প্রায় চলন্ত বাসটায় লাফ দিয়ে উঠে পড়লো ছেলেটা। কোন মতে তাল সামলে নিয়েই পলিথিনে মোড়ানো অনেকগুলো থেকে একটা কাগজ বের করে.....
"অ্যাই পেপার..পেপার..পেপার ...
বাংলাদেশ প্রতিদিন! আমাদের সময়!
আইয়্যে পেপার ...পেপার লন ...."
বলে তারস্বরে চিৎকার করা শুরু করলো।
কানটা ঝালাপালা হওয়ার উপক্রম! সকাল
সকাল মেজাজ খারাপ হওয়ার জন্য এই
চিল্লাচিল্লিই যথেষ্ট।
তবে নাফিসের মেজাজ খারাপ
হতে বাঁধা দিলো ছেলেটার প্রচন্ড
মায়াবী চেহারা! বয়স বড়জোর ছয় কি সাত। বড় বড় চুল বেয়ে টপটপ করে পানি ঝরছে। গোটা শরীর ভিজে চুপচুপে। ছোকরা আষাঢ়ে বৃষ্টির কবলে পড়েছে!
-ভাই প্যাপার...
ক্ষুদে হকারের কন্ঠে নাফিসের ভাবনার তার
ছিঁড়ে গেলো!
-না..না লাগবেনা।
গোলগাল চোখ দুটোতে নিষ্প্রাণ আঁকুতি! যেন বলছে,
"নেননা ভাই একটা পেপার "
উপেক্ষা করা হলো মায়া মায়া চোখ জোড়ার অনুরোধ! কলেজে যাওয়ার সময় পেপার কিনবো? খেয়ে দেয়ে কাজ নেই!
চুপচাপ বসে রইলো নাফিস।
***
-শালা ...হারামীর বাচ্চা!
আমারে পুরা ভিজায়া দিছস!
অপর সারিতে বসা এক ভদ্রলোকের চিৎকারে পাশ ফিরে তাকালো নাফিস।
ঘটনা বোঝার আগেই পেপারসুদ্ধ
ছেলেটা নাফিসের গায়ে এসে পড়লো।
"কি হইছে আঙ্কেল?" জিজ্ঞেস করলো সে।
"আরে হারামজাদা আমার প্যান্ট
ভিজিয়ে দিছে! ময়লা পানিগুলি সব ফালাইছে ...এই যে..."
ভদ্রলোকের দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকাতেই ওনার হাঁটুর উপর তিন চার আঙুলের
মতো জায়গা ভেজা দেখতে পেল নাফিস।
ভদ্রলোকের পাশে হেলান
দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো বোধহয় ছেলেটা।
পেপার মোড়ানো পলিথিনের পানি গড়িয়ে পড়াতেই বিপত্তি!
ক্ষুদে হকারের গাল লাল হয়ে আছে।
নেমে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
"এই..এদিকে আয়।"
নাফিস ডাক দিলো ছেলেটাকে।
"প্যাপার লাগবো?"
"সকালের খবর থাকলে দে।"
"আছে ..এই লন"
পেপার নিয়ে টাকা দিলো নাফিস।
"ভাংতি নাই? পাঁচ টেকার প্যাপার
নিয়া পঞ্চাশ টেকা দেন ক্যা?"
"নাই তোর কাছে ভাংতি?"
"পাইতিরিশ টেকা আছে"
"নাস্তা করিস।"
ত্রিশ টাকা নিয়ে বাকি টাকা পিচ্চির হাতে দিয়ে বললো নাফিস। ছেলেটাকে আলতো করে চড় মারতে গিয়ে হাতে যেন ছ্যাকা খেলো সে!
"কিরে! তোর শরীর এতো গরম কেন?"
"বিষ্টিতে ভিজ্যা জ্বর আইছে মনে কয়!"
বললোহকার বালক।
পাশ থেকে এক ভদ্রলোক বলে উঠলো,
'ব্যাঙের আবার সর্দি!'
নাফিস ওদিকে ভ্রুক্ষেপ করলো না।
ওষুধ কেনার কথা বলে আরো কিছু টাকা গুঁজে দিলো ছেলেটার হাতে।
চোখমুখে একরাশ আনন্দ নিয়ে ছেলেটা বাসথেকে নেমে গেলো।
***
বেশ কয়েকদিন পর.....
থার্মোমিটার মুখে শুয়ে আছে নাফিস। বাসায় ডাক্তার এনেছে আব্বু। অথচ যন্ত্র বলছে জ্বর মাত্র ১০০ ডিগ্রি!
সেদিন শখ করে বৃষ্টি বিলাসের অনুপাতে সামান্যই বলা যায়। তবুও একটু কিছু হলেই আব্বু ডাক্তার এনে টেনে হুলস্থুল কান্ড ঘটায়। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
***
ব্যতিক্রম হয়নি আরো একটি জায়গায়।
মধুবাগের ছোট্ট বস্তিটার জীর্ণশীর্ণ এক
ঘরে জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে ছয় কি সাত বছরের
একটি বালক। বড় বড় চুলগুলো ভিজে আছে উদ্বিগ্ন মায়ের ঢেলে যাওয়া শীতল পানিতে। গোল গোল চোখ দুটো যেন আগুনের ফুলকি হয়ে আছে।
মেললেই পুড়ে যাবে মানুষের মাঝে ভেদাভেদ তৈরি করে দেয়া মুখোশ পরা ভদ্রলোকগুলো।
তবে সুখের বিষয় এই যে, ছোট্ট বালকটা আর চোখ খুলে তাকায় না। পুড়িয়ে দেয়া হয়না গরীব বিদ্বেষী স্যুট টাই
পরা ভদ্রলোকদের।
***
প্রতিদিন শত শত খবরের কাগজে ছাপা হবে আকর্ষণীয় সব গরম গরম খবর।
শুধু অপ্রকাশিত থেকে যাবে ক্ষুদে হকারের
সাদামাটা ছোট্ট গল্পটা।