মহান গুরু,
প্রণতি গ্রহন করবেন। আপনি কেমন আছেন জানতে চেয়ে বিব্রত করবোনা আপনাকে । জানি, খুব ভালো রাখা ও থাকার জন্য নিরন্তর পথ চলার অবিচল গতি আপনাকে করে তুলেছে প্রশান্ত। আজকে বড় লজ্জিত মস্তকে ক্ষমা চাইছি আপনার কাছে। নিজেকে বড় অদক্ষ আর অপরাধী মনে হচ্ছে। বরং তা হবার যথেষ্ট কারন রয়েছে। জীবনের জন্য, সমাজের জন্য ও পৃথিবীর জন্য কল্যাণকর পটভূমির বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার কোন কিছু বাদ ছিল বলে মনে হয় না । অনেক কিছুই তো ধরিয়ে দিয়েছিলেন, ধরাতে চেয়েছিলেন আরো অনেক কিছু । কিন্তু এ গাছ যে বড় মন্থর ! হতে পারতো অনেক। কিছুই কি হয়ে উঠেছে !। দায়িত্ব, যোগ্যতা, নতুনত্ব সবই তো রেখে দিয়েছি খোঁদায় করে । তবে এমন হচ্ছে কেন!
গুরু, প্রথম যেদিন অন্য অনেকের আগে হঠাত করেই দেখা হয়ে গিয়েছিল আপনার সঙ্গে । সেদিনের আলাপনের প্রত্যক টি কথা আমার মনে থরে থরে সাজানো আছে। মনে হলে মাঝেমাঝে একাএকাই হেঁসে উঠি। সেদিন আপনার সঙ্গে কথা হয়েছিল ঘন্টা খানেকের মত। নিজের পারদর্শিতা দেখানোর জন্য অবোধের মত গড়গড় করে ইংরেজি বলেছিলাম। ইতস্তত হয়ে আপনি তাও ইংরেজিতে ফিরে আসেননি। এখন ধরতে পারি, “পুঁজির বিকাশের মধ্য দিয়েই তার বিনাশ নিহিত” তা আপনি ভালো করেই বুঝেছিলেন। শিক্ষক যে এতোটা সময় ধরে ছাত্রের সাথে আলাপ আলোচনা করে, এর আগে আগে জানার সোভাজ্ঞ্য হয়েছিলো না আমার । তাই ভালো লাগা সত্ত্বেও হকচকিত হয়েই বলেছিলাম “ আজ তাহলে আসি স্যার”।
তারপর কতদিনই তো ঘন্টার পর ঘন্টা নষ্ট করেছি আপনার। এঁকের পর এক কথার ধারা বইতেই থাকতো। যতদিন গড়িয়েছে নতুন করে আবিষ্কার করেছি আপনাকে । আপনার অবলীলায় বলা গভীর গভীর কথাগুলো আমার কাছে খুব সাধারন আর যুক্তিযুক্ত মনে হলেও প্রচলিত বাস্তবতা ছিল এর তীব্র বিপক্ষে। আমি যতবার যতজনের কাছে কথাগুলো বল্বার চেষ্টা করেছি ততবারই তারা আমাকে ভিন্নভাবে নির্মাণ করার চেষ্টা করেছে। আমি থেমে থাকিনি। আমি নিরন্তর ছুটে চলেছি। কিন্তু আপনাকে আমি কিভাবে বলবো ! আমার ছুটে চলার গতি বড়ই মন্থর। আপনি যেই জ্বলজ্বলে সম্ভাবনা দেখেছিলেন আমার চোখে, তা এই ক্ষীণ আলোর আভায় কতটুকুইবা হবার মত ! আমি সন্ধিহান আমাকে নিয়ে। যতবারই আমার অস্তিত্তের বিমূর্ত রূপগুলো সবার কাছে মূর্ত করে তুলতে চেয়েছেন, ততবারই আমার বেড়ে যাওয়া দায়িত্তের ভার নিয়ে নিজেকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করেছি। তবে সেগুলো আমাকে যথেষ্ট সামনে এগিয়ে নিয়েছে, তা আমি লক্ষ্য করি।
আমি বিশ্বাস করি , প্রকৃত ভালোবাসার পূর্ণতা অবয়ব থেকে আসে না, তা প্রকাশ পায় ভালোবাসার বিষয় কিংবা ব্যক্তিকে নিরন্তর পরিচর্যার ভেতর দিয়ে পূর্ণতার ছোঁয়া লাগাবার নিঃস্বার্থ পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে। আপনি আমার প্রতি ঠিক সেটাই করেছিলেন, উজাড় করে দেবার নিমিত্তে পরিচর্যার মহান দায়ভার নিয়েছিলেন। নিঃস্বার্থ পরিচর্যার মাধ্যমে পরিপূর্ণ ও পরিস্ফুট গড়ে তোলার মহান দায়িত্ব তো হৃদয়ের গহীন থেকেই আসে ! কতটুকু নিতে পেরেছি আমি জানি না , তবে নিজের কাছে বড্ড নগণ্য । আমি বড়ই অপরাধী । নিঃসন্দেহে আমার মত অন্য কেউ যদি ওভাবে আপনার সংস্পর্শ পেতো, সে আমার থেকে অনেক বেশিই এগিয়ে যেতো। আপনার নির্লিপ্ত স্নেহময়তার বিনিময়ে বরং কষ্ট দিয়েছি অনেক ।
গুরু, আমার সবকিছুই আসমাপ্ত থেকে যায় কেন !, আপনি তো এটা বলেন নি ! আমি তো এটা চাইনি! । আপনার পৃথিবীকে দেখার সমুদ্রতুল্য জ্ঞ্যানে অনেককেই অনেকভাবে দেখেন। অনেক প্রকার মানুষের সংস্পর্শে আপনার চরিত্রগত পার্থক্যর তালিকাটা বড়ই সংবেদনশীল। আপনার এরিয়া অনেক বড় । ভাল-খারাপ-মতলববাজ অনেক মানুষের সংস্পর্শে আপনার আসা হয়ে যায়। আপনার চাতুর্য দিয়ে নিমেষে অনেককেই বিভিন্নভাবে নির্মাণ করতে পারেন। আপনি আমাকে বুঝেছিলেন। আপনি এইও বুঝেছিলেন, আমার চরিত্রের বহুরুপিতার নমুনা গুলো আসলেই নিতান্ত ভুলের ফসল। বারবার আমার ভুল সিদ্ধান্তের দ্বারা আমি নিজের আদর্শকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছি। ভগ্ন হৃদয় নিয়ে বলছি, যখনই ধরিয়ে দিয়েছেন ততবারই ক্ষোভে ফেটে পড়েছি নিজের অস্তিত্তের প্রতি ।নিজের সিদ্ধান্তহীনতা কিংবা দ্বৈত সিদ্ধান্তের প্রতি । কত রাতই তো নির্ঘুম কেটেছে নিজের নির্বুদ্ধিতা আবিষ্কার করে !
পৃথিবীর মহান মানুষ গুলোর মত আপনি দিয়েছেন প্রচুর কিন্তু অনেক কম প্রত্যাশা ছিল আপনার। আপনার এই কম প্রত্যাশা দেখে মাঝেমাঝে রাগও করেছি আপনার প্রতি। রাগগুলো সরাসরি উপলব্ধি করেছেন আপনি। হেঁসে উড়িয়ে দিয়ে বুঝিয়েছেন অনেক কিছু । কর্মই শ্রেষ্ট । এর থেকে ভালো আর কিইবা রাখতে পারে মানুষকে। ফলাফলের চিন্তাটা যে মামুলী তার গভীরতর রহস্য আজ উন্মোচিত আমার কাছে । আপনি টো আমাকে কম দেন নি ! , আপনার উজাড় করে দেওয়া নতুন নতুন স্বপ্ন ও চিন্তা তৈরির বিন্দু বিন্দু জড় হওয়া অমীয় ক্ষুরধারে সত্য কম ছিল না । আমি পারিনি সেই চিন্তাগুলোর যথাযথ কর্ষণ করে আমার মন মত অনেক ছড়িয়ে দিতে। অনেক বাস্তবতাই আমার কাছ থেকে অনেকেই ফাইদা লুটেছে। তা আমার আদর্শকে কলুষিত করেছে বারবার । বুঝিনি , বুঝিয়ে দিয়েছেন অনেক । আপনি আর কত বুঝিয়ে দেবেন ! , মাঝেমাঝে নিজের বাতুলতাকে আমার অস্তিত্ত ভাবতে কষ্ট হয়। ইদানিং আমার বিশ্লেষণী শক্তিকে বড় নিষ্প্রাণ আর আমিত্ব বিবর্জিত মনে হয়। আমার নেওয়া যেকোনো সিদ্ধান্তকেই আমার ভুল বলে মনে হয়।
গুরু, আমার বিহ্বলতার প্রতিটি প্রান্তে প্রান্তে যে প্রশ্ন সম্বলিত চৈতন্যর শিখা আপনি জ্বেলে দিয়েছিলেন, আমি তা্নিপ্রতিতটি আভা সন্তর্পণে ছড়িয়ে দিয়েছি রক্ত কণার প্রতিটি নিউক্লিয়াসে। আমি আপনার শিশ্য হতে পারি নি, ছাত্রই রয়ে গেলাম । আর এখন , আমি আপনার শিশ্য হবার মত স্পর্ধাও হারিয়ে ফেলেছি মনে হয়। তবে , সমস্ত দুঃখ, ক্ষোভ, না-পারা ও হতাশার মাঝে মাত্র একটি যুক্তিই আমাকে বাঁচিয়ে রাখে । আর সেটা হল অন্তত আপনার সংস্পর্শ যারা পায় নি তাদের থেকে পৃথক হতে চেষ্টা করেছি। সাধনার অপার শক্তি আমায় উচ্চকিত করে রাখে ।
আপনার স্নেহধন্য,
এক জ্ঞ্যনপিপাসু ।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই নভেম্বর, ২০১৬ বিকাল ৫:১১