“চাচা দুঃখ করেন না আপনার সব জমি ফিরে পাবেন”
এই বলে একটি ফটোয়ালা কাগজ ধরিয়ে বলল টিপ দিতে। আমি মিনতি করে বললাম গ্রামের ছেলেরা আমার জমি কেড়ে নিয়েছে কিন্তু সে কথা বাবুর কানে পৌঁছাল না। গ্রামের কয়েকটি ছেলে বলেছিল-
চাচা আপনি যুদ্ধ করেছেন, মুক্তিযুদ্ধ সনদ নিয়ে নেন তাহলে কিছু সাহাজ্য পাবেন।
একজনকে সাথে নিয়ে গেলাম। তারা বলল কাজ হবে কিন্তু তাদের চা-পানের জন্য কিছু টাকা দিতে হবে। আমি অবাক হলাম। ভাবলাম কোন সনদ নয়, নেকড়েদের তাড়িয়েছি দেশ স্বাধীনের কাজে, সনদ কেনার জন্য নয়। একথা ভাবছি আর ধীর পায়ে হাঁটছি। হঠাৎ বাড়ির পাশের ছোট একটা ছেলে দৌড়ে এসে বলল-
দাদা চলেন সর্বনাশ হয়ে গেছে,দ্রুত চলেন।
আমি দৌড়ে বাড়ি গিয়ে দেখি অনেক মানুষের জটলা। কিছু ভাবতে পারছি না আমি। ঘরে গিয়ে দেখি আমার আদরের জরিনা ছেড়া কাপর পড়ে বসে আছে।ওর মুখে, শরীরে ছোপ ছোপ রক্ত ,মুখে কোন কথা নেই, আমাকে দেখেও না দেখার ভান করছে। মুখের দিকে তাকিয়ে একবার শুধু বলল “ওরা”, তারপরই আমার কোলে লুটে পড়ল। তাকে সান্তুনা দেওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে আমি বাকরুদ্ধ। আমার সোনা মানিকের শরীর ঠান্ডা, হাত দুটো দুদিকে ছড়ায়ে দিছে। ও নেই!! আমাকে ছেড়ে অনেক অনেক দুরে চলে গেছে যেখানে ওর মা গেছে দশ বছর আগে। ওর শরীরের ছোপ ছোপ রক্ত দেখে আমার বড়ই চেনা মনে হল।এই রক্ত তো দেখেছিলাম একাত্তরে। দৌড়দিয়ে পদ্মা পাড়ে গেলাম, দেখি ও গর্জে বুক ফুলিয়ে আছে। আমার দিকে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। অনেকের কাছে ধরনা দিয়েছি, কেউ ওই ছেলেদের বিচার করে নি, ওরা নাকি বড় বাবুর লোক। এমনকি গ্রামের সভ্য মানুষগুলো কবর দিতেও দিও না। তাদের অভিযোগ আমার সোনা মাণিক ধর্ষিত হয়েছে। ওনাদের সভ্য গোরস্থানে আমার সোনা মাণিকের দাফন হবে না। কি আর করা পদ্মা পাড়ের বালি খুড়ে রেখে দিলাম আমার সোনাকে। সেখানেও পদ্মার আপত্তি ছিল, বারবার গর্জে উঠে আমাকে শাসাচ্ছিল। কয়েকদিন পর দুই ছেলে চলে যাওযায় আমি একা হয়ে গেলাম। সবকিছু আগের মত চলছিল। কিছুদিন যেতে না যেতেই সবকিছু ঘোলা হয়ে এল। আমার ছোট খোকার কলেজে ছাত্ররা মাড়ামাড়ি করেছে। শুনলাম কয়েকজন খুন হয়েছে। কার মায়ের বুক খালি হল ভাবতে ভাবতে পাশের বাড়ির মইন মিঞার মোবাইল থেকে খোকাকে ফোন দিলাম। ফোন কেউ ধরে না, বারবার রিং হয় কিন্তু উত্তর নেই। মনের মধ্যে কেউ যেন জোর করে বলছিল “তোর খোকা নেই” কিন্তু আমার বিশ্বাস হল না। আবার ফোন দিলাম, রিসিভ হল, ওপাশ থেকে উত্তর এল
“সেলিম নেই”।
এ কথা শুনে আমি অবাক হয় নি। কারণ গত তিন দিন ধরে আমার বড় ছেলেটাকে পাওয়া যাচ্ছে না। কে বা কারা নাকি তুলে নিয়ে গেছে, অনেকে বলছে গুম হয়েছে, আর কখনো ফিরে আসবে না। ধীর পায়ে গেলাম পদ্মার পাড়ে। দেখি তার সেই আনন্দ, মহাসমরোহে তার স্রোত বইছে। জল যেন আরও চকচক করছে, নতুন সাজে সেজেছে পদ্মা আজ। আমার যন্ত্রণা দেখে ও আজ মহাখুশি। গ্রামের দিক থেকে চেঁচামেচি দেখে উঠে পড়লাম। বাড়ির কাছাকছি গিয়ে আমার আর পা নড়ছে না। পাড়ার ছেলেদের মধ্যে গন্ডগোল হওয়ায় একদল আগুন ধরিয়ে দিয়েছে, তার বলির পাঠা হয়েছি আমি। আমি স্তব্ধ, বাঁকরুদ্ধ, কিছু বের হচ্ছে না কন্ঠ দিয়ে। কোথায় যাবো? কার কাছে যাবো? কোন লাভ হবে না আমার, কেউ আমার কথা শুনবে না। আমি ধীর পায়ে রাতের অভিশপ্ত অন্ধকারে হেঁটে চলেছি পদ্মার দিকে। বিশাল উঁচু ঢিলার উপর বসে তাকিয়ে আছে পদ্মার বুকের ঠান্ডা শীতল পানির দিকে। ঠিক যেন শরৎচন্দ্রের মহেশ গল্পের কালো গরুর মত “ অবলা জীব কথা বলতে পারে না, শুধু চেয়ে থাকে আর চোখ দিয়ে জল পড়ে
রফিকুল ইসলাম
১০ মে ২০১৪, সকাল ৯.৩০
২২৭/শেরেবাংলা হল, শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই মে, ২০১৪ বিকাল ৩:৪০