থান হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া এই আধা গ্রাম আধা শহরটার অবস্থান হল রাশিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় প্রজাতন্ত্র শাখা ইয়াকুটিয়ায়। শীতকালে এই গ্রামের গড় তাপমাত্রা থাকে মাইনাস ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তবে একবার তা হিমাঙ্কের ৭১.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত নিচে নেমে গিয়েছিল। এখন পর্যন্ত এটাই মানুষ বসবাস করা কোনো অঞ্চলের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা। সাইবেরিয়া অঞ্চলের এ এলাকাটির একটি ডাকনাম আছে, ‘স্ট্যালিনের মৃত্যু উপত্যকা'। এখানে ১২ মাসের মধ্যে ৯ মাসই শীত থাকে! সবচেয়ে বেশি কষ্ট হয় ডিসেম্বর এবং জানুয়ারি মাসে। সে সময়ে দিন থাকে মাত্র ৩ ঘণ্টা। অনেকেই গ্রীনল্যান্ডকে সবচেয়ে শীতল স্থান বলে মনে করে থাকেন কিন্তু আসলে ওইমিয়াকনই হল মনুষ্য অধ্যুষিত সবচেয়ে শীতল স্থান। এর আগে ২০১৩ সালে মনুষ্য বসতিবিহীন পূর্ব এন্টার্কটিকাতে মাইনাস ৯৪ দশমিক সাত ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়।
দুর্গম এই শহরের জীবনযাত্রা বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরতে ২০১৬ সালে সেখানে যান নিউজিল্যান্ডের ফটোগ্রাফার আমোস চ্যাপেল। ওইমিয়াকনে এমনই ঠাণ্ডার প্রভাব যে চোখের পাঁপড়িতেও জমে যায় বরফ। ফুটন্ত গরম পানি ওপরের দিকে ছুড়ে দিলে তা আর পানি থাকে না; বরফের কণায় পরিণত হয়। আমোস চ্যাপেল ওইমিয়াকনে পাঁচ সপ্তাহ ছিলেন। সেখানে থাকার অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন তিনি। আমোস বলেন, ‘ঠাণ্ডায় আমার পা জমে যেত, যেন কেউ শক্ত করে ধরে রেখেছে। এমনকি মুখের লালা পর্যন্ত বরফ হয়ে যেত, আর আমার ঠোঁটে গুঁতো লাগতো। আমার ক্যামেরা চালানোই কষ্টসাধ্য ছিল”।
তিনি প্রায় ১০,০০০ মাইল ভ্রমণ করেছেন সাইবেরিয়ার একদম কোণায় অবস্থিত এই ছোট শহরটির ছবি তুলতে। এখানকার আবহাওয়া এতটাই খারাপ যে, এখানে কোনো প্লেন যেতে পারে না। গাড়িতে করে ৫৭৬ মাইল দূরে অবস্থিত পার্শ্ববর্তী শহর থেকে এখানে পৌঁছাতে সময় লাগে দুই দিন।
এই আধা গ্রাম আধা শহরে মনমত কোনো হোটেল না থাকলেও স্থানীয় অধিবাসিরা খুব বন্ধুত্বপূর্ণ। কেউ এখানে বেড়াতে এলে তাদেরকে নিজেদের ঘরেই থাকার জায়গা করে দেন এখানকার বাসিন্দারা। তাঁরা নিজেদের খাবারের জন্য পশু এবং মাছ শিকার করেন। কেউ কেউ আবার কৃষক রয়েছেন, তবে সেটি বছরে অল্প কিছু সময়ের জন্য। গরুগুলো শুধু গ্রীষ্মের সময়েই দুধ দেয় এবং সেটিকে হিমায়িত করে পুরো বছরের জন্য সংরক্ষণ করা হয়। বেশি শীতের সময়ে সারাক্ষণই আগুন জ্বালিয়ে রাখতে হয়। এখানে নেই কোনো পানির ব্যবস্থা, কারণ পাইপে পানি বরফ হয়ে যায়। বরফ গলিয়েই খাওয়ার পানির ব্যবস্থা করেন এখানকার বাসিন্দারা। এত বৈরি আবহাওয়ায় টিকে থাকতে পেরে এখানকার লোকেরা খুব গর্বিত। এই স্থানে যারাই বেড়াতে যায়, তাদের নাম তালিকাভুক্ত করা হয় প্রমাণস্বরূপ যে, তারা দুনিয়ার সবচেয়ে শীতল স্থানের সাক্ষী হয়েছে। এখানকার অধিবাসীরা এখন ঠান্ডায় অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। তবে মাইনাস ৫২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে তাপমাত্রা নেমে গেলে তখন বন্ধ রাখা হয় এখানকার একমাত্র স্কুল।
প্রচণ্ড ঠান্ডার কারণে স্থানীয়দের বেশ কিছু সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। এর মধ্যে রয়েছে কলমের কালি জমে যাওয়া কিংবা একবার বন্ধ করার পর গাড়ি আবার চালু না হওয়া। এ ছাড়া ঠান্ডার কারণে ব্যাটারি দ্রুত তার কার্যক্ষমতা হারায়। সবচেয়ে বড় সমস্যা হল, স্থানীয়দের কেউ মারা গেলে বরফের কারণে তাঁকে কবর দেওয়ার জায়গা পাওয়া যায় না। সে ক্ষেত্রে মৃতদেহভর্তি কফিন সমাধিস্থ করার আগে কবর খননের জন্য আগুন জ্বালিয়ে বরফযুক্ত মাটি কাটা হয়, যা করতে অন্তত তিন দিন সময় লাগে।
তবে এটাও ঠিক যে এই তাপমাত্রার করণেই ওইমিয়াকন স্থানটি পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় স্থানে পরিণত হয়েছে। কিছু কিছু ভ্রমণবিষয়ক প্রতিষ্ঠান ‘পোল অব কোল্ড’ বা ‘ঠান্ডার শেষ সীমানা’ সফরের জন্য নতুন ভ্রমণ পরিকল্পনা তৈরি করেছে।
চলুন দেখে নেওয়া যাক আমোস চ্যাপেলের তোলা অসাধারণ ছবিগুলো; যেগুলোতে ফুটে উঠেছে ওইমিয়াকনের ৫০০ বাসিন্দার দৈনন্দিন জীবনের হালচাল।
দেখুন অবস্থা। ভুরু পর্যন্ত রেহাই পায়নি বরফের আদর থেকে
মাটি শক্ত হয়ে ঘরের ভেতর খননকাজ করা কষ্টসাধ্য হওয়ায় ওইমিয়াকনের বাসিন্দাদের ঘরের বাইরেই টয়লেটের ব্যবস্থা করতে হয় © Amos Chaple
নিকোলাই পেত্রোভিচ নামক এই কৃষক শহরের কিনারায় উষ্ণ পানির ধারায় তার গরুদের পানি পান করাচ্ছেন © Amos Chapple
শহরের (নাকি গ্রামের) পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া গরম পানির ধারা © Amos Chapple
ভারী বরফে ঢাকা একটি সেতুর উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন ওইমিয়াকনের এক নারী © Amos Chapple
গাড়ির ইঞ্জিন চালু রেখেই দোকানের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন একজন ব্যক্তি। এখানকার লোকেরা গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ করে না, কারণ একবার বন্ধ হলে ঠাণ্ডায় জমে গিয়ে আবার চালু না-ও হতে পারে © Amos Chapple
পানি পান করে গরুরা ফিরে যাচ্ছে তাদের গোয়ালে © Amos Chapple
মাইনাস ৫০ ডিগ্রী সেলসিয়াসে ওইমিয়াকনে যাওয়ার মহাসড়কের দৃশ্য © Amos Chapple
কারো গ্রীষ্মকালের জুতা বরফে শক্ত হয়ে অপেক্ষা করছে শীত শেষ হওয়ার © Amos Chapple
বরফে জমে থাকা এরকম বাড়ির দৃশ্য এখানকার খুব সাধারণ ঘটনা © Amos Chapple
ওইমিয়াকনের বিচ্ছিন্ন এই জনগোষ্ঠীর প্রয়োজনীয় মালামাল সরবরাহ করতে থাকে এখানকার এই একমাত্র দোকানটি © Amos Chapple
মশাল দিয়ে জমে যাওয়া ট্রাকের ইঞ্জিন গরম করছেন একজন ব্যক্তি © Amos Chapple
এখানকার বাজারে মাছ, মাংস সংরক্ষণের জন্য কোনো ফ্রিজের দরকার হয় না। শুকনো বায়ু নিশ্চিত করে যাতে মাছ এবং খরগোশ হিমায়িত এবং তাজা থাকে। ঠাণ্ডায় জমে জমি শক্ত হয়ে যাওয়ায় সবজির উৎপাদন হয় না। ফলে এখানকার মানুষদের মাছ এবং মাংসের উপরই বেশি নির্ভর করতে হয় © Amos Chapple
এখানকার ঘোড়ারা হয়েছে বিজ্ঞানীদের গবেষণার বিষয়বস্তু, কারণ তারা খুব সহজেই পরিবেশের সাথে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারে © Amos Chapple
মাইনাস ৫৭ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় বিপজ্জনক ঠাণ্ডা থেকে মুখকে রক্ষার জন্য হাত দিয়ে ঢেকে রেখেছেন এক মহিলা। পিছনে ভ্লাদিমির লেনিনের ভাস্কর্য ঝাপসাভাবে দেখা যাচ্ছে © Amos Chapple
একজন খামারি তার গরুগুলোকে ঠাণ্ডার হাত থেকে বাঁচাতে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত একটি ঘরে বেঁধে রাখে। এখানেই রাতে গরুরা ঘুমায় © Amos Chapple
কেমন লাগল আপনাদের এই হিম হিম পোস্টে ঢুকে বরফশীতল আব্হাওয়ার খানিকটা ঝাপটা পেয়ে? ও হ্যাঁ, বলতে ভুলে গেছি- পোস্টের প্রথমে দেওয়া নীলনয়নার ছবিটা কিন্তু আমার তোলা নয়, ওটাও আমোস চ্যাপেলেরই তোলা।
আরও জানতে চাইলে এই ভিডিওটা দেখতে পারেনঃ https://www.youtube.com/watch?v=iPQITWHpcKg
সূত্রঃ অন্তর্জাল। ছবিগুলো রোয়ার মিডিয়া থেকে নেয়া।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জানুয়ারি, ২০১৯ সকাল ১১:৪১