ফাতেমাদের টিনের চালে তখন শেষ রাত্রি। চারদিক থেকে ফযরের আযান ভেসে আসছে। আড়মোড়া দিয়ে ঘর থেকে বের হলেন ফাতিমার বাবা ফজর আলী। বারান্দায় রাখা কাঁসার বদনা নিয়ে কল তলায় বসলেন ওযু করতে। অন্যান্য দিনের মতোই ওযু সেরেই বারান্দায় উঠতে উঠতে ফাতেমার মাকে ডাকতে লাগলেন।
- কুলসুম বেগম ওঠো, আযান কানে যায় নাই? মাইয়া দুইটারে ডাকো....আব্বারে ডাকো, নামাযের সময় হইছে। ওপাশ থেকে কুলসুম বেগম সাড়া দিয়ে বললেন এই তো ‘উঠি’..। বারান্দায় বেড়ায় ঝুলানো টুপি নিয়ে মসজিদের উদ্দেশ্যে চলে গেলেন ফযর আলী। কোন মতে দুই মেয়ে ফাতেমা ও মরিয়মকে ঘুম থেকে তুলে নামায পড়লেন কুলসুম। ফাতিমার দাদা মাজেদ আলী শীতের কারনে এখন আর আপাততো মসজিদে যায়না। বাড়ীতেই নামায পড়ে নেন। বড় সৌখিন ও ধার্মিক। প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি না থাকলেও অক্ষরজ্ঞান থাকায় প্রচুর বই পড়েন। অধিকাংশই ধমর্-ভিত্তিক।
ফাতেমা তাদের গ্রামের মাদ্রাসায় পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রী। এ বছর বারো-তে পা দিয়েছে। তবু ছেলে মানুষী ভাব একদমই কাটিয়ে উঠতে পারেনি। বাবার কঠিন নিষেধাজ্ঞা সত্তে¦ও এখনো তার সবচেয়ে ভালোলাগা জয়ীতার সাখে পুতুল খেলা। ফযর আলীর কথা ‘একে তো হিন্দু তারপর আবার তার সাথে পুতুল খেলা, আর কখনো শুনলে পিটিয়ে হাড় ভেযে দেবো।’ ফাতিমার ছোট বোন পাঁচ বছরের মরিয়ম এখনো স্কুলে ভর্তি হয়নি। চুপচাপ-শান্ত-শিষ্ট, নিজের জগত নিয়ে থাকতেই বেশি ভালোবাসে।
দুই.
নামায শেষেই এক দৌড়ে দাদার ঘরে এলো ফাতিমা। দাদার সিন্দুকের একদম নিচে লুকিয়ে রাখা পুতুলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর পুতুলটি বের করলো। নামায শেষে তসবি পড়ছিলেন মাজেদ আলী। ফাতেমা পুতুলটি হাতে নিয়েই কোথায় যেন হারিয়ে গেল। কল্পনায় একবার দেখে নিলো তার পুতুলকে বউ সাঁজলে কত সুন্দরই না লাগবে।
মাজেদ আলী পেছন থেকে এসে তার কল্পনা ভাঙল।
- কী হচ্ছে...হুম? আবার পুতুল খেলা? তুই আর বড় হবিনা! আর তোর আব্বা দেখলে এবার কী করবে বল তো?
- দাদা, তুমিও? আজ আমার পুতুলের বিয়ে। বর কে জানো? জয়ীতার পুতুল...কত্ত মজা হবে!!!
- দেখিস, তোর আব্বা আবার দেখে না ফেলে। এখন যা, আইতাল কুরসী মুখস্থ কর। মাদ্রাসায় পড়া না পারলে আবার মৌলবী ইমরান সাহেব মারবেন। বলতে বলতে বাইরে চলে গেল মাজেদ।
তিন.
খালে নতুন পানি আসছে। বারান্দায় বসে ছোট মাছ ধরা জাল মেরামত করছেন ফযর আলী। মরিয়ম তার কচি হাতে যতটুকু পারছে বাবাকে সাহায্য করছে। উনুনের পিঠে রান্নায় ব্যস্ত কুলসুম বেগম।
অন্যান্য দিনের মতোই সকালে কোরআন পড়তে বসেছে ফাতিমা। আয়তাল কুরসী পড়ছে। কিন্তু কোন ভাবেই মন বসাতে পারছেনা। কেননা, এই দিনটি তার জন্য বিশেষ আনন্দের এক দিন। পুতুলের বিয়ে বলে কথা! কত কি কাজ! চুপিচুপি সে কোরআনের শরীফের পৃষ্ঠার নীচে রঙিণ কাগজ দিয়ে প্রজাপতি বানানোর চেষ্টা করছে। আর বারবার বাবার দিকে তাকাচ্ছে, ধরা পড়ে না যায়। ফযর আলী বেশ কিছুক্ষণ ধরেই বিষয়টা একটু একটু লক্ষ করছিলেন। এবার হুট কওে মেয়ের কাছে এগিয়ে গেলেন।
- কী হচ্ছে? কী হচ্ছে দেখি তো? হাতে কী দেখা?
ভয়ে রক্তশূন্য হয়ে গেলো ফাতিমার মুখ। চুপ করে বাবার দিকে তাকিয়ে থাকলো। হাত দুটো মেলে ধরলো।
হাতের ভেতর কাগজের প্রজাপতি দেখে রেগে খুন হলো তার বাবা। ফাতেমা কে আচ্ছা করে বকলেন।
- হিন্দুর সাথে খেইলা খেইলা হিন্তু হইয়া যাইতেছ তাই না? বলছিনা, হিন্দুদেও সাথে মিশবেনা? জানোনা, ইসলামে জীব-জন্তু বানানো, পুতুল খেলা হারাম? আর কত দিন তোমারে কইতে হবে? আজ তুমার নিস্তরি নাই। আমি এক্ষনি মাদ্রাসায় যাইতেছি হুজুরের কাছে নালিশ করতে। তারাই তুমার শান্তি দিবো।
চার:
রাস্তার পাশেই বাশের চটার জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে মাটির প্রতীমা। সামনে বসে গীতা পড়ছে জয়ীতা। জানালায় উঁকি দিয়ে ফিসফিসিয়ে ডাকছে ফাতিমা।
- জয়ীতা....জয়ীতা? (ঘুরে দেখে এক লাফে জানালার কাছে এলো জয়ীতা )
- কী, মাদ্রাসায় যাও? কখন আসবা? আমার বরপক্ষ কিন্তু রেডি। এখন ঠাকুরের কাছে আশির্বাদ চেয়ে পূজা করছিলাম।
- ওওও...কিন্তু জানো আজ সকালে আবার বাবার কাছে ধরা খেয়েছি, খুব বকেছে। কী যে করে আবার! তাতে কী আজ ঠিকই আমাদের পুতুলের বিয়ে হবে। মাদ্রসা থেকে দেখি তাড়াতাড়ি আসতে পারি কি না। তুমি তৈরি থেকো।
‘এসে সব বলব’ বলতে বলতে চলে গেল ফাতিমা। মাটির রাস্তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো জয়ীতা।
পাঁচ:
ক্লাসে ঢুকতে যেয়েই হোঁচট খেলো ফাতিমা। ইমরান হুজুরের কাছে তারা বাবা কী যেন বলছে। নিশ্চয় নালিশ করছে ভাবতে ভাবতে একবারে শেষ বেঞ্চে গিয়ে বসলো সে।
- হুজুর আপনি একটু ব্যাপারটা দেখবেন। মাইয়া ধর্ম-কর্ম মতে না চইললে বাপ হিসেবে আমাকেই দোযখ যাইতে হবে।
- আপনি একদম চিন্তা কইরেন না। আমি ঠিক কইরা নিমু।
ফযর আলী মেয়ের দিকে বিরক্ত চোখে তাকাতে তাকাতে ক্লাসরুম থেকে চলে গেলো। ক্লাস শুরু করলেন ইমরান হুজুর। তাকে গ্রামের মানুষ খুুব সম্মান করেন। একবার শুধু তার নামে একটি কথা তুলেছিল একই গ্রামের এক অল্পবয়সী হিন্দু বিধবা। কিন্তু উল্টো তাতেই গ্রামছাড়া করছিল বিশিষ্টজনেরা।
ক্লাসে এক এক পড়া ধরছেন হুজুর। সবশেষে ফাতেমার কাছে আসলেন। বললেন, আয়তাল কুরসি মুখস্থ বলো। গড়গড় করে প্রথম দু-লাইন পড়লো ফাতিমা। তারপর জড়িয়ে গেল। বারবার এ্যা-উঁ করতে থাকলো। বলল, আর মুখস্থ হয়নি। রেগে গিয়ে হুজুর বললেন-
বইসা বইসা হিন্দুর লগে পুতুল খেললে কি আর আল্লাহ তোমারে আয়তাল কুরসি মুখস্থ করাইয়া দেবো? আজ মুখস্থ না হওয়া পর্যন্ত তুমি এইখানে বইসা থাকবা। বাকিরা সবাই এহন যাইতে পারো। একে এক সালাম দিয়ে সবাই চলেও গেলো।
ছয়.
বিকেল বেলা। আসরের আযান হচ্ছে। জন-প্রাণীশূণ্য মাদ্রাসা। প্রতিটি দরজায় ঝুলছে তালা। একমাত্র ফাতিমার ক্লাসে বসে পেছনের বেঞ্চে বসে ফুঁপিয়ে কাঁদছে ফাতিমা। একদিকে পুতুলের বিয়ে ভেঙে যাওয়া, শিক্ষকের তিরষ্কার অন্যদিকে ক্ষুধার যন্তনায় পড়া মুখস্থ তো দূরে থাক, মাটিতে লুটিয়ে পড়ার উপক্রম তার। অন্যদিকে টেবিলে ঝিমুচ্ছে ইমরান হুজুর। ঘুম ঘুম চোখে মাঝে-মাঝে ফাতিমাকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত খুটিয়ে দেখছে। সেই সুযোগে যেন নিজের ভেতরে জন্ম নিচ্ছে লক্ষ কোটি কু-প্রবৃত্তি কণা। আযানের শব্দে কিছুটা নড়েচড়ে উঠে বললেন,
- কী, আর কতক্ষণ? মুখস্থ হইলো? তোমার জইন্য তো জোহরের নামায পড়তে পালাম না। আর এহন কি আছ্র ও কাযা কইরা দিবা? আল্লাহ আমারে মাফ করুক.....!
চোখের পানি মুছতে মুছতে ফাতিমা শক্ত গলায় বললো- আমি আপনের নামাজ কাযা করিনাই, আপনি আমারটা করছেন। আমার পুতুলের বিয়ে ভাঙছেন। আল্লাহ আপনারে শান্তি দেবেন।
- কী কইলা? কী কইলা তুমি? বেয়াদম মাইয়া? শিক্ষকের মুখে মুখে এতো বড় কথা? দেখাচ্ছি মজা!!!
হুজুর এক লাফে ফাতিমার কাছে এসে দাড়ালো। কোন কিছু বুঝে উঠার আগেই পুথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর অমানিশা নেমে এলো ফাতিমা নামের স্বচ্ছ-পবিত্র এক নীলাকাশে। ফাতিমার চিৎকারে কেঁপে উঠলো মাদ্রাসার পবিত্র নামাজ ঘর, বারান্দা, মাঠ। কেপে উঠলো বেঞ্চের উপর খোলা পড়ে থাকা আয়তাল কুরসীন প্রতিটি আয়াত-শব্দ-হরফ।
সাত.
অন্ধকারের মধ্যে উঠোনের পাশে বেড়া ধরে দাড়িয়ে কাতরাচ্ছে ফাতিমা। ভাঙা গলায় মা....মা বলে ডাকছে। কুলসুম বেগম পড়ি মরি করে আসলো মেয়ের কাছে।
- কি হইছে ? কি হইছে, মা ? তুই একা কেন ? তোর বাপ কই ? উনারে তো পাঠাইছিলাম তোরে আনতে ? একা কেন ?
মা..মা..মা বলে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল ফাতিমা।
আট.
মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে ফাতিমা। পাশেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে কুলসুম বেগম। কাঁদছে ছোট্ট মরিয়ম ও তার দাদা। আর ঘরের মধ্যে পায়েচারি করছে ফযর আলী।
একটু একটু করে চোখ খূলছে ফাতেমা। দু’চোখ গড়িয়ে পানি পড়ছে। কুলসুম বেগমের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মা.., আর কোনদিন পড়া ফাঁকি দিয়ে পুতুল খেলতে চাইবনা।’ ডুঁকরে কেঁদে উঠলেন কুলসুম বেগম।
- ফাতিমার বাপ, একটা ডাক্তার ডাকেন? মাইয়া তো মইরা যাবো!
- ফালতু কথা না কইয়া,আল্লাহর নাম ডাকো। তিনি চাইলে ভালো কইরা দেবেনে।
ফাতিমা এবার মরিয়মের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘জয়ীতাকে বলে দিস, ওর পুতুলের সাথে আমার পুতুলের আর বিয়ে হবেনা। আমাকে যেন মাফ করে দেয়।’ আর দাদা, তুমি অনেক ভালো। মাজেদ আলী দ্রুত উঠে দাড়ালেন। ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ফযর তোর আর কোন কথাই আমি শুনব না। থাক তুই তোর মান-সম্মান সমাজ নিয়ে। আমি গেলাম ডাক্তার আনতে।
ফাতেমার চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। ঝাপসা চোখে ফাতিমা প্রথমে দেখলো কোরআনের আয়াত, তারই ভেতর থেকে ঝাকে ঝাকে উড়ে যাচ্ছে রঙিন কাগজের প্রজাপতি। কানে কেবলই বাজছে আয়তাল কুরসির আয়াত...সুর ।
জোরে কেঁদে উঠলো কুলসুণ ও মরিয়ম।
কিছুক্ষণ পর চারদিক থেকে আযান ভেসে আসে। কান্না-আহাযারিতে ভারি হয়ে উঠে ভোরের বাতাস!!!
নয়.
(দুই মাস পর)
দাদার হাত ধরে গ্রামের হাটে যাচ্ছে মরিয়ম। উল্টো দিক থেকে আসছে ইমরান হুজুর। মুখোমুখি হতেই দাড়িয়ে গেল ইমরান হুজুর।
- মাজিদ সাহেব কই যান? আপনার নাতনী তো গায়ে-পায়ে বেশ বড় হইছে? তারে মাদ্রসায় পাঠান।
কোন কথা বললেন না মাজেদ। পাশ দিয়েই স্কুল থেকে যাচ্ছিল জয়ীতা। মাজিদ আলী ডাক দিলেন। মাথায় হাত রেখে বললেন
- দাদু, ফাতেমার বোন শুধু ফাতেমার বোন না, তোমারও বোন। কালই মরিয়মকে তোমার স্কুলে ভর্তি কইরে দিবা। ধর্মীয় শিক্ষা দেবো, তবে এবার আর ম্রাাসায় নয়, আমি নিজেই দেবো।
জয়ীতা মাথা তুলে তাকালো, মরিয়মের মাথায় হাত রেখে বললো ‘আচ্ছা দাদু’।
মুখ বিক্রিত করে বিড়বিড় করতে করতে চলে গেল ইমরান হুজুর।