প্রাচীন যুগ থেকে বলা হয় ‘সেই শহরে বসবাস করা নিশ্চয় বুদ্ধিমানের কাজ নয়, যে শহরে কিনা একজনও আইনজীবী নেই।’ আইন পেশা হচ্ছে পৃথিবীর সব অভিজাত পেশার অন্যতম। আর এ অভিজাত পেশার মানুষগুলোর নামের আগে ‘বিজ্ঞ’ শব্দটি ব্যবহার করতে হয়। অর্থাৎ ‘বিজ্ঞ আইনজীবী’ বলার মাধ্যমে এ পেশার আভিজাত্যকে ফুটিয়ে তোলা হয় নিপুণ সৌন্দর্যে।
বাংলাদেশে যতগুলো আত্মনির্ভরকেন্দ্রিক পেশা রয়েছে তার মধ্যে আইন পেশা হল সবার পরিচিত একটি গুরুত্বপূর্ণ পেশা। এ পেশায় এসে আপনি যেমন অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারবেন, তেমনি সমাজে সবার কাছে নিজেকে উপস্থাপন করার সুযোগ পাবেন। আপনিও পারেন আইন পেশায় এসে সফল ক্যারিয়ার গড়তে। সে জন্য কি কি করতে হবে কোথায় ভর্তি হবে এবং এ পেশায় আর্থিক সুবিধা কি?এ নিয়ে আলোচনা করতেছি:-
সবাই স্বপ্ন দেখে বড় হয়ে একটি সন্মানজনক পেশায় নিজেকে নিয়োজিত করে ক্যারিয়ারকে উজ্জল করবে। মানুষ ভেদে স্বপ্নও থাকে আলাদা আলাদা। তদুপরি যতোগুলো সন্মানজনক পেশা আছে তার মধ্যে আইজীবী হলো একটি ।
দেশে আইন বিষয়ে উচ্চশিক্ষা নেওয়ার অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। চাহিদার কারণে আইন শিক্ষার বিস্তার ঘটছে ক্রমাগতভাবে। আমাদের দেশে সর্বপ্রথম আইন বিষয়ে কোর্স চালু হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, ১৯২১ সালে। বর্তমানে বেশ কয়েকটি সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাধীন ল কলেজে আইন বিষয়ে পড়ার সুযোগ আছে।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পড়ার সুযোগ রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরন বিশ্ববিদ্যালয়,রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: দেশের সর্ববৃহৎ এ বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে আপনি এলএলবি (সম্মান), এলএলএম, এমফিল ও পিএইচডি ডিগ্রি নিতে পারবেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯২১ সালেই। প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত এখানে দুই বছর মেয়াদি কোর্স চালু ছিল। পরে ১৯৭৩-৭৪ শিক্ষাবর্ষে শুরু হয় তিন বছর মেয়াদি এলএলবি (সম্মান) কোর্সটি। ১৯৭৭-৭৮ শিক্ষাবর্ষ থেকে চার বছর মেয়াদি কোর্স চালু করা হয়। প্রতিবছর ১৫০ জন করে শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পান। ২০০৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের সিলেবাসের আধুনিকায়ন করা হয়। বর্তমানে এর শিক্ষার্থীদের মোট ২২৫০ নম্বরের ওপর লিখিত পরীক্ষা এবং ১০০ নম্বরের ভাইভা দিতে হয়।
সনদ পরীক্ষা: পড়াশোনা শেষে আইন পেশায় নিয়োজিত হওয়ার জন্য বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের অ্যাডভোকেট এনরোলমেন্ট সনদ পরীক্ষায় পাস করতে হয়। পরীক্ষার সিলেবাস পাওয়া যাবে বার কাউন্সিলের ওয়েবসাইটে। এ বিষয়ে তথ্য পাওয়া যাবে বার কাউন্সিলে। ঠিকানা: বার কাউন্সিল ভবন, ৩ শহীদ ক্যাপ্টেন মনসুর আলী সরণি, শাহবাগ, ঢাকা।
কাজের ক্ষেত্র: বলাই বাহুল্য, আইন পেশায় এখন যোগ হয়েছে নতুন নতুন মাত্রা ও সম্ভাবনা। বিসিএস ও অন্য যে কোনো নন ক্যাডারের চাকরি, ব্যাংক, স্বায়ত্তশাসিত ও বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে চাকরির ক্ষেত্রে আইনের ছাত্রদের অন্য ব্যাকগ্রাউন্ডের শিক্ষার্থীদের মতো সমান সুযোগ আছে। তবে বিশেষ কিছু পেশা আছে যেখানে শুধু আইনের ছাত্ররাই কাজ করতে পারবেন, অন্যরা নয়। আইনজীবী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ ছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি-স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান, আন্তর্জাতিক সংস্থা, বিভিন্ন বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা, বিভিন্ন দেশের দূতাবাস, বহুজাতিক কোম্পানি ও এনজিওতে আছে আইন কর্মকর্তা বা প্যানেল আইনজীবী হিসেবে কাজ করার সুযোগ। রয়েছে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে নিম্ন আদালতে যোগ দেওয়ার সুযোগ। এছাড়াও সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে, আইন কলেজে আইন বিভাগের গ্রাজুয়েটদের শিক্ষকতার সুযোগ রয়েছে।
নিম্ন আদালতে প্র্যাকটিস: বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের অ্যাডভোকেট এনরোলমেন্ট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেই মিলবে সনদ এবং বারের সদস্য পদ। একজন আইনজীবী একই সঙ্গে দুটি বারের সদস্য হতে পারেন। সাধারণত একজন নবীন আইনজীবী সিনিয়র আইনজীবীর জুনিয়র হিসেবে কাজ শুরু করেন। পরে সিনিয়র হলে নিজে স্বাধীনভাবে নিম্ন আদালতে প্র্যাকটিস করতে পারেন। নিম্ন আদালতে অ্যাডভোকেটরা সাধারণত দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলা পরিচালনা করে থাকেন।
হাইকোর্ট বিভাগে প্র্যাকটিস: নিম্নআদালতে দুই বছর আইনজীবী হিসেবে কাজের অভিজ্ঞতা থাকলে হাইকোর্ট বিভাগে আইনজীবী হিসেবে অন্তর্ভুক্তির জন্য আবেদন করা যায়। হাইকোর্টে ১০ বছরের বেশি প্র্যাকটিস করছেন, এমন এক সিনিয়র আইনজীবীর সঙ্গে শিক্ষানবিশ চুক্তি করতে হয়। তবে বার-অ্যাট-ল’ বা এলএলএম পরীক্ষায় কমপক্ষে ৫০ শতাংশ নম্বর থাকলে এক বছর পরেই আবেদন করা যায়। এ প্রক্রিয়া অনেকটাই নিম্ন আদালতে অ্যাডভোকেট এনরোলমেন্ট পরীক্ষার মতো।
আপিল বিভাগে প্র্যাকটিস: একজন আইনজীবী হাইকোর্ট বিভাগে পাঁচ বছর প্র্যাকটিসের পর আপিল বিভাগে মামলা পরিচালনার জন্য আবেদন করতে পারেন। এক্ষেত্রে লাগবে ‘আপিল বিভাগে প্র্যাকটিসের যোগ্য’ এই মর্মে প্রধান বিচারপতি ও হাইকোর্টের বিচারপতিদের সংখ্যাগরিষ্ঠের দেওয়া প্রত্যয়ন। আর এটি পেলেই আপিল বিভাগে মামলা পরিচালনার যোগ্যতা অর্জন করেন একজন আইনজীবী।
দেওয়ানি মামলা: সম্পত্তির ওপর স্বত্ব ও দখলের অধিকার নিয়ে যে মামলা হয়, সেটাই দেওয়ানি মামলা। আদালতের ভাষায় এটিকে ‘মোকদ্দমা’ বলে। সব ধরনের দৃশ্যমান স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি এবং অদৃশ্য সব ধরনের অধিকারসংক্রান্ত মোকদ্দমা আইনজীবীরা জেলা জজ আদালতে পরিচালনা করেন। এ মামলা পরিচালনার জন্য ১৮৭৭ সালের সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইন, দেওয়ানি কার্যবিধি আইন, সাক্ষ্য আইনের বিভিন্ন ধারা সম্পর্কে ভালো দখল থাকতে হয়।
ফৌজদারি মামলা: চুরি, ডাকাতি, খুন, মারামারি, ধর্ষণ ইত্যাদি সংঘটিত অপরাধের বিচার ফৌজদারি মামলার আওতাধীন। এ মামলা আইনজীবীরা ফৌজদারি আদালতে পরিচালনা করে থাকেন। এ মামলা পরিচালনার জন্য ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধি, দণ্ডবিধি ও সাক্ষ্য আইনের বিভিন্ন ধারা সম্পর্কে ভালো জ্ঞান রাখতে হয়।
ইনকাম ট্যাক্স আইনজীবী: যারা আইন বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন, কিন্তু অ্যাডভোকেট না, তারাও চাইলে আয়কর আইনজীবী হিসেবে প্র্যাকটিসের জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও ট্যাক্স বারের সদস্য পদের জন্য আবেদন করতে পারবেন। বাণিজ্য বিভাগে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীরাও আয়কর আইনজীবী হওয়ার জন্য এনবিআরে আবেদন করতে পারেন। একই সঙ্গে তাদের ট্যাক্স বারের সদস্য হতে হয়। অ্যাডভোকেট এনরোলমেন্ট পরীক্ষায় উত্তীর্ণের পর ট্যাক্স বারের সদস্য হতে হবে। আবেদন করতে হবে নির্ধারিত ফরমে। আয়কর আইনজীবীরা আয়কর, সম্পদ, আমদানি শুল্ক, আবগারি শুল্ক ইত্যাদি বিষয়ে মামলা পরিচালনা করেন। তাদের আয়কর অধ্যাদেশ, ইনকাম ট্যাক্স রিটার্ন, সম্পদ বিবরণী ইত্যাদি বিষয়ে ভালো জ্ঞান রাখতে হয়।
করপোরেট ল’ প্র্যাকটিস অ্যান্ড লিটিগেশন: যিনি করপোরেশন আইনে বিশেষ জ্ঞান রাখেন, তিনি করপোরেট আইনজীবী। করপোরেট খাতে আইনজীবীদের কাজের ক্ষেত্র দিন দিন বাড়ছে। করপোরেট আইনজীবী হতে হলে কন্ট্রাক্ট ল, কোম্পানি রেজিস্ট্রেশন, ট্রেড লাইসেন্স, ট্যাক্স ল, অ্যাকাউন্টিং, সিকিউরিটি ল, দেউলিয়া আইন, মেধাস্বত্ব আইন সম্পর্কে ভালো জ্ঞান থাকতে হবে। আইন বিষয়ে পড়েও বা অ্যাডভোকেট হয়েও কোর্টে প্র্যাকটিস করতে না চাইলে বিভিন্ন ল’ ফার্মে কাজের সুযোগ পেতে পারেন। ল’ ফার্মগুলোয় বিভিন্ন কোম্পানির ডকুমেন্টেশন প্রস্তুত, লিগ্যাল অ্যাডভাইস দেওয়া, ফাইল তৈরি, মামলার ড্রাফট তৈরির কাজ করতে পারেন।
মানসিক প্রস্তুতিই হচ্ছে আইন পেশার প্রধান হাতিয়ার। আইন পেশার শুরুটা একটু চ্যালেঞ্জের, একটু দুর্গম। তাই শুরু থেকে কঠিন পরিশ্রম, প্রত্যয় এবং একাগ্রতা নিয়ে কাজ করার প্রস্তুতি নিতে হবে। তা ছাড়া এখানে রাজ্যের ধৈর্য নিয়ে আপনাকে বিচারপ্রার্থীর সমস্যার কথা মন দিয়ে শোনার মানসিকতা রাখতে হবে। এ পেশার শুরুটা হয় একজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবীর সঙ্গে কাজ দিয়ে। প্রথমে আয়-রোজগারের দিকে না তাকিয়ে কাজের প্রতি মনোযোগী হওয়া বাঞ্ছনীয়। একাডেমিক ফলের চেয়ে আইন পেশায় পেশাজীবনের মেধা, আইন সম্পর্কে খুটিনাটি জানাশোনা, পরিচিত, পরিশ্রম ও ধৈর্যই এনে দেবে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। এই পেশার চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনাকে উপলব্ধি করেই এগিয়ে যেতে হবে আগামীর সাফল্য পেতে।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই অক্টোবর, ২০১৭ সকাল ১১:০৭