আমরা যখন বেড়ে উঠছি; আমাদের স্বপ্নগুলো বেড়ে উঠছে খাল আর এবড়ো থেবড়ো রাস্তা পেরিয়ে
শহরমুখি। গ্রামের কৃষক মজুর কামার সুতোর ঘরামি জেলেদের ছেলেমেয়ে গ্রামের বিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে শহরমুখো হাঁটতে শুরু করেছে। কেউবা আবার রাজধানী মুখি । সেখানেই শিক্ষিত হওয়ার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়। সেই সময়ে মরা কালীনদীর ধারে ছোটো গ্রামের মানুষগুলো উত্তরসূরীর কাছে আশা করতে শুরু করেছে। সকাল-সন্ধ্যায় আলো আঁধারিতে ঐসব ছেলেমেয়েদের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ার সম্ভাবনার গল্পে আলোড়িত হতে থাকে কালীনদীর ধারের বটতলা বাজার। গ্রামের মানুষগুলোর মুখে আশা আর স্বপ্নের আভা ছড়িয়ে পড়ে। ওরা স্বপ্ন দেখেÑ একদিন কিশোর-তরুণেরা রক্ষা করবে ওদের, সুখী করবে, আর নিজেদের উন্নীত করবে মানুষের উচ্চতায়। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, জজ-ব্যারিস্টার আর বড় বড় অফিসার হয়ে পুলিশের প্যাঁদানি, আদালতের ধাপ্পাবাজি, আষাঢ়ের অভাব থেকে রক্ষা করবে ওদের । গ্রামের মানুষগুলোর রোগগ্রস্থ শরীর তাদের ডাক্তারির ছোঁয়ায় বেঁচে উঠবে।
কয়েক বছর পর গ্রামের সন্তানেরা ফিরে এলো কলেজ পেরিয়ে, বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়িয়ে। কেউ কেউ চলে গেল আরও দূরে। বিদেশে। যেখানে সর্বোচ্চ সুযোগ সুবিধা পাবে তারা। যারা গ্রামে ফিরে এসেছে; তারা জুটিয়ে নিল রাষ্ট্রের আধুনিক সুবিধা স¤প্রসারিত চাকরি। কেউ নিল স্কুলের মাস্টারি, কলকারখানার ম্যানেজারি, পৌরকর্মকর্তাগিরি, ওকালতি, কন্ট্রাকটারি। শিক্ষিতদের এই ধরনের সুবিধাজনক স্থানে আটকে যাওয়ার পরও গ্রামের মানুষগুলো ক্ষীণ আশায় ভর করে চলতে থাকে। অন্য কিছু না হলেও গ্রামে তাদের শিক্ষা , ভদ্র আচরণ দেখে বাচ্চা-কাচ্চারা ভালো কিছু শিখতে পারবে!
সময় গড়ালে গ্রামে ফেরা শিক্ষিতেরা চাকরি-ব্যবসায় অর্জিত নগদ টাকায় গ্রামের মাস্তান, টাউট, বাটপারদের মাধ্যমে মহাজনী কারবার শুরু করলো। আষাঢ়ের অভাব, রোগশোক, চিকিৎসা, পুলিশি মামলা, মেয়ে-বিয়ের যৌতুকের খরচ জোগাতে গ্রামের মানুষগুলো ওদের ঋণের শেকলে আটকে পড়লো। এখন পুরো গ্রামের দরিদ্র কৃষক মজুর কামার সুতোর ঘরামি জেলে চড়া সুদের ঋণের জালে জড়িয়ে গেছে। তাদের ঘরবাড়ি, হালের গরু, সন্তান, বৌ গ্রামে ফেরা শিক্ষিতদের বন্ধকি সম্পত্তি। তারপর গ্রামের মানুষগুলো আর স্বপ্ন দেখে না। তাদের চোখের সামনে কালীনদীর ধারে কুষ্টিয়ার ছোট গ্রাম, বটতলা বাজার, বাবুপুকুর, পশ্চিমের দিগন্ত জোড়া ধানক্ষেত, আমার বেড়ে ওঠার সব সময় শিক্ষিতদের দাপটে কাঁপতে থাকে।
এখন বাড়ি ফিরলে গ্রামের মানুষের স্বপ্ন-থেতলে যাওয়া চোখগুলো পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। আমি এখন চোখগুলো এড়িয়ে পালিয়ে পালিয়ে বাড়ি ফিরি। আমার বাড়ি ফেরা হয় ঠিকই ।
কিন্তু সেই গ্রামে আমার আর কখনোই ফেরা হয় না।
লেখক : দেলোয়ার জাহান, যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, চ.বি।