মাঝে মাঝেই চোখ ঝাপসা হয়ে আসে মুনিয়ার। ডিসেম্বর মাস এলেই মনটা বড় বেশী খারাপ হতে থাকে। মনে হয় সে ও যেন ছিল সেই দিনটায় ওই একই কাতারে।
১লা ডিসেম্বর ১৯৭১ সাল-অনেকগুলো মৃত্যুভয়ে ভীত মানুষকে ঘোড়াশাল সার কারখানার পাশের নদীটির তীরে এক সঙ্গে দাঁড় করিয়ে ঠা ঠা ঠা- তারপর সব নিস্তব্ধ, শুধু ভারী বুটের শব্দ আর পাকিস্তানি আর্মির মিলিটারী জিপের প্রস্থান।
কত ঘন্টা ঐ মৃত মানুষগুলোর মধ্যে পড়ে ছিলে তুমি শান্তনু-১-২-৮-২৪ ঘন্টা? আমি ঠিক জানিনা। তখন তুমি ঢাকা কলেজের ছাত্র, বড় বোনের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলে ছোট্ট তুলতুলে অতনু কে দেখতে- কি তার ঘন কালো চুল আর বিশাল বড় বড় চোখ দুটো। মাত্র দশ মাস বয়সেই সেই মিষ্টি ছেলেটি বাপ হারা হয়ে গেলো, টেরই পেলো না বাবার আদর কাকে বলে। ছোট বেলায় তুমিও বাবাকে হারিয়ে পেয়েছিলে বড় দুই ভাইয়ের আদর, ভালবাসা আর কঠোর শাসন ”মানুষ তোকে হতেই হবে” কিন্তু ওই শয়তানগুলো তোমার সাথে সাথে ওদেরও মাটিতে শুইয়ে দিলো। তফাত একটাই –কারখানার মালি রহিম শেষপর্যন্ত তোমাকে হাসপাতালে পৌঁছাতে পেরেছিলো। ঠা ঠা ঠা গুলির আকাশ বিদীর্ণ শব্দের পর সারারাত যেন প্রেতপুরীর নিস্ত-ব্ধতা। তাই সকালের সূর্য যখন উঠি উঠি করছে তখন অনেক সাহসে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেই সারিবদ্ধ লাশগুলো-পারচিত মুখগুলো শেষবারের মত দেখতে এসেছিলো রহিম। এসেই দেখে শান্তনু ভাইয়ের হাতের আঙুলগুলো একটু একটু করে নড়ছে- নিজেকে আর কিছু ভাববার সময় দেয়নি রহিম। শান্তনুর অসার শরীরটাকে কাঁধের উপরে উঠিয়ে ত্বরিৎ গতিতে ছুটে যায় কারখানার হাসপাতালে-না ধারের কাছে কোন ডাক্তার নেই, বেঁচে যাওয়া একমাত্র ডাক্তার এজাজ কোন রকমে লাইফ সেভিং ড্রাগ দিয়ে সব্জির ট্রাকের লোকদের রাজি করিয়ে ফুলকপি, বাঁধাকপির মাঝখানে শান্তনু কে শুইয়ে পাঠিয়ে দেয় ঢাকা মেডিকেল কলেজে, সেখান থেকে হলিফ্যামিলি হসপিটাল। তারপর দীর্ঘ ৬ মাস মানুষ আর যমের টানাটানি, আর শান্তনুর বেঁচে থাকার জন্যে যুদ্ধ। ডাক্তার শাহুন্জা কোমড়ের পাশের গুলিটা শান্তনুকে দেখালো-ওর তখন চোখের ভেতরে মনের ভেতরে অসংখ্য কষ্টের কণারা দ্রুত ছুটোছুটি করলো। এ রকমই কয়েকটি ধাতব পদার্থ আমাকে ভাই হারা করেছে, ভাবীগুলোর বিবর্ণ মুখ, বোনের অসহায় চেহারা আর ছোট্ট তুলতলে অতনু- না আর ভাবতে পারে না শান্তনু, আর স্বাভাবিক থাকতে পারে না সে-সারাটা মুখ ক্রোধে ,কষ্টে লাল হয়ে ওঠে তার।
১লা ডিসেম্বর সারাদিন কোথাও বের হয় না সে, ঘরের ভেতরে থাকে, দরজা জানালার পর্দা টানা-মোটামুটি অন্ধকারাচ্ছন্ন সারাদিন আর কষ্টকর স্মৃতিচারন। এই একটিদিন ও মুনিয়ার সঙ্গে ও কথা বলতে চায় না।
কাকতালীয়ভাবেই পরিচয় মুনিয়ার সাথে শান্তনুর। ছুটির দিনে ঘর সাফ করতে গিয়ে কার্পেটের নীচে পড়ে থাকা একটি চিঠি দেখতে পায় মুনিয়া। খামের উপরে সুন্দর ঝরঝরে লেখায় মুনিয়ার নাম- কিছুটা বিষ্ময় আর কৌতুহল মিলিয়ে একঝটৃকায় খুলে ফেলে চিঠিটা-”আমার নাম শান্তনু আমি আশরাফের কাছ থেকে তোমার ঠিকানা পেয়েছি, জানতে পেরেছি তুমি আর ওর সাথে বন্ধুত্ব রাখতে চাও না। মাঝে মাঝে আশরাফ তোমার লেখা চিঠি আমাকে দেখাতো। সেই লেখাতে আমি এক ধরনের গভীরতা অনুভব করতাম যা আশরাফের মাঝে নেই। যাই হোক আমি তোমাকে তুমি করেই ডাকছি মুনিয়া কারন আমি জানি তুমি আমার থেকে বেশ ছোট। আর বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে আপনি বলার ভন্ডামিতে আমি নেই। আমি তোমার বন্ধু হতে চাই। যদি চিঠির উত্তর পাই তাহলে নিজ সম্বন্ধে আর ও কিছু জানাবো-ভাল থেকো- শান্তনু।”
১লা বৈশাখ ১৯৮৫ সাল। মুনিয়ার সকাল থেকেই মনে হলো আজকে একটা বিশেষ দিন। গতকালই বান্ধবীদের সংগে ঠিক করা ছিল সকাল বেলায় চলে যাবে রমনার বটমূলে-প্রানভরে গান শুনবে ’এসো হে বৈশাখ এসো এসো’ আর জীবনকে নতুন আলোয় রাঙিয়ে তুলবে ইচ্ছেমত। কথামতই সব ঠিকঠাক করছিল কাল কি কি পড়বে, কেমন করে সাজবে এ সব না না কথা। এ সব ভাবতে ভাবতে বাসায় ফিরতেই অপার বিষ্ময়ে মুনিয়া দেখলো মা তার জন্যে একটা সুন্দর পেঁয়াজ রঙের শাড়ী কিনেছেন ১লা বৈশাখে পড়বার জন্যে। খুশিতে মাকে জড়িয়ে ধরে মুনিয়া- ইউ আর গ্রেট মা, বিশাল বড় একটা হাগ দেয় তাঁকে। বিকেলে ফোন আসে শান্তনুর কালকে কি করবে মুনিয়া জানতে চায়-গড়গড় করে বলে চলে মুনিয়া বান্ধবীদের সংগে তার প্ল্যান আগামী দিনটির জন্যে।শান্তনু জানায় সে ও যাবে কাল বটমূলে। হয়তো দেখা হতেও পারে।
অনেক রাত পর্যন্ত জেগে শাড়ীতে ফলস লাগালো মুনিয়া -কোন ব্লাউজে শাড়ীটা ভাল যাবে তার ট্রায়াল দিলো বেশ কয়েকবার, কপালে কোন টিপ পড়বে, হাতে কোন কোন চুড়ি থাকবে যেন এক মহা উৎসব! খোঁপাতে কি ফুল গুজবে মুনিয়া? না থাক হঠাৎ লজ্জ্বা ভর করে ওর দু চোখে।
সকাল ৫টায় ঠিকঠাক মত সেজেগুজে মুনিয়া রওয়ানা দেয় রহিম ভাইয়ের স্কুটারে। চারিদিকে শুধু আজ পবিত্রতার আর ভালবাসার ছোঁয়া । লাল পেড়ে সাদা শাড়ীতে মেয়েগুলোকে আজ রাজহংসীর মত লাগছে মুনিয়ার কাছে। আজ যে সাম্যতার দিন ১লা বৈশাখ এমনই একটি দিন যেদিন সমস্ত বাঙালী ধর্ম বর্ণ ভেদভেদ ভুলে একাকার হয়ে যায়। কানের কাছে বেলুন ভরা বাঁশীর আওয়াজে সম্বিত ফিরে পায় মুনিয়া ”এই কিরে তুই এখানে দাঁড়িয়ে আর আমরা তোকে হন্যে হয়ে খুঁজছি”।
তারপর চার বান্ধবী মিলে চটপটি আর ইলিশ পান্তা খেলো জান ভরে। অপূর্ব সুন্দর গলায় ছায়ানটের ছেলেমেয়েগুলো বর্ষাবরণের গান গাইছে একটার পর একটা। মানুষের প্রচন্ড ভীড়, সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনছে সেই গান । বেদীর কাছেই ভাগ্যের জোরে বসবার জায়গা পেয়ে গেলো মুনিয়ারা চারজন। হঠাৎ ও খেয়াল করলো ভীড় ঠেলে কে যেন এগিয়ে আসছে ওদের দিকে। হাতে তিনটা লাল গোলাপ ”শুভ নববর্ষ কেমন আছ মুনিয়া”
”শুভ নববর্ষ - আরে শান্তনু যে, কখন এসেছো এখানে ”
”সেই কাক ডাকা ভোরে”
শান্তনু কে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে আজকে- গেরুয়া রঙের পান্জাবীর সাথে সাদা চুড়িদার। চশমার ফাঁক দিয়ে জ্বলজ্বলে চোখদুটোতে কেমন যেন একটা খুশীর ঝিলিক।
ক্রমশঃ
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই মে, ২০১০ দুপুর ২:১৬