আমরা অনেকেই গ্রামকে নিয়ে আবেগময় চিত্রকল্প আঁকতে পছন্দ করি। আনমনে ভাবি, গ্রামে থাকবে ছায়া ঘেরা পাখি ডাকা সুবিশাল বাগান, প্রশস্ত বাড়ির রাস্তা, বড় পুকুর, বিশাল খোলা মাঠ। কিন্তু একটি বিষয় আমাদের স্বরণে থাকে না যে, মুনাফা সর্বোচ্চকরণের লক্ষ্য গ্রাম পর্যায়েও পঁজিপতিদের যত্র তত্র বিনিয়োগ গ্রামকে অশান্ত করে তুলছে। এর ফলে গ্রাম সেই আগের অবস্থানে থাকছে না , হয়ে পড়ছে বিক্ষিপ্ত ও অমার্জিত। বিশেষ কওে, ড্রেজার দিয়ে বালু তুলে নদী ধ্বংস গ্রামে এখন নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে। কবি বন্দে আলি মিঞা যে গ্রামের চিত্র একেছিলেন, তা একটি অলীক চিত্র হয়ে যেতে বসেছে। তিনি বলেছিলেন, “আমাদের ছোটো গ্রাম মায়ের সমান/আলো দিয়ে বায়ু দিয়ে বাঁচাইছে প্রাণ। মাঠভরা ধান আর জলভরা দিঘি/চাঁদের কিরণ লেগে করে ঝিকিমিকি”।
সম্প্রতি চিকিৎসকদের প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একটি ঘোষণা দিয়েছেন, বলেছেন, “গ্রামে থাকতে ভালো না লাগলে চাকরি ছেড়ে দিন”, যেটা নিঃসন্দেহে গ্রামে সুযোগ সুবিধার অপ্রতুলতাকেই ইঙ্গিত করে। মূলত সেই কারণেই ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী, চিন্তাবিদসহ সুশীল সমাজের অধিকাংশই গ্রামে থাকতে চান না। যার ফলে, একদিকে গ্রাম হারাচ্ছে তার গর্ভে জন্ম নেয়া একেকটি রত্ন;
অপরদিকে তাদের শহরমুখীতা সুযোগ করে দিচ্ছে নেতৃত্বের অনুপযোগী কিছু মাস্তান, হঠকারী ও দুর্নীতিবাজদের। আবার, গ্রামের অসাধু চেয়ারম্যান, মেম্বারসহ মোড়লরা যেভাবে সরকারী বরাদ্দকৃত অর্থ আত্মসাৎ করে চলেছে ,তাতে গ্রামের প্রকৃত উন্নয়ন বার বার বাঁধাগ্রস্থ হচ্ছে। গ্রামের তরুণরা হয়ে পড়ছে নেশাগ্রস্থ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, “অযোগ্য নেতৃত্ব, নীতিহীন নেতা ও কাপুরুষ ও রাজনীতিবিদদের সাথে কোনোদিন এক সাথে এক দেশের কাজে নামতে নেই। তাতে দেশসেবার চেয়ে দেশের ও জনগণের সর্বনাশই বেশি হয়।” এই সমস্ত অযোগ্য নীতিহীন নেতার দৌরাত্ম্য গ্রাম হারাচ্ছে সুশীল সমাজের মত যোগ্য নেতৃত্ব।
আমরা দেখতে পাচ্ছি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বর্তমান ¯্রােতের মুখে সেই দেশই শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত দিক দিয়ে উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে, যাদের গ্রাম অর্থাত তৃণমূল পর্যায় থেকেই দীর্ঘমেয়াদী নিখুঁত পরিকল্পনার বা¯তবায়ন রয়েছে। যেহেতু বাংলাদেশ ২০২১ ও ২০৪১-এর ভিশন নিয়ে বাংলাদেশ ডিজিটালাইজেশনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সেহেতু, বিজ্ঞান কিংবা প্রযুক্তি সব কিছুতেই দরকার দীর্ঘমেয়াদী নিখুঁত পরিকল্পনার সুস্টু বা¯তবায়ন। কেননা কোন যন্ত্রের ব্যবহারে কি ধরনের উপকারিতা কিংবা কি ধরনের ক্ষতি রয়েছে সে সম্পর্কে সচেতন করা না গেলে এই প্রযুক্তিই অসংখ্য তরুণ-তরুণীকে মানসিক বিকারাগ্রস্ততার দিকে ঠেলে দিবে। সময়ের একটু আধটু ব্যবধানে তারা ছড়িয়ে পড়বে দেশের আনাচে কানাচে। তৈরি করবে অসুস্থ-ভঙ্গুর একটি জাতি।সর্বোপরি জন্ম থেকেই যে শিশুটি অশিক্ষা, কুশিক্ষাসহ অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে বড় হবে, পরবর্তীতে তার কাছে থেকে নৈতিক কিছু আশা করাটাও নির্যাতনের শামিল।
আমরা অনেকেই জানি, সরকারি হিসেবে বর্তমান মাথাপিছু আয় ১৬১০ মার্কিন ডলার। সেদিক দিয়েও বলা যায় মানুষ আগের তুলনায় যথেষ্ট সচ্ছল। মানুষের এই উপার্জন যত বাড়ছে ততই মানুষ স্বাবলম্বী হবার সাথে সাথে একে অন্যর প্রতি পারস্পারিক শ্রদ্ধা বোধ হারিয়ে ফেলছে। আর এভাবেই গ্রামেও চলছে এককেন্দ্রিকতার হিড়িক। যার যার সাধ্যমত আলাদা হয়ে যত্র তত্র তৈরি করছে বাড়ি, দোকানপাট এমনকি কলকারখানা। যার ফলে, গ্রাম হারাচ্ছে তার সবুজের সমারোহ ও সম্প্রিতির বন্ধন। সেই সাথে দেশ হারাচ্ছে বিপুল পরিমাণ কৃষি জমি। গত এক দশকে প্রতি বছরে দেশে ফসলি জমির পরিমাণ ৬৮ হাজার ৭০০ হেক্টর করে কমছে, যা দেশের মোট ফসলি জমির শূন্য দশমিক ৭৩৮ শতাংশ। অথচ তার আগের তিন দশকে প্রতি বছর ফসলি জমি কমেছে মাত্র ১৩ হাজার ৪১২ হেক্টর। যেহেতেু দেশের শতকরা ৭০ ভাগ লোক প্রত্যক্ষভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল আবার, বাংলাদেশের জিডিপিতে এ বছর কৃষিখাতের অবদান ১৪.৭৫%। সুতরাং এভাবে চলতে থাকলে, আমদানি নির্ভরতার সাথে সাথে বাংলাদেশ ব্যাপক পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে পড়বে।
প্রাইসওয়াটারহাউস কুপারের হিসেব অনুযায়ী ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশ পৃথিবীর ২৩ তম বৃহৎ অর্থনীতিতে পরিণত হবে। মোট অর্থনীতির আকার দাঁড়াবে ৩০৬৪ বিলিয়ন ডলার। এ বৃহৎ অর্থনীতিতে কৃষি খাতের অবদান মোটেই কম নয়। কিন্তু পণ্য বাজারজাতকরন নীতিমালা ও সরকারী এন্টি- ডাম্পিং পলিসি থাকলেও এর দৃঢ় কোন প্রয়োগ নেই। ফলে, দেশের আলু চাষি সহ বিভিন্ন চাষীরা তাদের উৎপাদিত পণ্যর কাঙ্খিত মূল্য না পেয়ে কৃষির প্রতি করুণভাবে নিরুৎসাহিত হচ্ছে। পরবর্তীতে তারা শহরমুখী হচ্ছে নইতো কল-কারখানা প্রতি ঝুঁকছে। বাংলাদেশের কৃষি ও কৃষককে নিয়ে বিদেশী পণ্য ডাম্পিং এর মত চক্রান্ত অব্যাহত থাকলে ব্যাপক হুমকির মুখে পড়বে বাংলাদেশের কৃষি। সেই জন্য দরকার স্ট্রিক্ট এন্টি ডাম্পিং পলিসির সাথে নিখুঁত বাজারজাত করন নীতিমালার প্রয়োগ। যার ফলে কৃষক থেকে ভোক্তা পর্যন্ত সবাই লাভবান হবে ।
এই সকল কিছুর জন্যই দরকার যথেষ্ট গ্রামীণ সন্নিবেশায়ণ পরিকল্পনা ও গ্রামকে জণ্জাল মুক্ত করে দেশের সর্বস্তরে গ্রমায়ণ আন্দোলন গড়ে তোলা। আবার এই বৃহৎ অথনৈতিক উনয়ন্নয়ের জোয়ারকে ঠিকমত এগিয়ে নিতে হলে শহরের কর্মক্ষেত্র, কার্যালয় কিংবা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিকেন্দ্রীকরণ জরুরী হয়ে পড়েছে। সবগুলোরই বিকেন্দ্রীকরণের জন্য গ্রামকে বেছে নেওয়া যেতে পারে। এটা করা গেলে একদিকে যেমন গ্রামকে বর্তমান অব্যবস্থাপনার হাত থেকে রক্ষা করা যাবে, অপরদিকে, শহরে ঝোঁকা একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে গ্রামমুখী করা যাবে। কাঠামো পর্যায়ে শৌল্পিক প্রয়োগ এর ক্ষেত্রে প্রথমে বিশ্লেষণ করে দেখা যেতে পারে বিশ্বের নামী দামী শহর গুলোর নগরায়ন কাঠামো। সেই সাথে আমাদের দেশীয় নৃতাত্বিক, ভৌগলিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে বিচার বিশ্লেষণ করে পরিকল্পনা করা সমীচীন হবে। যেহেতু জনসংখ্যার তুলনায় যাইগা পর্যাপ্ত নয়, তাই, পরিবেশ বান্ধব বহুতল ভবনের নগরসদৃশ নকশা করা যেতে পারে। অবশ্যই সেটা হতে হবে পরিবেশবান্ধব।
কোন ক্রমেই ১ তলা কিংবা দোতলা পাকা ভবন নির্মাণের অনুমতি দেয়া উচিত হবে না। সব ভবন হতে হবে, ৫ তলা উপরে। এ আর্থিক ভাবে অসচ্ছল হলে, প্রয়োজনে ১০ জন মিলে একটি ভবন নির্মাণ করবে।এতে করে একে অন্যর প্রতি সোহাদ্রবোধ বাড়বে। মসজিদ, মাদরাসা, বাজার, কারখানা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জায়গার অনুপাত অনুযায়ী গড়ে তোলা কিংবা প্রতিস্থাপন করা যেতে পারে। তবে, ঘন ঘন ব্যবসায়িক স্বার্থে যেন প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে না পরে সেদিকেও নিখুঁত দৃষ্টি রাখতে হবে। সুষ্ঠু কাঠামোর সাথে রাস্তার সংস্কার হতে হবে সর্বপ্রথমে। যে স্থানে যে ধরনের ফসল ভালো হয়, ঐ স্থানে সে ধরনের কৃষিবিদ নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। যেখানে, মানসিক রোগীর কিংবা বিকারাগ্রস্থ রোগীর পরিমান বেশি সেখানে মানসিক পরামর্শের জন্য মনোরোগ বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। বিশেষ করে কুসংস্কারাছন্ন এলাকাই বেশি বেশি বিনামূল্য বিজ্ঞান বিষয়ক র্কমশালা করা যেতে পারে। যার ফলে কুসংস্কার নিয়ন্ত্রনে আসবে।
বিশেষ করে, বর্তমান গ্রাম পর্যায়ে যে তিন স্তর (ইউনিয়ন পরিষদ ও উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ) বিশিষ্ট স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা চালু আছে, সেখানে চেয়ারম্যান ও মেম্বার সহ প্রত্যেকেরই নির্বাচনে মনোনয়ন পাবার পূর্ব শর্ত হিসাবে স্নাতক পাশ নিয়ম করা যেতে পারে। তারা যেহেতু জনগনকে নেতৃত্বদানকারী গুরুত্বর্পুণ পদের প্রার্থী সেহেতু প্রত্যেকের মানসিক দখ্খতা যাচায়ের জন্য একটি পরিক্খার মধ্য দিয়ে উর্ত্তীণ করার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ৪৩টি মন্ত্রণালয়ের একাটি গুরুত্বপূর্র্ণ মন্ত্রণালয় হলো পরিকল্পনা মন্ত্রনালয়। এ ক্ষেত্রে এই মন্ত্রনালয়ের ভূমিকা সবার শীর্ষে থাকলেও মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও আমলা সহ সরকারের সর্বস্তরের গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারকগণ এই পরিকল্পনায় অংশ নিতে পারেন। তাতে যোগ দিতে পারেন সুশীল সমাজের গণ্যমান্য ব্যাক্তিবর্গ।
শেষে একটি কথা না বললেই নয়, শহরকেন্দ্রিক যতই পরিকল্পিত উন্নয়ন করার চেষ্টা হোক না কেনো, গ্রামকে পশ্চাতে রেখে কখনোই একটি সুশৃঙ্খল, দুর্নীতিমুক্ত ও প্রগতিশীল জাতি গড়ে তোলা সম্ভব নয়। কেননা গ্রামই হচ্ছে সকল সংস্কৃতির বীজতলা। এ জন্য গ্রাম পর্যায়ে যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে তুলতে যেমন সুশীল সমাজকে গ্রামমুখী হবার সুযোগ তৈরি করা জরুরী, তেমনিভাবে বর্তমান নগরায়নের বীভৎস চিত্রের পুনরাবৃত্তি দূরীকরণেও গ্রামকে জন্জালমুক্ত করতে হবে। এর জন্য দরকার সুষ্ঠু সরকারী নীতিমালা ও এর যথাযথ বাস্তবায়ন। যার মাধ্যমে, বসবাসের জন্য শোল্লাসে দেশের শিক্ষিত তরুণ তরুণীসহ চিকিৎসক, সংগঠক ও বুদ্ধিজীবীগণ গ্রামকেই বেছে নিতে চাইবে। ফলশ্রুতিতে গ্রাম নতুন করে জেগে উঠবে।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই মার্চ, ২০১৮ দুপুর ২:১৮