রামগোলাম হরিশংকর জলদাসের একটি অনন্য রচনা। এতে যেমন রয়েছে ঐতিহাসিক শৃঙ্খলে বাধা পড়া মানুষের তীব্র আকুতি মিনতি । তেমতি আছে আন্দলনের তীব্রতা। এ উপন্যাসে জলদাস দেখিয়েছেন, কিভাবে ক্ষমতাবান শ্রেণী ক্ষমতার অপব্যবহার করে ইতিহাসকে ভিন্ন পথে চালিত করে। কিভাবে ন্যায্য অধিকারকে কেড়ে নিয়ে সাধারণ মানুষদের সর্বস্বান্ত করে। রামগোলামের মত আর কেউ যাতে হরিজনদের অধিকার আদায়ের মূল হোতা হয়ে উঠতে না পারে তার সমস্ত পরিকল্পিত ফাঁদ রচনা করে যান এই উপন্যাসেরই আরেক চরিত্র আব্দুস ছালামের মত অমানুষরা । যাদের শিক্ষিত চামড়ার খোলসে লুকিয়ে আছে এক একটি ভয়াবহ অত্যাচারী মনোভাব সম্পন্ন সত্ত্বা।
বাস্তবতার নিরিখে সাজানো উপন্যাসের এই ঘটনা প্রবাহের সাথে তুলনামূলক সম্পর্ক স্থাপন করা যায় পৃথিবীর অসংখ্য ধর্ম, বর্ণ ও আধিপত্যবাদী গোষ্ঠীর সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার কূটকৌশল সম্বন্ধীয় ঘটনা গুলোর সাথে। আধিপত্যবাদী সমাজে আধিপত্যেকে টিকিয়ে রাখার নিমিত্তে তৈরি হয় নিত্য নতুন রাজনীতি। সেই রাজনীতির বলী হয় সাধারণ সম্প্রদায়। যারা দুবেলা দুমুঠো অন্ন সংস্থানের জন্য নিরন্তর ছুটে চলে। “রাজকাহিনী” তে বীরত্বপূর্ণ “রাণী মা” যেমন দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে হয়ে উঠে মহা প্রলয় । যার পরিণাম যেমন দেখা যায় বীর দর্পে আত্মাহুতি। ঠিক তেমনি ভাবে এমন অসংখ্য সম্প্রদায় তার স্থিত অবস্থাকেই স্বাধীনতা ও মুক্তির পথ বলে ভাবেন , সেখান থেকে বিতাড়ন যেমন তাদেরকে নতুন ইতিহাস সৃষ্টিতে উদ্বুদ্ধ করা নয় , বরং ঠেলে দেওয়া এক মহা অনিশ্চয়তার মাঝে যেখান থেকে হয়তো আদৌ মুক্তি সম্ভব নয়। সেই অনিশ্চয়তার বিরুদ্ধে রুখে দাড়নোর জন্য তারাও প্রতিবাদী ঝাণ্ডা বয়ে বেড়ায়। সুজোগ হয়তো তাদেরও আসবে । রামগোলাম কার্তিককে ফিরে পেলে আবার হইতো নতুন উদ্যেম ফিরে পাবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এমন কারো সংস্পর্শ পেয়েছিলো বলেই আন্দোলনের তীব্রতা আরো ঘনীভূত হতে পেরেছিলো। এসেছিলো কালজয়ী ১৯৭১।
আমরা কি মিলিয়ে নিতে পারি না ? অসংখ্য রামগোলামদের সমন্বয়ে গঠিত সুন্দরবনের পাশে বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণে বাঁধা প্রদানকারী আন্দোলনএর ঘটনাগুলোর সাথে । উপন্যাসে হেডক্লার্কের মত কেউ যেমন বলছে, “ তোমাদের চাকরি নিশ্চিত। কারন, এ টাকার ভাগ উপর পর্যন্ত যাবে”। এই সুন্দরবন গল্পেও অসংখ্য হেডক্লার্কের আনাগোনা আছে নিশ্চয়। যার ফলশ্রুতিতেই হয়তো সমস্ত যুক্তিকে অগ্রায্য করে সরকার তার বেপরোয়া আধিপত্যেকেই টিকিয়ে রাখতে চাইছে। জনমনে থাকা ন্যায্যতার প্রকৃত হিস্যা হইতো একদিন বাস্তব হয়ে দেখা দিবে , কিন্তু ইতিহাস সেদিন ভুলে যাবে রামগোলামের মত বিপ্লবীবীরদের।
হরিশঙ্কর জলদাস আমাদের আসলে অনেক কিছুই ইঙ্গিত দিতে চান। এগুলোর মধ্য এমন হতে পারে, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট একটি মানুষকে যে কাজে পারদর্শী করিয়ে তোলে , তাকে সে অবস্থানে থাকতে দিলে সমাজ জাতী দেশ এমনকি পৃথিবীর উন্নয়ন বিরাজমান থাকবে সেই সাথে প্রাকৃতিক সমস্ত অবস্থার স্থিতাবস্থা প্রবাহমান থাকবে।
পৃথিবীতে এভাবেই হয়তো গুমরে গুমরে জ্বলতে জ্বলতে নিভে যায় হাজারো আর্তনাদের স্ফুলিঙ্গ । হয়তো আবার কোন এক সময় গোত্রে রামগোপালের মত কেউ জন্ম নিবে , সে আবার হরিজন মুক্তির আন্দোলনের অগ্রজ, কার্তিকের মত কারো সংস্পর্শ পেয়ে শক্তিতে উদ্বেল হবে। পালাবদল ঘটাতে চাইবে।গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বঅর্পিত অকর্মক মানুষ গুলোয় সমাজ ও জাতীকে টেনে নিচে নামানোর মূল হোতা। “বন্যেরা বনে সুন্দর শিশুরা মাতৃক্রোড়ে” এখানে প্রত্যেকটা প্রাণী, মানুষ এমনকি প্রত্যেকটি সমাজ সম্প্রদায় একই গুরুত্ব বহন করে এই প্রকৃতির বিচারালয়ে। ইতিহাস যেমন মুচি মেথরদের সেঁটে দেওয়া কাজকে তাদের বহুদিনের কসরতের ফলে জীবিকা নির্বাহের একমাত্র মাধ্যম হিসেবে নির্মাণ করেছে, তারা সেই বহুদিনের চেনা অঙ্গনকেই মূল হিসেবে ভাবতে শিখেছে , এখন এই দায় কে নেবে ?।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে মার্চ, ২০১৭ রাত ২:৫৬