পৃথিবীর বয়স কত?
জিওলজিস্টদের মতে তিনশ কোটি বছর কিংবা তার চেয়েও বেশি।
সৃষ্টি শুরু থেকেই আজ পর্যন্ত, নানা রকম বিস্ময়কর বস্তু, ঘটনাপ্রবাহ, স্থান কিংবা স্থাপনার অনুসন্ধান করে যাচ্ছে মানুষ। এর মূল কারণ, পৃথিবীতে মানুষ হচ্ছে সবচেয়ে কৌতূহলী জীব।
কয়েক বছর আগের কথা মনে আছে তো?
ওয়ারী বটেস্বর নামক এক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়।
আমাদের দেশের আরচিওলজিস্টদের মতে,
এ রকম আরো অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আছে, রূপময় চির সবুজের দেশ, আমাদের প্রিয় বাংলাদেশে।
এমনি একটি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন চাঁদপুরের কাছাকাছি, লোহাগড় মঠ।
যা আমাদের দেশের একটি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন।
এই মঠ নিয়ে অতীতে অনেক লেখালেখি হয়েছে, কিন্তু তবুও মানুষের কৌতূহলের শেষ নেই।
মঠ এলাকা নিয়ে বের হয়েছে হাজারো ম্যাগাজিন।
চাঁদপুর শহর থেকে ১২/১৩ কিলোমিটার পূর্ব-দক্ষিণে লোহাগড় নামক স্থানে আছে এই মঠ।
একদিন উৎসাহী মনে রওনা দিলাম লোহাগড়ের মঠ দেখতে।
সফরসঙ্গী হিসেবে ছিলো আমার দু'বোন ও ছোট ভাই।
দিনটি ছিল গতবারের রোজার ঈদের দিন। দুপুর ১২ টার দিকে আমাদের গ্রামের বাড়ি থেকে চান্দ্রা বাজার হয়ে সিএনজিতে করে পৌঁছে গেলাম লোহগড়ে। উদ্দেশ্য একটাই, ইতিহাসের বিখ্যাত এই মঠের একটি দর্শন করবো।
এবার আপনাদের এই মঠের ইতিহাস বলতে শুরু করতেছিঃ
লোহাগড় নামকরণ করা হয়েছে তৎকালীন হিন্দু অত্যাচারী জমিদারদের নামানুসারে।
লোহা ও গড় ছিলো মূলত জমিদারের দু' ছেলের নাম। বড়জনের নাম ছিল লোহা এবং ছোট জনের নাম ছিল গড়। লোহ আর গড়, তারা দুই ভাই এতই নির্মম ছিলো যে, তাদের অত্যাচারের নমুনা আরবের জাহিলিয়া যুগের ন্যায় নির্মম ও বর্বর।
তারা দুই ভাই, গর্ভবতী কোনো নারীকে দেখলে ঐ নারীর পেটে ছেলে না মেয়ে আছে তা পেট কেটে দুই ভাই মিলে পরীক্ষা করতো। যা ছিলো তাদের উপভোগ্যের বিষয়।
শুধু তাই নয়, কোনো সুন্দরী নারীকে দেখলে সে নারী সতী না অসতী তা, তারা দু' ভাই মিলে এই নারীকে ধর্ষণ করে পরীক্ষা করতো
একবার তাদের মা আম-দুধ দিয়ে ভাত খেতে চেয়েছিলো, এই অপরাধে তাদের মাকে তারা পুকুরের পানিতে ডুবিয়ে মেরেছে। তাদের মায়ের দোষ ছিল একটাই, এ সামান্য জিনিস তাদের মা তাদের কাছে চাইবে কেন।
সে পুকুরটি এখনও বিদ্যমান আছে। পুকুরের পানি নীল ও স্বচ্ছ, পুকুরের তিন পাড়ে ঝোপঝাড়। উত্তর পাড়ে আছে অব্যবহৃত একটি ঘাটলা।
যে বাড়িতে তারা থাকতো সেখানে আঁধার মানিক নামক একটি স্থান আছে। যেখানে জমিদারদের গুপ্তধন রাখা হতো, অর্থাৎ আঁধার মানিক হচ্ছে ধন ভাণ্ডার। আঁধার মানিক সম্পর্কে আপনি যদি স্থানীয়দের কাছ থেকে কিছু জানতে চান, তারা সবসময়ই পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে।
এই কারণে, আমার কৌতূহল আরো বেড়ে যায়।
সেখানে যাওয়ার পর স্থানীয় এক কৃষক আবিদ মিয়ার সাথে দেখা, তার সাথে অনেকক্ষণ কথা হয়।
তার কাছে আমাদের করা কিছু প্রশ্ন এবং তার উত্তর তুলে ধরছিঃ
১) লোহা ও গড় বিয়ে করেছিলেন কিনা?
আবিদ মিয়ার কাটসাট উত্তরঃ তাহলে মঠগুলো তৈরি করলো কে? আর এই মঠগুলো তাদের জ্ঞাতি গোষ্ঠীরাই এই মঠ তৈরি করেছে।
তিনি আরো বলেন, আঁধার মানিক থেকে প্রায় আধা কিলোমিটার দূরে তৈরি করা হয়েছিল একটি বৈঠকখানা, যা রং-মহল নামে পরিচিত ছিলো। যতো অসামাজিক, নোংরা কার্যকলাপ তারা দুই ভাই নাকি এই রং-মহলে বসে করতো। তাদের শাসন আমল যখন শেষ হয় তখন স্থানীয়রা সেখানে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন।
২) তাদের আয়ের উৎস ছিলো কী?
উত্তরে আবিদ মিয়া বলেনঃ তারা লবণের ব্যবসা করতো, কলকাতা থেকে লবণ এনে এদেশে বিক্রি করতো।
আবিদ মিয়া আরো বলেনঃ একদিন দুর্গাদির মেয়েকে বিয়ে করতে লোহা ও গড় গিয়েছিল দুর্গাদির বাড়িতে দুর্গাদি অস্বীকৃতি জানালে দু' ভাই মিলে দুর্গাদির মেয়েকে ধর্ষণের পর কেটে টুকরো টুকরো করে পানিতে ভাসিয়ে দেয়।
আমিঃ দুর্গাদি কে?
আবিদ মিয়া উত্তরে বলেনঃ দুর্গাদি ছিলো আরেক অত্যাচারী জমিদার, যিনি নিজেকে মেঘনার পূর্ব পাড়ে শক্তিশালী জমিদার মনে করতেন।
আবিদ মিয়া আরো বলেনঃ যে পুকুরে লোহা ও গড় গোসল করতো, সে পুকুর থেকে তাদের খাস-কামরা পর্যন্ত আঠারো মণ তাৎকালীন মুদ্রা দিয়ে তৈরি করেছিলো একটি রাস্তা।
যদিও সে রাস্তার সন্ধান পরবর্তীতে পাওয়া যায়নি। আজ থেকে ৫শ' বছর পূর্বে যখন লোহাগড়ের শাসন আমল শেষ হয় তখন তাদের তিন পুত্রঃ হারাধন রায়, রাম কেশব রায়, যুগেশ চন্দ্র রায় জমিদারী গ্রহণ করেন। আর তাদের মৃত্যুর পর তাদের কাজের মেয়ে তিন ভাইয়ের সমাধিস্থলে ৫টি বিশাল আকৃতির মঠ তৈরি করেন।
বর্তমানে তিনটি আছে, বাকি দুটি ভেঙ্গে গেছে।
আমি আমার আব্বুর কাছ থেকে শুনেছি, এই মঠেগুলোর উচ্চতা উপরে যতটুকু আছে নিচে আছে তার দ্বিগুণ।
আর যখন আবিদ মিয়া, আমার বড় আপিরা এবং আমার ভাই সহ মঠের সামনে গিয়ে দেখি, এর ইটগুলো গলে পড়ে যাচ্ছে।
আর শ্যাওলা ধরা এই ইটগুলোই বহুযুগের পুরোনো নিদর্শনের প্রতীক।
মঠের নিচ থেকে উপরের পুরো অংশ দেখতে হলে ঘাড় বাঁকা করে দেখতে হবে। এতে বোঝা যায়, এর উচ্চতা কতো বেশি।
কথায় কথায় আবিদ মিয়া বলে উঠেন, মঠ তৈরির পর অনেক বছর সে এলাকার আশপাশে কেউ নাকি চলাফেরা করতো না। কারণ হিসাবে জানা গেলো, মঠের ভেতর থেকে সবসময় উচ্চস্বরে কান্নার শব্দ শোনা যেতো। আর মঠের পাশ দিয়ে যেই আসা-যাওয়া করতো সেই নির্বাক হতো এবং এক সময় না ফেরার দেশে চলে যেতো।
তারপর আবিদ মিয়া চলে যায়, আমরা তাকে বিদায় দেই।
আমার জানামতে, এক সময় এই স্থানটি নাকি গহীন জঙ্গলে পরিণত হয়, যেখানে নাকি জ্বীন, ভূত, পেত্নীদের অবাধ আসা-যাওয়া ছিল। সাপ, শিয়াল, বেজি, বিচ্ছুসহ অনেক ভয়ঙ্কর প্রাণীদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল ছিলো এই মঠ এলাকা। আর কালের সাথে সাথে হারিয়ে যায় মঠ এলাকার গহীনতা, বেড়ে যায় মানুষের পদচারণা। মঠ এলাকা পরিণত হয় জনপদে।
আর এই মঠ তিনটি নিয়ে মানুষের কৌতূহলের শেষ নেই।
প্রতিদিন শত শত দর্শনার্থী দেশ-বিদেশ থেকে ছুটে আসে মঠ দেখতে, (আমরা যখন গেছিলাম তখন প্রচুর মানুষ ছিল সেখানে, তারা সবাই মঠ দেখতে আসছিল আমাদের মত)
এই মঠের ইতিহাস স্থানীয় কারো কাছ থেকে জানার জন্য।
যারা পুরোটা পড়েছেন তাদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
আমাদের দেশের এই প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনটার সম্পর্কে অনেকেই জানে না,
সম্ভব হলে আপনি পোস্টটি শেয়ার করে, আপনার ফ্রেন্ডদের জানাতে পারেন।
যদি সম্ভব হয়, একবার লোহাগড় মঠ দেখতে যাবেন।
যাওয়ার পথ খুবই সোজা, কিভাবে যেতে হয় সেইটা জানতে চাইলে আমার সাথে যোগাযোগ করতে পারেন।
যোগাযোগ করতে পারেন ফেসবুকে।
ফেসবুকে আমিঃ https://www.facebook.com/shiam.user
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই জুন, ২০১৪ রাত ১:২৪