হেমন্তের ঝরঝরে বিকেল। নীল শাড়ি পরা আকাশের গায়ে কোন সাদা প্রিন্ট নেই। আছে অনেক গুলো ঘুড়ি। তার মধ্যে একটা ঘুড়ি নিলয়ের। বাবা - মায়ের একমাত্র সন্তান। বেশি আদরে বখে যায়নি। তবে ঠিকঠাকপড়াশুনা করলেও ঘুড়ি ওড়ানোর মৌসুমে ওটাই তার একমাত্র কাজ। নেশাও বটে!
বাড়িটা নিজেদের হওয়ায় ছাদটিতে অবাধ বিচরণে কোন বাঁধা নেই। আজকের বিকেলটা খুব সুন্দর। নিলয়ের ঘুড়িটাও সুন্দর। আকাশ আর ঘুড়িকে আলাদা করার উপায় নেই! নীল ঘুড়িটাকে দেখে অযথাই বিস্মিত হচ্ছে নিলয়। মাঝে মাঝে আকাশ ভেবে ভুল করছে!
আরো একজোড়া বিস্মিত চোখ একই ভুল
করে যাচ্ছে। নিলয় সেটা দেখছেনা।
অথচ মেয়েটা ঠিক সামনের ছাদেই।
****
প্রতিদিনের মতো আজও ভারী নাটাইটি নিয়ে নিলয় ছাদে । আকাশের অবস্থা খুব একটা ভালো না। যুদ্ধ হচ্ছে খুব। কাঁটাকাঁটির যুদ্ধ!! সব যুদ্ধেই কৌশল টা অনেক বড় অস্ত্র। অস্ত্র প্রয়োগে নিলয়ের জুড়ি মেলা ভার। এজন্য আশেপাশের ঘুড়ির রাজ্যে ওর একচ্ছত্র অধিপত্য! ঠোঁটে বিদ্রুপের হাসি নিয়ে ঘুড়িটা উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টায় মগ্ন নিলয়।
ওর শিকারি চোখ পড়ে আছে একটা লাল সাদা ঘুড়ির উপর। ঘুড়িটা সুন্দর আর খুব দাপটের সাথে উড়ে বেড়াচ্ছে। ব্যাপারটা নিলয়ের ভালো লাগছেনা! তবে এই মুহূর্তে ঘুড়ির ড্রাইভারকে দেখলে ঠিকই ওর ভালো লাগতো।
নাটাই হাতে ঘুড়ি ওড়ানোরত অবস্থায় একটা মেয়েকে দেখলে কার না ভালো লাগবে!!?
****
এতক্ষণে নিলয় বুঝতে পারলো ঘুড়ির ড্রাইভার ঠিক সামনের হালকা উঁচু ছাদটাতে অবস্থান করছে। অপর প্রান্তে থাকায় দেখা যাচ্ছে না। যদিও দুরত্ব বলতে রাস্তার এপার ওপার। পাকা ড্রাইভার নিলয়ের রাগ এখন চরমে। ঘুড়িটাকে কোনভাবেই বাগে আনা যাচ্ছেনা! যুদ্ধটা ডু অর ডাই পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। সময়ের সাথে সূর্যটাও গড়িয়ে যাচ্ছে আঁধারের দিকে।
অবশেষে নিষ্পত্তি...
নিলয়ের বুকে কে যেনো গরম পানি ঢেলে দিলো! ওর সবচে প্রিয় নীল ঘুড়ির একটা হারিয়ে গেছে। দুঃখে অপমানে ছেলেটার চোখ ঝাপসা হয়ে আসলো। আর মেয়েটা হাসি হাসি মুখ করে নীল ঘুড়িটা হাতে রেলিংয়ের ধারে দাঁড়িয়ে থাকলো ।
ব্যাপারটা বুঝতে নিলয়ের বেশ খানিকটা সময় লাগলেও শেষমেশ অপমান বোধটা বিস্ময়কে ছাড়িয়ে গেলো। ক্রুদ্ধ ছেলেটার সব ঘৃণা উপচে পড়লো ওই ঘুড্ডিওয়ালী ছায়ামূর্তির উপর।
****
বিছানায় শুয়ে জুস পান করছে নিলয়। সেদিনের ঘটনা এখনো দুঃস্বপ্ন হয়ে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে তাকে। মরার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে জুটেছিলো সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত নামতে গিয়ে পা মচকে ফেলা। এক সপ্তাহ বিছানায় পড়ে থাকার কারণ ওটাই।
নিলয়ের চিন্তায় অদ্ভুত মেয়েটা...
ওড়াতে পারে ভালো কথা!! তার উপর আবার আমারটা কাঁটে!! দাঁড়াও... পা টা ভালো হোক মজা দেখাবো!" এসব
ভাবতে ভাবতেই ক্লান্ত ছেলেটা আবার দুঃস্বপ্ন দেখা শুরু করলো।
গত সাতদিনের মতো আজও মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে ছাদে। হাতে একটা নীল ঘুড়ি। "ছেলেটা খুব অহংকারী বোধহয়। সেদিন কি ভাবটাই না নিলো! ইস... ভাবের ঠেলায় এক সপ্তাহ যাবত লাপাত্তা। এসব চিন্তা মেয়েটিকে বিরক্ত করে তোলে। বরাবরের মতো আজও বিকেলটা ফুরিয়ে যায়। ঘুড়িটা ফেরত দেয়া হয়না!
****
হাতে নাটাই আর একটা হিমু কালারের ঘুড়ি নিয়ে বেশ সাবলীলভাবেই ছাদে ঘুরে বেড়াচ্ছে নিলয়। সামনের ছাদে কেউ নেই। প্রতিদ্বন্দ্বিনীকে না দেখতে পেয়ে ভালোই লাগছে। তবে ভালো লাগাটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলোনা। ঘুড়ি ওড়ানোর প্রস্তুতি নিতেই,
-এই ছেলে ...
তীব্র মেয়েলি কন্ঠ শুনে নিলয় একটু চমকে উঠে। কোন ফাঁকে মেয়েটা চলে আসলো! অবাক হয়ে সে ভাবছে। চিন্তায় বাঁধা দিলো আরেকটি ডাক।
-এই যে....শুনছো!!
-কি?
নিলয় বিরক্ত!
-সেদিন ঘুড়ি ফেলে পালালে কেন?
-ফাইজলামি করো? আমি পালিয়েছিলাম?
-পালালেই তো...আমিতো জানি যে নীল ঘুড়িটা তোমার।
শখ করে কেঁটেছিলাম! ফেরতও দিতে চেয়েছি। তুমি তো সেদিন কথাই বললে না।
-হইছে ...আর ন্যাকামী করা লাগবেনা।
ঘুড়ি ফেরতও দিতে হবেনা ...যত্তসব।
নিলয়ের মুডটাই খারাপ হয়ে যায়। ছাদ
থেকে নেমে আসে ও। পেছনে রেখে যায় হিমু ঘুড়ি আর একটা মন খারাপ করা অনুভূতি!
***
মেয়েটার কন্ঠটা এতো সুন্দর কেন? চেহারাটা এতো ইনোসেন্ট কেন? চোখ দুইটা এতো গভীর কেন? এসব প্রশ্ন নিজের কাছেই করে যাচ্ছে ছেলেটা। উত্তর জানার উৎস কি হতে পারে বুঝতে পারছে না। তবে এটুকু বুঝতে পারছে যে,মেয়েটির
সাথে ভালো আচরণ করা উচিত ছিলো।
বিকেল হতে না হতেই নিলয় ছাদে দৌড়! অপেক্ষার আকাশে সন্ধ্যা নামছে। অস্থির পায়চারীতে মুখর ছাদটির একপাশে হলুদ
ঘুড়িটা পড়ে আছে। শুধু নেই ঘুড্ডিওয়ালী চঞ্চল মেয়েটা।
****
সপ্তাহটা মাসের মতোই কাটলো নিলয়ের
সাতটা দিন ছাদ-জানালা করে সময় কাঁটিয়েছে সে। দুই জায়গাতেই খুঁজে ফেরা হয়েছে ঘুড্ডিওয়ালিকে। কোথাও কেউ নেই। ছাদে দাঁড়িয়ে এসব কথাই ভেবে যাচ্ছে ও। মাসের প্রথম দিনে বাসা শিফটের মিছিল । ওদের কয়েকটা ফ্লাটও মিছিলে যোগ দিয়েছে। বোরিং দৃশ্য গুলো টাইম পাসের উপকরণ হয়ে গেলো।
হঠাৎ চোখ ছোট করে ফেললো নিলয়।
একটা নীল ঘুড়ি! ঠিক সেটার মতো।
পরক্ষণেই একটু হতাশ। একটা পিচ্চি ছেলের হাতে ঘুড়িটা। খুবই স্বাভাবিক দৃশ্য। অযথাই বিরক্ত নিলয় নেমে যাচ্ছে নিচে। অধৈর্য ছেলেটা একটু অপেক্ষা করলেই দেখতে পেতো... সেই চঞ্চল হাতে লাল সাদা ঘুড়ি সহ একটা নাটাই। নাটাইয়ের মালিক ওদের গেটেই ঢুকেছে!
****
ভারী নাটাইটা আরো ভারী হয়ে গেছে।
নিলয়ের হাতে ওঠেনা অনেকদিন। গত
কয়েকটা দিন ছাদেও যাচ্ছেনা মনমড়া ঘুড্ডিওয়ালা!
ঘুড়ি ওড়ানোর মৌসুম প্রায় শেষ। আজই লাস্ট। এই ভেবে নাটাই তুলে নেয় নিলয় সাথে একটা সাদাকালো ঘুড়ি। হঠাৎ দেখলো সেই পিচ্চিটা ছাদেই ঘুরঘুর করছে।
"কি ব্যাপার! এই পিচ্চি আমাদের
ছাদে কেন?"
নিলয়ের কৌতুহল আকাশ ছোঁয়!
-ওই পিচ্চি ... কে তুমি? ছাদে কি করো?
-আমি নাবিল। এই বিল্লিংয়ে নতুন আসছি ।
-একা একা ছাদে কেন?
-ঘুড়ি ওড়ানো দেখতে আসছি।
-কিসের ঘুড়ি!? কে ওড়াবে?
-আমার আপ্পি ওড়াবে।
পিচ্চির কথার আগামাথা কিছুই ও
বুঝতে পারলোনা। চিন্তায় ছেদ
পড়লো একটা তীব্র মেয়েলী কন্ঠে!
"এই যে তোমার ঘুড়ি!"
নিলয়ের চোখে একটা মেয়ে। নীল জামায় মোড়ানো। হাতে একটা নীল ঘুড়ি। আকাশের সব নীল মেয়েটা চুরি করতে পারে!? নাহ!!
এতো সুন্দর মেয়েটা চুরি করবে কেন!?
আকাশই ওকে গিফট করেছে বোধহয়!!
-ঘুড়িটা কি নিবা?
-হ্যাঁ ...হ্যাঁ ..
-ওই বাসাটা ভালো লাগছিলো না। তাই আব্বুকে বলে এখানে শিফট্ করালাম। এইটা ভালোই...তারচেয়ে ভালো ছাদটা।
তিনতলায় উঠেছি আমরা। তুমি কয়তলায়?
-চার তলার বাম পার্শ্বে...
-ওইটা তো বাড়িওয়ালার ফ্লাট!
-হুম...
-তারমানে বাসাটা তোমাদের?
-হ্যাঁ
-তাহলে তো ভালোই।
একসাথে ঘুড়ি ওড়ানো যাবে। নীল মেয়েটা নীল ঘুড়ি নিয়ে ব্যস্ত। ছোট।ভাইটাকে কি যেনো একটা কাজে পাঠিয়ে দিলো!
নিলয় মুগ্ধ হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না!
"ঘুড়িটা দাও"
ওড়ানোর আয়োজন শেষ। নিপুণ
হাতে নাটাই ধরে আছে মেয়েটা। নীল ঘুড়িটা এখন আকাশে। আর নীল মেয়েটা নিলয়ের খুব পাশে! মেয়েটার একটা নাম দেয়ার কথা ভাবছে। ঘুড্ডিওয়ালি দিলে কেমন হয়!!?
-আমি নীলা
হায় হায় মেয়েটা মন পড়তে পারে!!
"এই....নাটাইটা ধরো তো..." নীলা বললো।
মনের কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে চাচ্ছে নিলয়। বাধা দিচ্ছে মেয়েটার অবাধ্য চুল। খুব পাশে দাঁড়ানো নিলয়ের মুখে যেন চাবুক পড়ছে!
-এই যে বোবা ঘুড্ডিওয়ালা! নাটাইটা কি ধরবা?
-আমি নিলয়।
-আচ্ছা ...আচ্ছা ...নিলয়... নাটাইটা ধরো।
অমনোযোগী নিলয়ের হাতে নাটাই দিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে থেকে মুগ্ধ হয় নীলা! যার ঘুড়ি তার হাতেই ভালো মানাচ্ছে। এটাই হয়তোবা মুগ্ধ হওয়ার কারণ! নিলয়ের রাগ হচ্ছে। মেয়েটা নাটাই হাতে দিয়ে সটকে পড়েছে! অথচ ওকে খুব দেখা দরকার!
-এবার আমি ওড়াই?
নিলয়কে আবার মুগ্ধ হওয়ার সুযোগ করে দেয় নীলা। এই মেয়েকে নিয়ে অনায়াসেই
হারিয়ে যাওয়া যায়!
"ও হবে নীল ঘুড়ি অথবা আকাশের নীল শাড়ি! আমি হবো ছোপ ছোপ সাদা প্রিন্ট!"
নিলয়ের চিন্তায় এবার বাঁধা পড়েনা।
বোধহয় একই চিন্তায় মগ্ন মেয়েটা বাঁধা দেয়ার সুযোগই পায় না।
নীল ঘুড়িটা সুতোর অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে।
সাথে নিয়ে যাচ্ছে নীলে মোড়ানো একজোড়া মিষ্টি অনুভূতি!