ঢেউগুলো যেন দূর, দূর, দূর হতে উড়ে আসা একরাশ শিমুল তুলো
আমি এক ধুনুরির ধনুক যেন, বুনে যাই নকশিকাঁথার বালুচর।
এখানে সব কিছু থেমে গেছে আজ; আছে শুধু সুরের এই নোনা লহরী,
এই সেই স্বপ্নের বালুকাবেলা; অরফিয়াসের সেই সুর নগরী।
পাখিগুলো যায় উড়ে উড়ে বহুদূর, দৃষ্টির শেষ সীমা ছাড়িয়েও দূর,
চোখ বুজে নিমিষেই চলে যাই আজ, পৃথিবীর শেষতম রেখা-সমুদূর।
কোন এক মাউরি শিল্পী হয়ে এঁকে যাই আঁকাবাঁকা পটের রেখা,
নেই কোন দুঃখ, কোন অভিমান; মন খুলে হৃদয়ে তাকিয়ে দেখা-
আমি আর নেই আজ আমার মাঝে, মিশে গেছি নীল এই সাগর জলে,
আছে শুধু অদ্ভুত এই আলোড়ন, ছেয়ে থাকা স্বপ্নিল নবজাগরণ।
------------------------------------------------
প্রথমবার যেবার সমুদ্রে গেলাম সেবার পানিতে খুব একটা নামি নাই, ভয় ছিল যদি ডুবে যাই। আমি আবার সাঁতার পারি না। মোটামুটি পাড়ে হাটাহাটি করে; বড়জোর হাটু পানিতে নেমেই পার করে দিয়েছিলাম। দ্বিতীয়বার গেলাম বেশকিছুদিন পর। আগের মতই হাটু পানিতে নেমেই স্যালুট করে ফেরত এসেছিলাম, পার্থক্য এই যে অনেক দীর্ঘ সময় পানির কাছাকাছি ছিলাম। ঐ পর্যন্তই। এরপর তৃতীয়বারও যাওয়া হল। ব্যাপারটা খুব বেশী বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে এই চিন্তা করে ভাবলাম যে এবার একটু ডুব দেয়ার চেষ্টা করবো, সাগরে গিয়ে পানিতে ঝাপাঝাপি না করা- খুব বাজে দেখায় ব্যাপারটা।
আমি সাগরের কাছে গেলাম- ধীরে ধীরে এগুচ্ছি, গভীরে। দুপাশে ছড়ানো হাতে পানির ঝাপটা এসে লাগছে, ঢেউ এর ধাক্কায় মাঝে মাঝে বেঁকে যাচ্ছি। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি সামনে। আমার হাত এখন পানির নীচে চলে গেছে, ভারসাম্য রক্ষার জন্য উপরে উঠিয়ে নিলাম; পানি এখন প্রায় বুকের কাছাকাছি। ঢেউ যখন এসে আছড়ে পড়ছে আমার উপর- নিঃশ্বাস আটকে, চোখমুখ শক্ত করে বেসামাল হওয়া থেকে বাঁচাতে চাচ্ছি নিজেকে। আর যখন ঢেউ ফেরত যাচ্ছে এমন প্রবল টান, পায়ের নীচে বালি সরে যাচ্ছে, পা ধরে কেউ যেন টেনে নিয়ে যেতে চায়। হাতগুলো দুপাশে ছড়িয়ে পাখির মত উড়ার প্রয়াস যেন আমার; পুরা দেহে এক মাতাল তরঙ্গের অনুনাদ!
আমি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি, শেষ কোন একরোখা যোদ্ধার মত, শেষবারের মত। ঠিক কখন, কিভাবে, কতটুকু জোরে এসে ঢেউটা আমাকে ধাক্কা দিয়েছিল, তা মনে নেই। মনে রাখার বোধ চালু হয়েছিল যে মুহূর্তে তখন আমি কোনদিকে ফিরে, পানির কতটা নীচে হাবুডুবু খাচ্ছি তাও অতটা খেয়াল নেই, প্রাণপণে শুধু কিছু একটা ধরার জন্য আনাড়ির মত হাত-পা নাড়াচ্ছি!
কতক্ষণ যুদ্ধ করেছিলাম জানি না, শেষমেশ যখন হাল ছেড়ে দিয়েছি, হাতে পিচ্ছিল বালির পরশ পেলাম সহসা। শেষ একটা ঢেউ এসে থাপ্পড় দিয়ে আমাকে ছুঁড়ে দিল তীরের দিকে। বিদ্ধস্ত এবং রণক্লান্ত আমি কোনমতে তীরে এসে চিতপটাং। আরও বেশ কিছুক্ষণ পর কিছুটা ধাতস্থ হয়ে চোখ খুলে তাকালাম।
যতদূর চোখ যায় নীল আকাশ!
যতটুক কানে আসে সাগরের গর্জন!
নিঃশ্বাসে ভারী মাতাল হাওয়া!
নোনা স্বাদে ভরা মুখ!
স্পর্শে একরাশ সমুদ্র!
দুপাশে হাত-পা ছড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ভিট্রুভিয়াস ম্যান এর মত আমার এই ট্রিলিয়ন সেলের জৈব সত্তায় এসে সমুদ্রের ঢেউ এর শেষ রেখাগুলো মিলে মিশে এক আশ্চর্য স্পন্দন তৈরি করছিল। এই কবিতাটির জন্ম হয় সম্ভবত তখন।
সমুদ্রময় তরঙ্গ