“ বহু দিন ধরে বহু ক্রোশ দূরে
বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে
দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা,
দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু ।
দেখা হয়নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে দু পা ফেলিয়া
একটি ধানের শিষের উপর
একটি শিশিরবিন্দু ।“
গুরুদেবের কাব্য দিয়েই শুরু করলাম। আর বাঙ্গালীর গুরুদেব ছাড়া আছেই বা কে ।আমার মতো বেকার মানুষের জন্য সিন্ধু, পর্বতমালা বা বহু দেশ ঘোরা বিলাসিতার মতোই তাই আপাতত: ধানের শিষের উপর একটি শিশিরবিন্দু নিয়েই ব্যস্ত থাকি। অনেকদিন থেকেই ভাবছি ভ্রমন পোস্ট দিবো কিন্তু কিছুতেই হচ্ছিল না । অবশেষে সুযোগ মিললো। সম্প্রতি ঘুরতে গিয়েছিলাম জাতীয় উদ্যান আলতা দিঘী। প্রথমেই জেনে নেওয়া যাক এই বনভূমি ঘেরা আলতাদিঘীর পরিচিতি।
অবস্থান: ধামইরহাট, নওগাঁ ।
আয়তন: ২৬৪ হেক্টর জমির বনভূমির ঠিক মাঝখানেই রয়েছে প্রায় ৪০ একর আয়তনের আলতা দিঘী।
জাতীয় উদ্যান ঘোষনা: ২০১১ সাল ।
প্রতিটি দিঘীর পিছনে কথিত কিছু গল্প আছে এবং এটিও এর ব্যতিক্রম নয়। একসময় এই অঞ্চলে পানির খুব সংকট ছিল। সেইসময় (আনুমানিক ১৪০০ সালের দিকে) এই অঞ্চলে শাসন করতেন বিশ্বনাথ জগদল নামে এক রাজা। তো সেই রাজার স্ত্রী একদিন স্বপ্নে দেখলেন পানি সমস্যা সমাধানে এলাকায় একটি দিঘী খনন করতে হবে। আর রানীর স্বপ্ন বলে কথা সেটাতো আর বৃথা যেতে দিতে পারেন না রাজা। রানী হুকুম দিলেন তিনি হাঁটতে থাকবেন এবং যে খানে গিয়ে পা ফেটে রক্ত বের হবে ততদূর পর্যন্ত একটি দিঘী খনন করতে হবে। পাইক পেয়াদা নিয়ে রানী হাঁটা শুরু করলেন। অনেক দূর হাঁটার পরও রানী যখন থামছিলেন না, তখন পাইক পেয়াদা ভাবলেন এত বড় দিঘী খনন করা রাজার পক্ষে সম্ভব হবে না তাই তাদের একজন রানীর পায়ে আলতা ঢেলে দিলেন এবং চিৎকার করে বলতে লাগালেন রানী মা আপনার পা ফেটে রক্ত বের হচ্ছে। একথা শুনে রানী সেখানেই বসে পড়লেন। রাজা বিশ্বনাথ ওই স্থান পর্যন্ত দিঘী খনন করে দিলেন । আর সেইথেকে দিঘীর নামও হয়ে গেল আলতা দিঘী।
ওহ্ কী ড্রামাটাই না ছিলো এই আলতাদিঘীর নামের পিছন । ড্রামা সত্য হোক মিথ্যা হোক তাতে কিছু আসে যায় না, রাজা বিশ্বনাথ ও রানী কে ধন্যবাদ। তারা নাহলে এত অসম্ভব সুন্দর বনভূমি বেষ্টিত দিঘী আমরা কিভাবে পেতাম।
যাই হোক অনেক প্যাঁচালাম এবার আসল কথাই আসি। জায়গাটা নওগাঁ জেলার অর্ন্তগত হলেও পার্শ্ববর্তী জেলা জয়পুরহাট থেকে যাওয়াটা বেশ সহজ। জয়পুরহাট বাসস্ট্যান্ড থেকে ধামুইরহাটের বাসে উঠবেন ভাড়া নিবে মাত্র ৩০ টাকা এরপর ধামুইরহাট থেকে ব্যাটারী চালিত ভ্যানে আলতাদিঘী ভাড়া নিবে প্রতিজন মাত্র ১৫ টাকা ধামুইরহাট থেকে আলতাদিঘী দুরুত্ব ৫ থেকে ৬ কি:মি: হবে । আলতাদিঘী পাবার ২ কি:মি: আগে থেকেই রাস্তার দু পাশে বিস্তৃত বনভূমি আপনাকে ভীষনভাবে আকৃষ্ট করবে সে আপনি প্রকৃতি প্রেমী হোন বা নাই হোন । বিভিন্ন গাছগছালিতে ভর্তি বনভূমির সৌন্দর্য আপনাকে মুগ্ধ করবে মনে হবে কিছু বিশুদ্ধ অক্সিজেন ফুসফুসে সংরক্ষন করে রাখি।
আলতাদিঘী পৌঁছানোর পর প্রথমে আপনার চোখ জুড়াবে তারপর জুড়াবে হৃদয়।চারিদিকে বৃক্ষের সমারোহের মাঝে দৈর্ঘ্য এ উত্তর-দক্ষিন এই বিস্তীর্ণ জলাভূমির সৌন্দর্যে আপনার মনে হবে বাংলাদেশে এত সুন্দর একটা জায়গা আছে অথচ আমি আরো আগে কেন আসিনি। পুরো দিঘী ঘুরতে আপনি উত্তর বা দক্ষিন যে দিক দিয়ে খুশি হাঁটা শুরু করতে পারেন। আপনি একদম উত্তর পারে গিয়ে দেখতে পাবেন একটি সাইনবোর্ড যাতে লেখা আছে “শূন্য রেখা অতিক্রম করা নিষেধ” । বেশী এডভ্যাঞ্চর দেখাতে গিয়ে শূন্য রেখা অতিক্রম করা যাবেনা কারন শূন্যরেখার পরেই নো ম্যানস ল্যান্ড আর তারপরেই বন্ধু রাষ্ট্রের সীমান্ত চৌকি। তাই সাবধান থাকাই ভালো।
আপনি ঘোরাঘুরি শেষ করে চাইলে একটু সবুজের মাঝে জিরিয়ে নিতে পারেন । পানি, কোল্ড ড্রিংকস, হালকা স্ন্যাকস সচারচর পাবেন। তবে বনভূমির গভীরে যাওয়ার সময় অবশ্যই সতর্কতা অবলম্বন করে উচিত।জায়গাটা বেশ নির্জন, বনভূমিতে বিভিন্ন জাতের প্রানী রয়েছে কিছু বিলুপ্ত প্রজাতীর প্রানীও রয়েছে।
এবার শেষ করার পালা। ফিরবেন ঠিক একইভাবে । দিঘীর পাশে ব্যাটারিচালিত ভ্যান সবসময় পাবেন।
ছবি শেয়ার করতে পারলাম না মোবাইল থেকে পোস্ট দেওয়ার জন্য। ভুলত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। ওহ্ একটা কথা বলতে ভুলেই গেছি আলতাদিঘীর মাঝে ফুটে থাকা অজস্র পদ্ম আপনাকে স্বাগত জানানোর অপেক্ষায় আছে।