গণজাগরণ মঞ্চকে আমি খুব কাছ থেকে দেখছি প্রায় এক মাসেরও বেশি সময় ধরে।এসময় এ আন্দোলনের অনেক ভালো দিক,অনেক দুর্বল দিক আমার চোখে ধরা পড়েছে।আমি এ বিষয়টি সবার সাথে একটু ভাগাভাগি করছি।
গণজাগরণ মঞ্চের মূল আন্দোলন শুরু হয়েছিল একটি হতাশাজনক রায়ের তীব্র প্রতিক্রিয়া থেকেই।মানুষ সেদিন রায়টি মানতে পারেনি বলেই রাস্তায় নেমে এসেছিল।তাই গুটিকয়েক মানুষের ৫ই ফেব্রুয়ারীর প্রতিবাদটি মুহূর্তেই বিশাল গণসমুদ্রের আকার ধারণ করে ছড়িয়ে পড়েছিল বাংলার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে।প্রথমদিকে মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এতে অংশ নিয়েছিল।যারা সশরীরে আন্দোলনে উপস্থিত হতে পারেননি,তারা সাহায্য করেছেন অর্থ দিয়ে,বাসা থেকে খাবার বানিয়ে এনে আন্দোলনকারীদের খাইয়েছেন,পানি খাইয়েছেন,কেউবা মোমবাতি কিনে দিয়েছেন।এগুলো কেউ কোন উদ্দেশ্য থেকে করেননি,আন্দোলনকারীদের প্রতি নিঃস্বার্থ ভালোবাসা এবং আন্দোলনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে শ্রদ্ধাবোধ থেকেই এ কাজগুলি তারা করেছেন।কিন্তু যে চেতনা থেকে আন্দোলনটির সূত্রপাত,সেটি কি শেষ পর্যন্ত ধরে রাখা গেছে?
প্রথমেই জামায়াত-শিবিরকে পরাস্ত করার যে কৌশল,সেটা নির্ধারণে ভুল হয়েছে।তাদের সাথে সম্পর্ক রাখা যাবেনা,বাড়িভাড়া দেয়া যাবেনা ইত্যাদি বলে তাদেরকে শক্তিশালীই করা হয়েছে।যে ছেলেটি আজ শিবির করছে,সে জন্ম থেকেই শিবির কর্মী হয়ে জন্ম নেয়নি।গত ৪২ বছর ধরে জামায়াতকে নিয়ে শাসকশ্রেণীর যে খেলা এবং তাদেরকে পৃষ্ঠপোষকতার যে নগ্ন প্রতিযোগিতা তাতেই জামায়াতের পেটে জন্ম নিয়েছে শিবির নামক এই বিভ্রান্ত গোষ্ঠীর।কাজেই সেটিকে আড়াল করে শুধুমাত্র জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষনা অনেকটাই হাস্যকর।আজ জামায়াতের যে বিশাল কর্মী-সমর্থক এরা আমাদের সমাজেরই অবিচ্ছেদ্দ্য অংশ হয়ে গেছে।এক কথায় এত সহজে এদের মূলোৎপাটন করা সম্ভব?এরা যে সাংস্কৃতিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে জামায়াত-শিবির করছে সেটাকে ধ্বংস করতে না পারলে বা তাদেরকে তাদের সাংস্কৃতিক চেতনার ভুল-ভ্রান্তিগুলো ধরিয়ে দিতে না পারলে কি এদেরকে এদের আদর্শ থেকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব?শিবিরের রগকাটার রাজনীতির কথা হচ্ছে,কিন্তু সারা দেশে শিক্ষাঙ্গনে আতঙ্ক সৃষ্টিকারী চাঁদাবাজি,টেণ্ডারবাজি,হল দখল,সিট দখল,ভর্তিবাণিজ্য,নিয়োগবাণিজ্য প্রভৃতিতে লিপ্ত হওয়া ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা যখন স্লোগান তুলে-“ধর ধর ধর শিবির ধর, ধইরা ধইরা জবাই কর” কিংবা “রাজাকারের চামড়া,কুত্তা দিয়ে কামড়া” তখন সাধারণ মানুষের “Sympathy” তারা ঠিকই পায়।৭১ এর রাজাকার কিংবা একালের রগকাটাদের সাথে যদি আমাদের সংস্কৃতিগত কোনো পার্থক্যই না থাকে,তবে আমরা কিসের ভিত্তিতে তাদের নিষিদ্ধের দাবি তুলছি?আমরা যদি সিদ্ধান্ত নিতাম যে আমাদের লক্ষ্য হবে ২০১৩ সালের ১মার্চ থেকে কোন ছাত্র শিবিরে যোগদান করবেনা এবং সে লক্ষ্যে কাজ করে যেতাম অর্থাৎ সামাজিক-সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক সব দিক থেকে তাদের কোণঠাসা করতাম যার উপর তাদের রাজনৈতিক মেরুদণ্ড দাঁড়ানো আছে,তাহলে জামায়াত-শিবির এমনিতেই অতল গহ্বরে হারিয়ে যেত।এত কষ্ট করে গলা ফাটিয়ে ‘জবাই কর, খতম কর’ স্লোগান তোলা লাগতনা।আমরা বারবার একটা জায়গায় ভুল করেছি এটা ভেবে যে আমাদের সাথে পুরো দেশ আছে।আমাদের সাথে পুরো দেশ নেই,শুধুমাত্র মুক্তিযুদ্ধকে যারা ভালবাসে তারাই আছে।এরমধ্যে আবার যারা ধর্মভীরু তারা আস্তিক্য-নাস্তিক্যের দোটানায় পড়ে নিরাপদ দূরত্বে আছে।আমরা যদি প্রথম থেকেই বিএনপিকেও আন্দোলনে শরিক করাবার চেষ্টা চালাতাম,তাহলে বিএনপি আজ বিরোধীতার খাতিরেও এত কথা বলার সুযোগ পেতনা।আমরা শহুরে মধ্যবিত্তের মাঝেই আন্দোলনটিকে সীমিত রেখেছি,গ্রামের বা শহরের সাধারণ কৃষক-শ্রমিক-জনতার মাঝে ছড়িয়ে দিইনি।সাধারণ শ্রমজীবি মানুষ ফেসবুকিং করেনা,ব্লগও পড়েনা।কিন্তু জামায়াত-শিবির আমাদের চোখে আঙুল তুলে দেখিয়ে দিয়েছে কিভাবে তাদের জাগ্রত করতে পারলে(হোক সেটা মিথ্যা গুজব) তারা ক্ষোভে ফেটে পড়ে,লড়াই করে নিজের জীবন পর্যন্ত দিতে কার্পণ্য বোধ করেনা।সেখানে শহুরে মধ্যবিত্ত কয়েকটা ককটেল ফুটলে গণজাগরণ মঞ্চে আসা বন্ধ করে দেয়।
গণজাগরণ মঞ্চের সেই বিশাল শক্তি কেন হঠাৎ করে এত হ্রাস পেল?বাংলাদেশে বস্তুবাদী নাস্তিকতো অনেকেই আছে,কিন্তু কয়জন মহানবী(সঃ) এর বিরুদ্ধে কটুক্তি করেছে?পাচঁজন সর্বোচ্চ দশজন।সব নাস্তিকতো কটুক্তি করেনি,তাহলে কেন রাজীবকে হত্যার পর সব ব্লগারকে যেখানে ঢালাওভাবে নাস্তিক আখ্যা দেয়া হল, তখন গণজাগরণ মঞ্চ থেকে কি পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে?কেন সবার সামনে প্রথম থেকেই প্রকৃত সত্য তুলে ধরা হলনা?তারা মিথ্যা অভিযোগ এনে আমাদের প্রতিহত করার ঘোষণা দিচ্ছে,মহাসমাবেশের ডাক দিচ্ছে,পদযাত্রার ঘোষণা দিচ্ছে অথচ যে এই অপপ্রচারের নাটের গুরু সেই মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতারে আমাদের একটি স্মারকলিপি পেশ করা ছাড়া আর জোরালো কর্মসূচী কোথায়?কেন তাকে গ্রেফতারের দাবিতে জোরালো আন্দোলন হচ্ছেনা?যে আমার দেশ পত্রিকা মিথ্যা তথ্য দিয়ে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে এত বড় গণহত্যার জন্ম দিল,তার বিরুদ্ধে তথ্য মন্ত্রণালয়ের অবস্থান কি?ইউটিউব যদি বন্ধ হতে পারে,তবে কাবা শরীফের গিলাফ নিয়ে আমার দেশ গংয়ের মিথ্যাচার বা সাঈদীর চাঁদে ভ্রমণের খবর ছাপিয়ে এত নারকীয় ঘটনার আয়োজক হিসেবে কেন আমার দেশকে নিষিদ্ধ করা হবেনা?কেন তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে একটি প্রেস রিলিজ করে প্রকৃত সত্য দেশবাসীর কাছে তুলে ধরা হলনা?কিভাবে আমার দেশ আজো মিথ্যাচার করার সাহস পাচ্ছে?এসব ব্যাপারে আমাদের অবস্থান কি?নাস্তিক অভিযোগ করার প্রথম থেকেই যদি মঞ্চের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ এ বিষয়ে উদ্দোগী হয়ে প্রকৃত সত্য তুলে ধরত, তাহলে আজ এত ঘটনার জন্ম নিতনা। আন্দোলনের স্পিরিটটা এভাবে হারিয়ে যেত না। আমাদের উদাসীনতায় এখন খালেদা জিয়াও এসব অভিযোগ করার ধৃষ্টতা দেখাচ্ছে।
গণজাগরণ মঞ্চ নিয়ে আমি এখনো আশা ছাড়িনি।আমি এখনো আশা করি গণজাগরণ মঞ্চ চাইলে আবার আগের মত স্বমহিমায় ফিরে আসতে পারে। এখনো সময় আছে নিজেদের ভুল-ত্রুটিগুলো সংশোধন করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার।কে বন্ধু কে শত্রু সেটা চিনতে পারার ক্ষমতা এখন খুব জরুরী। আন্দোলনের শুরুতেই বিএনপির নির্বুদ্ধিতায়/সংকীর্ণতায় আওয়ামী লীগ আন্দোলনটিকে সমর্থন দিয়ে তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা আন্দোলনটিকে তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল করতে পেরেছে। পরবর্তীতে মঞ্চ দখল করে তারা এখন তাদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আন্দোলনটিকে চলতে বাধ্য করছে।
একটি জিনিস মনে রাখা দরকার এ আন্দোলন ব্যর্থ হলে এর ফলাফল শুধু আন্দোলনকারীদেরই নয়,পুরো বাংলাদেশকেই ভোগ করতে হবে। বাংলাদেশের মাটি থেকে এরপর রাজাকারদের উৎখাত করা সত্যিই কঠিন হয়ে যাবে কারণ এ আন্দোলন তাদের অনেক বেশি সতর্ক এবং অনেক বেশি শক্তিশালীই করেছে।তাদের অনেক ভুল ধরিয়ে দিয়েছে।কাজেই আন্দোলন ব্যর্থ হলে তারা অবশ্যই সেগুলো সংশোধন করে নেবে। একটি জিনিস বোঝা উচিত আওয়ামী লীগের যতদিন প্রয়োজন ততদিন তারা আন্দোলনটিকে সমর্থন দিয়ে যাবে,যখনই তাদের প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে তখনই তারা মাথার উপর থেকে ছাতা সরিয়ে নেবে।তখন মঞ্চের উদ্দোক্তারা দুই কূলই হারাবেন।আওয়ামী লীগ ও তখন তাদের চিনবেনা,বিএনপি-জামায়াতের তো প্রশ্নই ওঠেনা।বিএনপি-জামায়াত ভবিষ্যতে ক্ষমতায় আসলে আওয়ামী লীগ নয়,তাদের ওপরই স্টীম-রোলার চালাবে।এই সহজ সত্য কথাটি বোঝা উচিত।কাজেই যদি সত্যিকারঅর্থেই আন্তরিকভাবে রাজাকারদেরে বিচার চাইতে হলে কোন দলের সিদ্ধান্তে না গিয়ে সঠিক এবং যুক্তিসংগত সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত।আন্দোলনের এই পর্যায়ে এসে পিছটান দেয়ার কোনো সুযোগ নেই,সঠিক সিদ্ধান্তে হয়তোবা নির্যাতন নেমে আসতে পারে তবুও সেগুলোকে ভয় না করে নিজের আদর্শ ঠিক রেখে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া উচিত।আন্দোলনটিকে নিয়ে সারা দেশকে যেভাবে দুভাগ করে ফেলা হয়েছে, তাতে তাদের এখন অবস্থা “ডু অর ডাই”।আর মরতে যদি হয় তবে বীরের মত লড়াই করে মরাই উচিত।নাহলে ‘জাহানারা ইমাম স্মরণে,ভয় করিনা মরণে’;’দিয়েছিতো রক্ত,আরও দেব রক্ত’;’প্রয়োজন হলে দেব, এক সাগর রক্ত’;’রক্তের বন্যায়,ভেসে যাবে অন্যায়’ স্লোগান তোলা আমাদেরকে ইতিহাস কখনো ক্ষমা করবেনা। ইতিহাস সারাজীবনই আমাদের বিশ্বাসঘাতক হিসেবে মনে রাখবে।
লিখাটি সংগ্রহ হয়েছে মোহাম্মদ মুশফি্কুল ইসলাম হতে।