ক্যান্টনমেন্ট মসজিদ থেকে মোয়াজ্জিন ফজরের আযান দিচ্ছিল। আজানের ধ্বনি যেন তার কানে মধু বর্ষণ করছিল। শুক্রবার ফজরের আজানের সময়েই ফারুক পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হয়েছিল। আজও আবার ফিরে এসেছে আরেক শুক্রবার। আজানের আওয়াজ তার কানে ঐ জন্মদিনের কথাই যেন স্মরন করিয়ে দিচ্ছিল। হয় সে নবজীবনের সূচনা করবে, আর না হয়, মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে। মনে হয়ে গেলো তার আন্ধা হাফিজের কথা। আন্ধা হাফিজের নির্দেশিত সুরা দুটি মনে প্রানে আর একবার পাঠ করে নিলো। তারপরই সে তার ঘাতক বাহিনীকে আগে বাড়ার নির্দেশ দিল। শুরু হলো ভয়ঙ্কর মিশনের দুরন্ত যাত্রা।
গন্তব্যের পথে ফারুক ক্যান্টনমেন্টের ডিপোতে থামলো। সে মনে করেছিল, কিছুটা গোলাবারুদ অথবা মেশিনগানের বুলেট তো অবশ্যই পাওয়া যাবে। কিন্তু অপ্রত্যাশিতভাবে কিছুই পাওয়া গেলনা। বনানীর রাস্তা ধরে, ডানদিকে মোড় নিয়ে ক্যান্টনমেন্টের চেক পয়েন্টের দিকে ফারুকের ট্যাংক বহর ধীরে ধীরে ছুটে চললো। পথে হাফপ্যান্ট আর গেঞ্জি পরা একদল লোকের সঙ্গে তাদের দেখা হলো। তারা ছিল সৈনিক। ঐ সময়ে তারা প্রান্তঃকালীন পিটিতে বেরিয়েছিল।
তারা সকলেই তাদের ডিল বন্ধ করে ট্যাংক বহরকে হাত উচিয়ে শুভেচ্ছা বিনিময় করলো। অত্যন্ত আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, ট্যাংকের অত বড় বহর প্রশিক্ষন এলাকা ত্যাগ করতে দেখেও কারও মনে কোন সন্দেহ জাগলো না। একমাত্র ফারুকের বাবা ডঃ রহমান ব্যাপারটা লক্ষ্য করলেন।
ক্যান্টনমেন্ট এলাকা থেকে বের হয়েই ট্যাংকগুলো দ্রুতগতিতে এগিয়ে চললো। দেয়াল ভেঙ্গে ঢুকে পড়লো এয়ারপোর্ট এলাকায়। একটা ট্যাংক পূর্বের নির্দেশমত সারি থেকে বেরিয়ে এসে রানওয়ে অবরোধ করে বসলো। আর একটি গেল হেলিপ্যাডের দিকে। সেখানে আধা ডজন হেলিকপ্টার পার্ক করা ছিল। বাকি সব ট্যাংক প্লান্ট প্রটেকশন সেন্টারকে পাশ কাটিয়ে ছুটে চললো রক্ষীবাহিনীর হেড কোয়ার্টারের দিকে। ফারুক তখন ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে সকাল ৫ টা ১৫ মিনিট হয়ে গেছে। ততক্ষনে ঘাতকদল তাদের গন্তব্যস্থলে পৌছে গেছে নিশ্চয়ই।
ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ীর অবস্থা গোলযোগপূর্ণ। ভোর সোয়া পাচটার মধ্যেই মেজর মহিউদ্দিন, নূর আর হুদার নেতৃত্বে পরিচালিত প্রধান ঘাতকদলটি শেখ মুজিবের বাড়ী পৌছে গিয়েছিলো। তাদের সঙ্গে পাঁচ ট্রাক ভরতি ১২০ জন সৈন্য আর একটি হাউইটজার ছিল। মিরপুর রোডের লেকের পাড়ে হাউইটজারটি শেখ মুজিবের বাড়ীর মুখোমুখি বসানো হলো। আরও কিছু ট্রাকে করে সৈন্য এসে পুরো বাড়ীটার চতুর্দিক ঘিরে ফেলে। তারপরি মেজরবৃন্দ আর তাদের লোকেরা ভেতরে ঢূকে পড়ে। ঐ সময় শেখ মুজিবের ব্যক্তিগত প্রহরীরা বারান্দায় গুমন্ত ছিলো। আনাগোনার শব্দ শুনে ওরা জেগে উঠে। গেইট দিয়ে অচেনা লোকদেরকে অস্ত্র নিয়ে ঢুকতে দেখে তারা তাদের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র থেকে গুলি চালায়। আর্টিলারির শামসুল আলমের মাথায় গুলি লেগে সঙ্গে সঙ্গেই সে মারা যায়। ল্যান্সার বাহিনীর আর একজন সৈন্য গুরুতরভাবে আহত হয়। সঙ্গীদের ঢলে পড়তে দেখে আর বাড়ীর ভেতর থেকে প্রচন্ড প্রতিরোধের কারনে সৈন্যরা তাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করে শত্রুর উপর ঝাপিয়ে পড়ে।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই শেখ মুজিবের দেহরক্ষীদের খতম করে দিয়ে তারা বাড়ীর ভেতরে ঢুকে পড়ে। ঢুকেই নীচতলার প্রতিটি রুম পালাক্রমে তল্লাসী করে দেখে। ইতিমধ্যে প্রচন্ড গুলি বিনিময়ের শব্দে হাউইটজার থেকে রকেট নিক্ষেপ করতে শুরু করে। রকেটের প্রথম দুইটিই ধানমন্ডি লেকের দুপাশে গিয়ে পড়ে। তারপর তারপর তারা তাদের কামান উচিয়ে আরও ছয় রাউন্ড রকেট নিক্ষেপ করে। একটিও লখ্যভেদ করতে সক্ষম হয়না। কামান থেকে এত বেশী জোড়ে রকেটগুলি নিক্ষিপ্ত হয়েছিলযে, এর একটা প্রায় চার মেইল দূরে মোহাম্মদপুরে এক বিহারীর বাড়ীতে গিয়ে পড়ে। ঐ রকেটের আচমকা আঘাতে দু ব্যক্তি নিহত
ও অনেক লোক আহত হয়।
শেখ মুজিবের ছেলে শেখ কামাল আর শেখ জামাল সঙ্গে সঙ্গে তাদের স্টেনগান হাতে নিয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু বেশীক্ষন টিকতে পারেনি কামাল
সিড়ির গোড়ার দিকেই গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে সে। শেখ মুজিব নিজেও খুব তাড়াতাড়ি কিছু প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়ে আক্রমন ঠেকানোর চেষ্টা চালান। প্রথমেই তিনি টেলিফোন করেন রক্ষীবাহিনীর সদর দপ্তরে। সেদিন রক্ষিবাহিনীর কমান্ডিং অফিসার ব্রিগেডিয়ার নূরুজ্জামান আর কর্নেল সাবিহুদ্দিন দেশে ছিলনা। তিনি বহু চেষ্টা করে অন্য কোন সিনিয়র অফিসারকেও মিলাতে পারলেন না। উপায় না পেয়ে তিনি সেনাবাহিনীর স্টাফ প্রধান, জেনারেল শফিউল্লাহকে ফোন করেন এবং তার মিলিটারী সেক্রেটারী মাশহুরুল হককে ফোন করে অবিলম্বে সাজায্য পাঠাবার নির্দেশ দেন। সর্বশেষ ফোন করেন সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের ডাইরেক্টর কর্নেল জামিলকে।
এরই মধ্যে বাড়ীর সর্বত্র ওরা ছড়িয়ে পড়েছে। মেজর বাহাউদ্দিন, হুদা আর নুর বাড়ীর প্রতিটি কামরা মুজিবের খোজে তন্ন তন্ন করে চষে বেড়াচ্ছে। হঠাত অপ্রত্যাশিতভাবে মহিউদ্দিন মুজিবকে পেয়ে গেলো। সে দুতলায় উঠতে সিড়ির গোড়ায় পা ফেলতেই শেখ মুজিবকে দাঁড়ানো অবস্থায় দেখতে পায়। তাদের মধ্যে দূরত্ব ২০ ফুটের বেশী হবেনা। শেখ মুজিবের পরনে একটি ধূসর বর্ণের চেক লুঙ্গি আর সাদা পাঞ্জাবী। ডান হাতে ছিলো ধূমপানের পাইপটি। শেখ মুজিবকে হত্যা করার দৃঢ় মনোবল নিয়ে এ অভিযানে বেরুলেও মহিউদ্দিন শেখ এর সামনা সামনি দাঁড়িয়ে পুরোপুরিভাবে মনোবল হারিয়ে ফেলে। মহিউদ্দিন আমতা আমতা করে তাকে বলেছিল, স্যার আপনি আসুন।।
'তোমরা কি চাও?' মুজিব অত্যন্ত কর্কশ ভাষায় জিজ্ঞেস করলো। 'তোমরা কি আমাকে খুন করতে চাও? ভুলে যাও। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী তা করতে পারেনি। তোমরা কি মনে করো, তা করতে পারবে?
মুজিব স্পষ্টতই সময় কাটাতে চাচ্ছিলেন। তিনিতো আগেই বেশ কয়েক জায়গায় ফোন করে রেখেছে। ইতিমধ্যে নিশ্চয়ই লোকজন তার সাহায্যে ছুটে আসছে। সেই সময়ে তিনি অত্যন্ত সাহসের পরিচয় দিচ্ছিলেন।
মহিউদ্দিন তখনও ঐ একই কথা বলে চলছিলো "স্যার আপনি আসুন" আর অন্যদিকে শেখ মুজিব তাকে অত্যন্ত কড়া ভাষায় ধমকিয়ে যাচ্ছিলেন। এমন সময় নূর এসে পড়ে। তার হাতে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র। সে বুঝে ফেলে, মুজিব সময় কাটাতে চাইছেন। মহিউদ্দিনকে একপাশে সরিয়ে নিয়ে নূর চিতকার করে আবোল তাবোল বকতে বকতে তার স্টেনগান থেকে মুজিবকে লক্ষ্য করে ব্রাশফায়ার করে। শেখ মুজিব তাকে কিছু বলার সুযোগ পেলেন না। স্টেনগানের গুলি তার বুকের ডানদিকে একটি বিরাট ছিদ্র করে বেরিয়ে গেলো। গুলির আঘাতে তার দেহ কিছুটা পিছিয়ে গেলো। তারপর নিস্তেজ হয়ে তার দেহ মুখ থুবড়ে সিড়ির মাথায় পড়ে গেলো। বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের মহান নেতার নিথর দেহ সিড়ি দিয়ে কিছুদুর গড়িয়ে গেয়ে থেমে রইল........ তার ধূমপানের প্রিয় পাইপটি তখনও তিনি শক্তভাবে ডান হাত দিয়ে ধরে রেখেছিলেন।
সময় তখন সকাল ৫ টা ৪০ মিনিট। বাঙ্গালী জাতির সাথে শেখমুজিবের প্রচন্ড ভালোবাসার চিরতরে অবসান ঘটলো।
[তথ্যসূত্রঃ Anthony Mascarenhas; Bangladesh: A legacy of Blood]
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই আগস্ট, ২০১৪ রাত ১১:৫৪