প্রথম পর্ব এখানে: Click This Link
এলিফ্যান্ট রোডে একটা নিরিবিলি আর পরিপাটি রেস্টুরেন্ট আছে। এরা খুব ভালো সার্ভিস দেয়। এদের রান্নাটাও বেশ ভালো। আর খাবারের দাম তুলনামূলকভাবে অনেক কম। আমি প্রায়ই এখানে খাওয়াদাওয়া করি। আরেকটা সুবিধা হল ফ্যামিলি নিয়ে বসার জন্য ভেতরে ছোট ছোট কেবিন আছে। তাই আশেপাশের বাসিন্দাদের অনেকেই ফ্যামিলি নিয়ে নিরিবিলিতে আর কমদামে ভালো খাবারের জন্য এখানে চলে আসে।
পরদিন সকাল সাড়ে আটটার দিকে সেই রেস্টুরেন্টের একটা কেবিনে ঢুকে নাস্তা শেষ করে এক কাপ কফি নিয়ে আস্তে আস্তে চুমুক দিচ্ছি। ফারিহার আসার কথা নয়টার মধ্যে।
পৌনে নয়টার দিকে ও এলো। ওয়েটারকে ডেকে আরেক কাপ কফির অর্ডার দিলাম। চেয়ারে বসার পর ওর দিকে ভালো করে তাকালাম। সাধারণ একটা হলুদ শাড়ি পরে এসেছে। একেবারে নিরাভরণ। শুধু বাম হাতের কব্জিতে ছোট্ট একটা রিস্টওয়াচ। ওর সেই পাগল করা রূপে কোথায় যেন ভাটা পড়েছে। আগের মত চোখ ধাঁধানো অবস্থাটা আর নেই! চোখমুখে ক্লান্তির ছাপ সুস্পষ্ট! তারপরও বলা যায় এখনও যে কোন পুরুষের মাথা ঘুরিয়ে দেয়ার ক্ষমতা ওর রূপে আছে।
ওয়েটার আরেক কাপ কফি দিয়ে গেল। আমি ইশারায় ওকে কাপটা নিতে বললাম। একটু ইতস্তত করে কাপটা নিয়ে ধীরে ধীরে চুমুক দিতে লাগল ও। কিছুক্ষণ পর কাপ নামিয়ে রেখে আমার দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। মনে হয় চেহারায় কিছু খুঁজল। তারপর চোখ নামিয়ে নিল। মুখ নিচু করে আস্তে করে জিজ্ঞেস করল-
"কেমন আছো তুমি?"
"ভালো আছি" বললাম আমি।
"আমি জানি তোমাকে আমার সাথে দেখা করার ব্যাপারে জোর করা উচিত হয়নি। কিন্তু আমি খুব বড় বিপদে পড়ে তোমার সাহায্য চাইতে এসেছি। তোমার সাহায্য না পেলে আমি এ বিপদ থেকে উদ্ধার পাবো না, তাই জোর করে তোমাকে দেখা করতে রাজি করিয়েছি" বলল ফারিহা।
"দেখো ফারিহা, এখন তুমি আরেকজনের ঘরণী। তোমার যে কোন বিপদে তোমার স্বামীই সবচেয়ে বড় সাহায্যকারী। তুমি বিপদের কথা তার কাছে খুলে বল, সে নিশ্চয়ই তোমাকে সাহায্য করবে" বলে আমি তার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে চাইলাম।
"না, আমি তোমার সাহায্য চাই। সে আমাকে সাহায্য করতে পারবে না" বলে ও আমার দিকে আবেদনভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
"কিন্তু আমি তো এখন তোমার কেউ নই। আমার কাছে আসা তোমার উচিত হয়নি। আর তোমার স্বামী পারবে না অথচ আমি তোমাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারব এ ব্যাপারে এত নিশ্চিত হলে কী করে, আর বিপদটাই বা কী?" আমি প্রশ্ন করলাম।
"সেটা বোঝানোর জন্য আমাকে তোমার একটু সময় দিতে হবে। বিশ্বাস কর, অন্য কোন উপায় থাকলে আমি তোমার কাছে এভাবে কখনও ছুটে আসতাম না। কারণ, তোমার সাথে আমি যে অন্যায় করেছি তারপর আর তোমার কাছে সাহায্য চাওয়ার কোন অধিকার আমার নেই। কিন্তু আমি বর্তমানে অপারগ। তোমাকে ছাড়া এই বিপদের কথা আর কাউকে বলা সম্ভব নয়।"
ফারিহার কথায় আমি একটু অস্বস্তি বোধ করলাম। সে এমন কোন্ বিপদে পড়েছে যে নিজের স্বামীকে না জানিয়ে প্রাক্তন প্রেমিকের কাছে সাহায্যের আশায় ছুটে এসেছে? তার কথায় নিজের ভুলের জন্য হালকা অনুতপ্ত হওয়ারও আভাস পেলাম। সে তার অন্যায় কাজের জন্য কিছুটা হলেও অনুতপ্ত হয়েছে জেনে তার জন্য মনে কিছুটা করুণারও উদ্রেক হল।
"আচ্ছা ঠিক আছে, ওসব কথা থাক। তোমার বিপদটা কী তা-ই বল" বললাম আমি।
ফারিহা মনে মনে কথাগুলো গুছিয়ে নিয়ে বলতে শুরু করল:
"আমাদের ক্লাসের রবিনের কথা তোমার মনে আছে?
"হ্যাঁ, মনে আছে। ক্লাসের মধ্যে সবচেয়ে পয়সাঅলা আর সবচেয়ে স্মার্ট ছেলে ছিল সে। তার সাথে সবসময় আরেকটা ছেলে ঘোরাফেরা করত। নামটা মনে পড়ছে না।"
"সেই ছেলেটার নাম ছিল আজিম।"
"হুম! তারপর বলে যাও।" বললাম আমি।
"রবিনকে আমি পছন্দ করতাম এবং ভালোবাসতাম।"
শুনে স্থির হয়ে গেলাম আমি। কিছুক্ষণ নির্নিমেষ তাকিয়ে রইলাম ওর মুখের দিকে। তার মানে আমার সাথে অভিনয় করলেও আসলে ও ভালোবাসত রবিনকে? কিন্তু তাই যদি হয় তাহলে ও রবিনকে বিয়ে না করে ধনীর দুলাল আরেক ছেলের গলায় বরমাল্য পরালো কেন? মনের প্রশ্ন মনেই রয়ে গেল। তারওপর একটু আগে ওর প্রতি যে সহানুভূতি তৈরী হয়েছিল এ কথা শোনার পর তা বেমালুম উবে গেল। আমি শুধু একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম- হুম!
"আমি জানি এ কথা শুনে তুমি খুব আঘাত পেয়েছ। আমাকে ক্ষমা কর" বলে ও চোখ থেকে টপটপ করে পানি ছেড়ে দিল।
যেন কিছুই হয়নি এমনই নির্বিকারভাবে অন্যদিকে তাকিয়ে আমি বললাম- বলে যাও। ও হাতব্যাগ থেকে রুমাল বের করে চোখের পানি মুছে নিয়ে আবার বলতে লাগল-
"রবিনের সাথে আমার খুবই ঘনিষ্ঠতা ছিল। আমরা প্রায়ই একসাথে এখানে ওখানে ঘুরতে যেতাম। আমাদের ব্যাপারটা আজিম সবই জানত। কিন্তু তুমি ঘুণাক্ষরেও জানতে পারোনি।"
আমার এসব কথা শুনতে ভালো লাগছিল না। তাই ওকে ওসব কথা বাদ দিয়ে মূল কথায় আসতে বললাম। ও মুখ নিচু করে আবার বলতে লাগল-
"এর মধ্যে একদিন রবিনের জন্মদিন চলে এল। এ উপলক্ষে রাজধানীর এক নিরিবিলি আর দামি হোটেলে পার্টির আয়োজন করল ও। সেই পার্টিতে রবিনের অনেক বন্ধু আর বান্ধবীও এসেছিল। তার মধ্যে আজিমও ছিল। সেদিন পার্টি শেষ হতে অনেক রাত হয়ে যায়। আমি তখন ড্রিংক করে একটু একটু টলছিলাম। আমি চলে আসতে চাইলে রবিন নিজের গাড়িতে আমাকে বাসায় পৌঁছে দেবে বলে আশ্বাস দিল। তারপর শুধু আজিম ছাড়া সবাই চলে যায়। রবিন আমাকে তার রুমে নিয়ে যায়। তারপর......."
আমি পাথর হয়ে গেলাম। কাপটা এমনভাবে চেপে ধরলাম যে মনে হচ্ছিল হাতের ভেতর সেটা ভেঙে গুঁড়িয়ে যাবে। কার প্রতি জানি না মনের ভেতর থেকে ঘৃণা উথলে উঠতে চাইল। দাঁতে দাঁত চেপে আমি নিজেকে সামলে নিলাম।
"আমি আসলে তখন ঠিক স্বাভাবিক অবস্থায় ছিলাম না। তারপর রবিন আমাকে বাসায় পৌঁছে দেয়। রবিনকে তখনও খুবই স্বাভাবিক লাগছিল। বাসায় এক বান্ধবীর জন্মদিনের কথা বলে গিয়েছিলাম। তাই এতরাতে ফেরার পরও বাবা-মা উদ্বিগ্ন হননি।"
আমি কিছুই না বলে শুধু সাদা দেয়ালের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
ও বলে যেতে লাগল-
"এরপর থেকে রবিন আমার সাথে অনেকবার অন্তরঙ্গ হয়েছে। বলতে বাধা নেই, আমিও সাগ্রহে তার আহবানে সাড়া দিতাম। তারপর ফাইনাল পরীক্ষার পর রবিন আমাকে কিছু না জানিয়ে বিদেশে চলে যায়। বিদেশে যাওয়ার কথাটা শুধু আজিমকেই জানিয়ে যায়। কিন্তু পরে আর ওর সাথে আজিমের যোগাযোগ ছিল না। আজিমের মাধ্যমে তার খোঁজ পাবার অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু আজিম ওর খোঁজ দিতে পারেনি। ওর কোন খোঁজ না পেয়ে আমি মনে মনে প্রায় ভেঙে পড়েছিলাম। এমন সময় হঠাৎ একদিন আজিমের ফোন পেলাম। সে আমাকে পূর্বে রবিন আর আমার যাতায়াত ছিল এমন একটি হোটেলে দেখা করতে বলল। তার কাছে নাকি এমন কিছু আছে যা দিয়ে রবিনের খোঁজ পাওয়া সম্ভব হতে পারে। আমি মনে মনে ভাবলাম- হয়ত সেই হোটেলে তার কোন ডায়েরি বা তার ঠিকানা পাওয়া যাবে বা এমন কোন তথ্য পাওয়া যাবে যাতে রবিনের খোঁজ পাওয়া যেতে পারে। তাই দেরী না করে আমি সেই হোটেলে পৌঁছে গেলাম। আজিম আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। সে আমাকে রিসিভ করে পরিচিত একটি রুমে নিয়ে গিয়ে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিল। তারপর আমাকে খাটে বসতে বলে পকেট থেকে একটি সেলফোন বের করল। আমি ভাবলাম ফোনে হয়ত রবিনের কোন তথ্য পাওয়া যাবে। কিন্তু স্ক্রীনের দিকে চেয়েই আমার শরীর শিউরে উঠল" বলে একটু বিরতি নিল ফারিহা।
আমি কন্ঠস্বরে কাঠিন্য এনে প্রশ্ন করলাম- তারপর?
ফারিহা করুণ দৃষ্টিতে আমার দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ঝরঝর করে কেঁদে দিল।
চলবে।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জুলাই, ২০১৮ রাত ৮:৪৪