এতগুলো লাশ এক যায়গায় পড়ে থাকতে আমার আগের জনমেও দেখিনি। একজন এসে বললো লাশগুলো এ এলাকার কিছু পাখি দম্পতির। এরা সবাই অভিমান করে আত্মহত্যা করেছে। পাখি ও পাপ পাশাপাশি দেখে আশপাশের মানুষজন আতংকিত হয়ে গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে। রয়ে গেছে কেবল কয়েকজন মাঝি। প্রতিদিন মনোযোগ দিয়ে নৌকা মেরামত করতে করতে সবাই একেকটা বটগাছের মত বেড়ে উঠছে।
এসব পাখির মতো একদিন এলাকার একমাত্র নদীটিও মরে লাশ হয়ে পড়েছিলো। কেউ ফিরেও চায়নি, ধরেও চায়নি। পরে অভিমান করে এক দুপুরে রোদ বেয়ে বেয়ে কোথায় যেন চলে গেছে। দু’একজন মাঝি নদীর জল কামড়ে ধরে চলে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলো। কিন্তু বাতাসের সাথে টিকতে না পেরে দাঁত ভেঙে পড়ে মরে গেলো। যেসব মাঝি সাহস করে নদীর লাশকে বিদায় জানিয়েছিলো, ওরা এখন নৌকা মেরামতে মনোযোগ দিয়ে সে পাপের প্রায়শ্চিত্ব করে। মাঝে মাঝে মাঝিরা গানও করে। তখন পাখিগুলো তাদের সঙ্গী বদল করে নেয়। গাইতে গাইতে মাঝিরা যখন কিঞ্চিত নেচে উঠে, জোড়ায় জোড়ায় পাখি তখন যায়গা বদল করে নেয়।
ওহ! বলছিলাম আমার পূর্বজনমের কথা। এটা আগে ছিলো না। একদিন সন্ধ্যায় ভুল করে একটি বন্ধ্যা গাছের তলে স্বপ্ন দেখার পর থেকে আমার পূর্বজনমকে দেখতে পাই। সে গাছে কিছুদিন পরই ফুল দেয়। কিন্তু তার স্বামী আর ফিরে আসেনি। এরপর থেকে স্বামী সংস্কৃতি উঠে যায়। এখন আর কেউ বিয়ে করে না। সবাই গান গায়।
শুনেছি এ অঞ্চলের পাখিগুলো বিয়ে করে। বিয়েতে অনেক মজা করে। আমি এসেছি বিয়ের নিমন্ত্রনে। না, কেউ আমাকে আসতে বলেনি। আমার এখন কোন পাখি যোগাযোগ নেই। এমনিতে গান গাইতে গাইতে চলে এসেছি। কিন্তু তার আগেই যে ভয়ংকর অনাচার হয়ে গেলো, এখন আর নিজের গ্রামে ফিরে যাওযার কোন পথ নেই। সর্বশেষ পরিচিত পথ নিয়েও কয়েকজন মাঝি সন্দেহ প্রকাশ করলো। ঘটনার পর আমি আগের চাইতে অনেকটা স্থির হলাম।
এর কিছুদিন পর মাঝিদের মাঝে ঝগড়া লাগে। একজন এসে লাশ গণনা করতে করতে লাশগুলো যে পাখির নয়, তার পক্ষে নানান যুক্তি দেখাতে লাগলো। আশ্চর্য! বাকি মাঝিদের কেউই দ্বিমত করেনি। পরে সবাই মিলে লাশ গণনা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ে। আমি পাখি, পাপ এবং মাঝিদের ঘুম পাহারা দিয়ে কোনমতে টিকে রইলাম। বাতাসের যা বেগ, অসহ্য!
অনেক আলোচনা সমালোচনার পর মাঝিদের নেয়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এ লাশগুলো নদীতে জেগে ওঠা সর্বশেষ নতুন চরের। নদী উড়ে যাওয়ার পর এরা প্রাণ হারিয়ে ফেলে। এখন এ লাশগুলো মৃত্যুর গভীর থেকে গভীরতর স্তরে নেমে যাচ্ছে এবং অভিশাপ ছড়াচ্ছে। মাঝিরা ফিসফিস করে চরের আগে জারজ শব্দটি বসিয়ে নেয়। পরে গোল হয়ে বসে সবাই মিলে চরের গল্প করে। আমি এসবের একমাত্র সাক্ষি বলে ওরা আমার ভরণপোষনের দায়িত্ব নিয়েছে।
লিখে রেখেছি, এসব চরের জন্ম হয়েছে মানুষের ভুলে। নদীতে একবার মানুষের পাল হামলে পড়েছিলো। তারপর ওরা যে যার নিয়মে প্রচুর ধর্ষনের ঘটনা ঘটায়। শেষে সবাই মিলে ওই ঘটনাকে ভুল হিসেবে চিহ্নিত করে। তারও অনেক আগে এ এলাকায় ডাকাত হামলে পড়লে অনেকের জারজ সন্তান জন্ম নিতো। এসব তথ্য নিয়ে ঘোরতর সন্দেহ থাকলেও মাঝিদের প্রতি আমার আস্থা আছে। ওরা অনেক সুন্দর গান গায় এবং ওদের কোন সন্তান নেই। তাই সন্তানদের কেউই জারজ নয়।
পূর্বজনমে আমি জন্মেছিলাম পাখি হয়ে। ডাকনাম ছিলো পাখি। যেন জাতের নাম উজ্জ্বল করতে পারি তাই এরকম নাম রেখেছিলো। আমি কোন প্রজাতিভুক্ত ছিলাম না। চেহারা অবিকল পাখিদের মতো ছিলো এবং আমি উড়তে পারতাম। সেসময় একটা নিয়ম ছিলো। আমি যতটুকু উড়ে যেতাম, ততটুকু বনে অন্যান্য প্রাণী থেকে পাখিরা উজ্জ্বল হয়ে যেতো। এভাবে নিজের জাতের নাম উজ্জ্বল করতাম।
নিয়ম মানতে মানতে একদিন আমার ডানা অকেজো হয়ে যায়। প্রথম প্রথম কয়েকটি পালক ভেঙে পড়েছিলো। পরে শুনলাম ডানা জাপটে যদি কখনো বাতাসের শরীরে ভাঙ্গন ধরাতে পারতাম, তাহলে আমার মৃত্যু হতো না। এখানের নদীটিও আমার মতো পাপ করেছিলো। ভাঙন ভুলে গিয়েছিলো বলে প্রকৃতি তাকে ক্ষমা করেনি। ঈশ্বরতো আর নদী বিষয়ক ভাবনায় মাথা ঘামান না। যেখানে মানুষের হাত পড়ে গেছে, ঈশ্বর সেখানে অসহায়। এসব নদী জানতো না, ভাঙতে না পারলে যে নিজেকেই ভেঙে যেতে হয়! এ নদীটিও মৃত্যুর সময় জল পায়নি। কেউ যেন অভিশাপ দিয়েছিলো, “দেখিস, মরার সময় জলও পাবি না!”
মাঝিরা এখন দিনের বেশিরভাগ সময় বাঁশি বাজিয়ে কাটিয়ে দেয়। আগে এরা নৌকার কোণা ধরে প্রণাম করতো, জলের পুজো দিতো। এখন বাঁশিকে কপালে ঠেকিয়ে সালাম করে। চারপাশে প্রচুর ফিসফাস শুনি। সবাই নাকি রাখাল হয়ে যাবে। এখানে আসার পর এ প্রথম বিব্রত হলাম। আমার এসব ভালো লাগে না। কোথাও বসে শান্তিতে ক’টা লাশও গুনতে পারি না। সেই কবে নিজের লাশ দেখে একবার চিৎকার করে মূর্ছা গিয়েছিলাম, তারপর এইতো এ ক’টা লাশ। ক’দিনইবা দেখলাম। এখন মাঝিদের অনীহা টের পেয়ে নিজের মৃতদেহ ফেলে পালিয়ে যাওয়ার ফন্দি করছে লাশগুলো।
যেসব মাঝিরা জল কামড়ে ধরে চলে যাওয়ার চেষ্টা করে মরে গিয়েছিলো, তাদের কথা খুব মনে পড়ছে। ওদের মতো ঝুঁকি নিবো, নাকি এসব মাঝিদের মতো প্রায়শ্চিত্ব করবো, এখনো সিদ্ধান্ত নিইনি। হাতে যে ক’দিন সময় আছে, নিশ্চিন্তে একটা ঘুম দিই। পরে মাঝিদের সাথে আলোচনায় যা হয়, তা মেনে নিবো। কেবল মনে পড়ে, পরের জনমে রাখাল হয়ে জন্ম নেয়ার ইচ্ছে কবে যেন আমারও হয়েছিলো।