গতকালকের পুরোটা দিন কাটিয়েছি “প্রাকৃতিক কৃষি” আন্দোলনের প্রধান কাণ্ডারি দেলোয়ার জাহান ভাইয়ের সাথে । মানিকগঞ্জ এর বানিয়াজুড়িতে নেমে রিকশাতে গেলে মাত্র দশ মিনিটের পথ। রিকশা থেকে নেমে কুয়াশাঘেরা পথে ঘাসের উপর জমে থাকা হালকা হালকা শিশির মাড়িয়ে হেটেঁ চললাম ভাইয়ের সেই কৃষি খামারের দিকে।
যখন পেীছুলাম তখন সকাল ৯টা । আমাকে রিসিভ করলেন টুটুল ভাই। তিনিও এই প্রাকৃতিক কৃষি আন্দোলনের সাথে যুক্ত বেশ আগে থেকেই। বাশঁ কাঠের সম্বন্বয়ে তৈরি সুন্দর একটি দোতলা বাড়ি। দোতলায় গিয়েই দেখলাম, মাত্র খাওয়া শুরু করেছেন দেলোয়ার ভাই।যাওয়া মাত্রই তিনি বললেন, “ আসেন খাওয়া দাওয়া করি। ব্যাগটা রেখে, ফ্রেশ হয়ে, বসে যান ভাই।” ঢাকা থেকে যে আমি যে নাস্তা করেই বের হয়েছি, সেটা তিনি মানতেই চাইলেন না। টুটুল ভাইয়ের সাথে কথা হচ্ছিলো তখন, তাকে এখনি আবার “প্রাকৃতিক কৃষি বিপনন কেন্দ্রে” চলে যেতে হবে। তিনি বিদায় নিলেন। কিছুক্ষনের মধ্যই, খাবার চলে আসলো। তবে, মেন্যুতে মাছ থাকায় সেটা অগত্যা তাকে রান্না ঘরেই পাঠিয়ে দিতে হলো। তারপর , ভাই, কলা নিয়ে আসতে বললেন ।
আমরা দুইজন তখন কলা খাচ্ছি আর কথা বলছি। কলাটা খেতে খেতে আমার মনে হলো , গত ১০ বছরের ভেতর আমি এমন সুস্বাদু কলা খাই নি।( উল্লেখ্য, আমার নিজস্ব তত্ত্বাবধানে বাড়ির বাগানে গড়ে ওঠা সার ও কীটনাশক বিহীন ফল ও শাক সবজির চাষ ২০০৮ সাল পর্যন্ত চলমান থেকেছে।) কলা খেতে খেতেই উনি জিজ্ঞেস করলেন আমি কেনো এসেছি , সার ও কীটনাশক মুক্ত চাষাবাদের আগ্রহ থেকেই এসেছি সেটা বলতেই তিনি, একে একে জানাতে থাকলেন , এই পথ কতটা কঠিন।
নিশ্চয়ই কঠিন। কতটা নিষ্ঠার সাথে এগিয়ে গেলে আবারো সেই ”বহুবছরের পুরোনো আমাদের কৃষি” কে কৃষকের আওতায় নিয়ে আসা সম্ভব?। সেটা তো অবশ্যই কঠিন কাজ । কৃষিকে নিয়ে ভিন্নমাতৃক প্রতারনার ফাদেঁ আটকেঁ ফেলা বিভিন্ন বহুজাতিক কম্পানি গুলো’র কথা না বললেই নয়। কিভাবে তারা সাধারন কৃষককে ভুল বুঝিয়ে তাদের তৈরি সার,বীজ ও কীটনাশকি এর চাহিদা সৃৃষ্টি করে ফেলেছে, আর সেই তৈরি হয়ে যাওয়া চাহিদার দরুণ প্রতিবছর তারা হাতিয়ে নিয়ে যাচ্ছে কোটি কোটি টাকা । কিভাবে হা্ইব্রিড উত্তেজনার জ্বরে কাপছে গোটা কৃষি, কৃষক এমনকি ’কৃষি পন্ডিত’ সমাজ, সেটাও “কৃষি নিয়ে রাজনীতি”র অর্ন্তগত । যার ফলে, একদিকে যেমন সর্বশান্ত হচ্ছে কৃষিব্যবস্থা তার পুরোনো ঐতিহ্য হারিয়ে, তেমনিভাবে সর্বশান্ত হচ্ছে কৃষক তার ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত হয়ে। তারা হারিয়ে ফেলেছে তাদের তিল তিল করে সংরক্ষিত বিভিন্ন দেশীয় ফসলের বীজগুলো । মহাজনের মতো, ফাদঁ পেতে রাখা কম্পানিগুলোর কাছেই যাদুর কাঠি ছু্ইঁয়ে রাখা হাইব্রিড বীজ পাবার জন্য হুমড়ি খেযে পড়তে হয় অনেকটা বাধ্য হয়েই। ফলশ্রুতিতে, তারা বীজের সাথে আত্মিক বন্ধনও তৈরি হবার সুযোগ পায় না। আর এভাবেই তারা বিকলাঙ্গ হবার পাশাপাশি সাধারন মানুষও শারীরিক, মানসিক ও আত্মিক বিভিন্ন সংকটে পড়ছে।
দেলোয়ার জাহান ভাই কৃষি, কৃষক, মাটি ও মানুষকে ঐ সমস্ত চক্রান্তের হাত থেকে বাচিঁয়ে আমাদের হাজার বছরের পুরোনো নিজস্বতাকে ফিরিয়ে আনার আন্দালন করে চলেছেন। এ আন্দোলন কাগজ- কলম কিংবা শুধু গলাবাজিঁর আন্দোলন নয়, এটাই কর্মোদীপ্ত সরব আন্দোলন। যার সুফল পেয়ে চলেছে বাংলাদেশের অধিকাংশ আবাদী জমি, কৃষক সমাজ থেকে শুরু করে ভোক্তা পর্যন্ত। তার কার্যক্রম নিয়ে বেশ অনেকগুলি ফিচার, আর্টিকেল ও প্রতিবেদন আছে। আমি লিংক দিয়ে দেবো কয়েকটির, আশাকরি দেখে নিবেন। ১/ https://bit.ly/2F98XVq , ২/ https://bit.ly/2RHW1aq ৩/ https://bit.ly/2JPkjNe
আলোচনা শেষে তিনি ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকলাম পুরোটা খামার। কি নেই সেখানে?। ফুল, ফল, শাকসবজি, গবাদিপশু থেকে শুরু করে হরেক রকম ঔষধিগাছও। দেখতে দেখতে বেশ আনন্দিত হয়েই ভাইকে বললাম, “ভাই, তুলশী গাছে তো পুরো জায়গাটাই ছেয়ে ফেলেছেন”, তারপর উনিও হাসতে হাসতেই বললেন, “এখানে তো বেশি দিন আসা হয় নি। মাত্র ৩ মাস। আর কিছু দিন পর এসে দেখবেন, আসেপাশে তুলসী বন হয়ে গেছে।” । সেখানে অর্কিড ফুলের গাছগুলো দেখে একটু আশ্চর্যান্নিত হলাম, কেননা ওরা এতো প্রতিকুলপরিবেশে টিকে থেকেও যে এতো সুন্দর সুন্দর বাহারী ঢঙয়ের ফুল দিতে পারে,সেটা আগে জানা ছিলো না।আর, দোতলায় ওঠার সিড়িঁর সাথে মনোরম আবহ তৈরি করে চলেছে অপরাজিতা । ওর দিকে একবার তাকালে আর যেনো চোখ ফিরিয়ে নেওয়া যায় না। লালশাক, পুঁইশাক, কপি, শিম, আলু, পেয়াজ, রসুন, ধুঁন্দল, আঁদা, গাজর, বররটি, পেঁপে আরো কত দেশীয় ফলমূল শাকসবজির চাষ । এছাড়া, গরু, মুরগি, কবুতর তো রয়েছেই।
দেখতে দেখতে ইতোমধ্যই দুপুর হয়ে গেছে। দেলোয়ার ভাই বললেন, “সোহেল ভাই, আপনি তো মাছ খান না, আপনার জন্য কি করতে পারি বলুন তো!” আমি বললাম, “শাক সবজিই যথেষ্ট আমার জন্য, ভাই। আমি এটাই সব থেকে বেশি পছন্দ করি” তারপর, আমি আর কাল ক্ষেপণ না করে চলে গেলাম ভাইয়ের খামারে। লালশাক দেখে তুলতে ইচ্ছে হলো । তুলে নিয়ে আসলাম খানিক। রান্না হলো । উফ! সেকি ! দেখে যা মনে হয়েছিলো, এগুলো তো তা নয় !, এতো স্বাদযুক্ত লালশাক! মনে হলো গত ১০ বছরের ভেতর খাওয়া হয়নি । আমি আরেকটু অবাক হয়েছি, রান্না হওয়া শাকের পরিমান দেখে। আমি যতটুকু তুলে এনেছিলাম ততটুকু রান্না হলে সচরাচর অনেক বেশিই কমে যাবার কথা ছিলো। কিন্তু, বিষ্ময়ের বিষয় হচ্ছে । এই লালশাক কমেইনি বলতে গেলে। গরম ভাতের সাথে লালশাক ও লেবু। স্বাদের দিক দিয়ে সেরা হবেই না বা কেনো , এর সব কিছুই “অরগানিক” উপায়ে চাষাবাদ করা। এখানে মাটির ভেতরের প্রয়োজনীয় অনুজীবগুলোকে যেমন বাচিঁয়ে তাকে তার নিজের মতো করে প্রকৃতিকে আগলে রাখার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। ঠিক একইভাবে, জীবজগতের প্রতিটি প্রাণ একে অপরের সাথে নিবিড় সম্পর্কের মাধ্যমে একটি অপরটিকে গতিশীল থাকার সুযোগ করে দিয়েছে। অর্থাৎ, পুরো বাস্তসংস্থানের নীতিকে এখানে খুব গভীরভাবে ফলো করা হয়।
তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “আমাদের মতো তরুনরা যদি নিজ উদ্যোগে আপনার মতো এই চ্যালেঞ্জ টা নিতে চাই, সেক্ষেত্রে কোন কোন দিকগুলোর দিকে নজর দিতে হবে?” তিনি বললেন, কৃষিকে মূলত সমাজের “অচ্ছুত” ধারনার কারনে শিক্ষিত তরুদের কাছ থেকে দুরে রাখা হয়েছে। এ জন্য, সাধারন তরুনদের থেকে শিক্ষিত তরুনদের চ্যালেঞ্জটা বেশি। তবে, সে যদি প্রাকৃতিক কৃষি বিষয়ে কর্মশালা করে, “অর্গানিক চাষাবাদ পদ্ধতি” শিখে নিয়ে সমাজের মানুষের ‘তথাকথিত শিক্ষিত’ মনোভাব পাল্টে দিয়ে গণমানুষের জন্য কাজ করতে ব্রতী হন,তাহলে সে নিশ্চয় ভালো করবে, এবং সেই একনিষ্ঠ তরুণ তরুনীদের জন্য আমাদের দুয়ার সব সময় খোলা।” তিনি আরো বললেন, আমরা প্রতি মাসেই গ্রামের কৃষককে উদ্বুদ্ধ করার জন্য প্রাকৃতিক কৃষি বিষয়ক ৩ দিনের কর্মশালা করি, যার ফলে দিনে দিনেই আমাদের “প্রকিৃতিক কৃষি খামারী”দের সংখ্যা বাড়ছে। এবং, আস্তে আস্তে আরো বাড়বে বলে আমাদের বিশ্বাস, সে লক্ষ্যেই আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। সব মিলিয়ে সুন্দর একটি দিন কাটালাম দেলোয়ার জাহান ভাইয়ের সাথে। ভাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানায়, যথেষ্ট আন্তরিকতার সাথে উনার মূল্যবান সময় দেবার জন্য।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই নভেম্বর, ২০১৮ বিকাল ৫:৫২