ঋণগ্রস্থ জীবন হচ্ছে অভিশাপ। আর ঋণমুক্ত জীবন হচ্ছে আশীর্বাদ। একজন ঋণগ্রস্থ মানুষ হচ্ছে পরাধীন , তিনি কখনো মুক্ত স্বাধীন জীবনের আনন্দে অবগাহন করতে পারেন না যতক্ষনে না তিনি ঋণমুক্ত হতে পারছেন। ঋণ হচ্ছে পিছুটান যা সামনে অগ্রসর হতে দেয়না। এর জ্বালাটাও ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ উপলব্ধি করতে পারেনা। যদিও এখন আমাদের ঋণগ্রস্থ করার জন্য চারপাশে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির পরামর্শ ও অর্থে ফুলেফেপে উঠা বিবিধ প্রতিষ্ঠানের অভাব নেই। তাদের মাথায় একটাই চিন্তা কি করে মানুষকে ঋণে জর্জরিত করা যায়। কি করে স্বাধীন দেশের মানুষকে পরাধীন করা যায়। স্বাধীনতা শুধু ভৌগলিক হলে হয়না, সামাজিক, আর্থিক, শিক্ষা, মানবিক এসব ক্ষেত্রেও স্বাধীনতা জরুরী। না হলে ভৌগলিক স্বাধীনতা কতটা অর্থবহ হয় আমি জানিনা।
তাদের দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে ঋণগ্রস্থ হওয়া মানুষের মৌলিক অধিকার। কিন্ত হওয়া উচিৎ ছিলো এর উলটো। এসবের ধারাবাহিকতায় চালু হয়েছে ম্যারেজ লোন, হানিমুন লোন, কার লোন, শুধু ফুটানী লোন চালু হতে বাকি। একবার বরশী গেলাতে পারলে টেনে তোলার দ্বায়িত্ব তাদের।
অথচ নবীজী (স) তিনি যে সকল নেতিবাচক বিষয় থেকে স্রষ্টার কাছে পানাহ চেয়েছেন তাঁর মধ্যে এই 'ঋণ' অন্যতম। নবীজীর কথা বললাম এ কারণে আমি যে আস্তিক এটা বোঝাতে। শুধু নবীজী কেনো কোনো সফল মানুষই ঋণ নিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়নি।
পক্ষান্তরে দেখবেন তথাকথিত স্টার যারা তাঁরা মরে যাওয়ার পর দেখা যায় বিলিয়ন বিলিয়ন ঋণ করে রেখে গেছেন। আমাদের দেশের ঋণ ব্যবসা এত জমজমাটের কারণ হচ্ছে এ দেশের নারীরা বেশ সহজ সরল তাঁরা অল্প মিষ্টি কথাতে ভুলে যায়। যার কারণে খুব সহজেই জড়িয়ে যায় ঋণ নামক ফাঁদে।
অনুসন্ধান করলে দেখা যায় ঋণের টাকা বেশীর ভাগই ফুটানিতে ব্যয় হয়। একজন রিকশাওয়ালা ঋণ নিয়ে কখনো নিজের জন্য একটি রিকশা কিনেনা, কিনে টিভি, ভি সি ডি প্লেয়ার। আমার দেখা অবিজ্ঞতা থেকে একটু শেয়ার করছি-- বেশ ক বছর আগের কথা,
তখন আমার মাথায় একটি বাতিক চেপেছিলো একটি ফলজ, বনজ, মৎস প্রোজেক্ট করবো সেখানে অনেক লোকের কর্মসংস্থান হবে। অবকাশ যাপনের জন্যও হবে একটি মনোরম স্থান। তো সে লক্ষেই একত্রে বড় এক খন্ড জমি খুঁজতে যেয়ে পরিচয় হয় এক ব্যবসায়ীর সাথে। নামটি আর এখানে উল্লেখ করলাম না। তাঁর পাজেরো গাড়ী আছে, ৮ তলা উন্নত মোজাইক ও টাইলস সেটিংস বাড়ি আছে, বাড়ির সামনে রাস্তায় আছে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা। বাড়ির সামনে থেকে কে যায় কে আশে তাও রেকর্ড থাকে। আছে অনেক গুলো পণ্য পরিবহণ গাড়ী। তখন জুট মিল তৈরির কাজ চলছে। আছে বরফ ফ্যাক্টরি, আছে মাছ কম্পানি। এবং তাঁর কম্পানির সকল মাছ রপ্তানি করা হয় বিদেশে। আছে একটি দৈনিক পত্রিকা যা ঐদিনই তাঁর বাসায় যেয়ে নাম শুনি কেউ পড়ে কিনা আমার জানা নাই।
এত কিছুর পর একত্রে ১০০ বিঘা জমি কেনো বিক্রয় করবে জানতে চাইলে... যা বললেন তিনি মানি ব্যাগ থেকে একটা অচেনা ছবি বেড় করে দেখিয়ে বললেন এটি আমার ছবি ১ বছর আগের। চেনাই যাচ্ছেনা এটি তাঁর ছবি। বললো এই এক বছরে আমার ওজন অর্ধেক হয়ে গেছে রাতে ঘুমাতে পারিনা, সক্ষ্যতা হয়েছে ডায়েবেটিস এর সাথে । পরিবারের শান্তিও পালিয়ে গেছে। এর মূল কারণ হিসাবে তিনি “ঋণ”কে দায়ী করেছেন। আমার সাথে যেদিন দেখা সেদিন পর্যন্ত তাঁর প্রতিদিন দের লাখের মত সুদ বাড়ছে। কিন্তু কেমন করে যেনো এই ঋণের জাল ছিন্ন করে বেড় হতে পারছে না। দেশের অন্যসব সম্মানিত ঋণখেলাপির মত হজমও করতে পারছে না। এজন্যই প্রিয় জমি বিক্রয় করবে। তারপরে মিল ফ্যাক্টরি বিক্রয় করবে। খুব কাছ থেকে সেদিন দেখেছিলাম এবং উপলব্ধি করেছিলাম ঋণের অভিশাপকে। উপর থেকে সব কিছু চকচক করলেও ভিতরে না ডুকলে বোঝা যায়না। যদিও আমার সে প্রোজেক্টটি করা হয়নি। কারণ, জীবনের হুইলটি অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিয়েছিলাম।
দেশের সেরা ঋণখেলাপিদের দিকে যদি তাকাই একটু যারা খোঁজ খবর রাখেন তাঁরা হয়তো সহজেই বুঝে যাবেন আমি কি বলতে চাচ্ছি। মানুষের অর্থ চুরি ডাকাতি করে শান্তিতে থাকার কথা নয়। আমি এখানে প্রতেক্যের নাম উল্লেখ করে বিবারন দিয়ে বলতে পারি... কিন্তু তখন ব্লগে প্রকাশে বিব্রত হতে হবে কর্তৃপক্ষের। শুধু এটুকু বলি একজন মানুষ যখন তাঁর দুটো ছেলে মেয়েকেই অপঘাতে মৃত্যু হতে দেখে তাঁর জিবনে আর কি বাকি থাকে। তাঁর সম্পদের কি ই বা মূল্য থাকে।
ঋণ আসলে সুখ শান্তির নিশ্চয়তা তৈরি করেনা বরং তৈরি করে অনিশ্চয়তা। যারাই বেশি অশান্তি সৃষ্টিতে কাজ করতে পারে তারাই শান্তিতে এওয়ার্ড পায়, যারা বেশি মানবাধিকার লঙ্ঘন করতে পারে তারাই মানবাধিকার প্রাইজে ভূষিত হয়।
যে কারণেই দক্ষিণ আফ্রিকার কালোরা আজও পায়না তাঁর অধিকার , ফিলিস্থানে ক্ষুধার্ত শিশুরা এখনো রেশনের জন্য জাতিসঙ্ঘ তাবুতে অপেক্ষা করে, মায়েনমারে নির্বিচারের চলে গনহত্যা, দারফুর ও সোমালিয়ায় পায়ের তলায় হীরকের ক্ষনি নিয়ে লক্ষ মানুষ দুর্ভিক্ষে মৃত্যুর প্রহর গুনছে, তলস্তয়রা খালি পকেটে পথের ধারে মরে থাকে আর সম্মানিত হয় রুশদিরা, প্রয়াত বিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলাম জাতীয় অধ্যাপক নুরুল ইসলাম এদের জন্ম মৃত্যু সাফল্য সম্মান পত্রিকায় শিরোনাম হয়না। শিরোনাম হয় হলমার্ক...।
আর এসবকে পুঁজি করে অন্যদিকে চলছে মেডেল ও এওয়ার্ডের মহাৎসব। এটাই এখন নিয়ম হয়ে গেছে যারা এই সাদা টুকু বুঝতে পারেনা তাদের কালো অন্ধকার থেকে বেড় করার দ্বায়িত্ব কেউ নিতে পারেনা। সত্য সব সময় নির্মম যা মানতে কিছুটা কষ্ট তো রয়েছেই।
এত গেলো আর্থিক ঋণের কথা... ঋণ কি শুধু অর্থের?
যে মা বাবার কারণে পৃথিবীর মুখ দেখেছি তাদের ঋণ নিয়ে কি চিন্তা করি? পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়তে পড়াশুনা করেছি জনগনের টাকায়। সেই জনগনের ঋণ কি শোধ করেছি সর্বাত্তক সেবা দিয়ে ? নাকি ফাইল আটকিয়ে টেবিলের নিচ থেকে সে মানুষের কাছ থেকে টাকা নিচ্ছি? যে দেশের মাটি পানিতে বড় হয়েছি হৃদয়কে প্রশান্ত করেছি সেই দেশের ঋণ কি শোধ করেছি? যাদের কারণে আজ বাংলায় কথা বলি বা দেশ স্বাধীন পেয়েছি তাদের রক্তের ঋণ কি শোধ করেছি---অন্তত একবার অসহায় রুগিকে রক্ত দিয়ে?
যে কৃষক আমাদের অন্ন জোগায় কখনো কি কাদামাটি মাখা অবস্থায় বুকে জড়িয়ে ধরেছি? যে গাছ অক্সিজেন দিয়ে আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে ? সে অক্সিজেন তৈরিতে বর্ষা এলে অন্তত একটি গাছ কি রোপণ করেছি?
আসলে মানব জীবনটাই হলো ঋণ মুক্তির এক অভিযাত্রা...