নিচের ছবিটি গত বছর আমার বারান্দার ব্যালকনি থেকে তোলা । তখনো শীত শুরু হয় নি । সবে মাত্র হালকা স্নো পড়া শুরু হয়েছিল ।
কুমিল্লা শহর !
২০০৩ সাল ডিসেম্বর মাস ! মফস্বল থেকে ক্লাস ফাইভের বৃত্তি পরীক্ষা দিয়ে ডিসেম্বরে ই মাসেই বাবা আমাকে শহরে নিয়ে আসে । বাবার উদ্দেশ্য আমাকে জিলা স্কুলে পরীক্ষা দেওয়াবে । নিকট আত্মীয় একজনের বাসায় উঠলাম । এক জন শিক্ষক ঠিক করে , রাস্তা চিনিয়ে পরদিন বাবা গ্রামে ফিরে গেলেন ।
ওত টুকু বয়সে শহরের দালান কোঠায় আবদ্ধ জীবন আমার ভালো লাগে নি । সকাল ৬ টায় ঘুম থেকে উঠে ৭ টায় স্যারের বাসায় পড়তে যাওয়া । পড়া শেষ করে বাসায় ফিরে আসা । প্রথম প্রথম স্যার কে খুব ভয় পেতাম । সব সময় স্যার সিরিয়াস থাকতেন । গ্রামের শিক্ষকদের মত হাসি-তামাশা করে পড়া শুরু করার মত নয় ।
বিকেল হলেই খুব খারাপ লাগতো । কারণ , শহরের নিয়ম হলো বিকেল ঘুমানো । কিন্তু আমাদের গ্রামের নিয়ম হলো বিকেল বেলা , স্কুল থেকে এসে ব্যাগ ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে খেলার মাঠে যাওয়া । ক্রিকেট , গোল্লাছুট , লুকোচুরি আরো কত কি খেলা । কিন্তু , শহরের আমার বন্ধি জীবন সেটার সুযোগ যে আমার নেই । বাসার সবাই ঘুমিয়ে পরতো কিন্তু কোনদিন আমার ঘুম আসে নি । আত্মীয়ের বাসায় তখন রঙিন টেলিভিশন ও ডিশ আছে । লুকিয়ে লুকিয়ে টিভি দেখতে চাইতাম কিন্তু আত্মীয়ের ধমক খেয়ে আবার ফিরে যেতাম । তখন গ্রামে টেলিভিশন থাকা যে কি সেটার বলে বোঝানোর মত না । এক গ্রামে ২/১ টা বাড়িতে মাত্র টেলিভিশন থাকত । আবার কোন কোন গ্রামে টেলিভিশন ই থাকতো না । তখন , শুক্রবার মানেই পিঁড়ি , পাটী বিছিয়ে বসে যেতাম সিনেমা দেখতে । আগে গেলে আগে জায়গা পাওয়া যাবে এটাই নিয়ম ছিলো । আবার কখনো কখনো লোকজন বেশি হওয়ার কারনে টেলিভিশনের মালিক ইচ্ছা করেই টেলিভিশন বন্ধ করে দিত । সেখান থেকে এসে শহরের রঙিন টেলিভিশন এর প্রতি সেই জন্যই একটু আগ্রহ বেশি ছিলো ।
ভর্তি পরীক্ষায় ফেল করলাম । বুঝতে পারছিলাম , বাবা খুব কষ্ট পেয়েছিলো । তারপর শহরের অন্য একটি স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিলো । কিন্তু বাবা আমাকে গ্রামে ফিরে নিয়ে যায় নি । তখন , আত্মীয়ের বাসায় ছেড়ে বাবা আমাকে হোস্টেলে উঠিয়ে দিলো । সেখানে তো বন্ধি জীবন । রটিন- মাফিক সব কিছু করতে হয় । কিছুই ভালো লাগে নি তখন । সারা দিন কান্না করতাম । কখনো বা কান্না করতে করতে ঘুমিয়ে পরতাম । প্রতি সপ্তাহে বা পনের দিন পরে বাবা এসে দেখা করে যেত । অনেক কিছু কিনে দিত । কিন্তু , আমি গ্রামে যাব বাবাকে এই কথা বলার সাহস তখন আমার হয় নি । মাঝে মাঝে বাবা আসতে না পারলে অন্য কোন আত্মীয় পাঠাত আমার সাথে দেখা করতে তখন আত্মীয় কে খুব কান্নাকাটি করে বলতাম আমাকে বাড়ি নিয়ে । কিন্তু কোন আত্মীয় আমাকে বাড়িতে নিয়ে যায় নি । এখনো মনে পড়ে , বাবার সাথে বড় ভাই আমার সাথে দেখা করতে এসেছিলো । আমার কান্না দেখে বড় ভাই নিজেই কান্না করতে করতে বাবাকে বললো আমাকে সাথে করে নিয়ে যেতে কিন্তু বাবা নেয় নি । এইসব ঘটনা যখন পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকে তখন বাবা এক সময় জেদ করে আবার গ্রামের স্কুলে নিয়ে ভর্তি করিয়ে দেয় । আবার আমার গ্রামে ফিরে চলা । এক সময় গ্রাম থেকেই এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে দিলাম ।
ঢাকা শহর !
২০১০ সালের জুলাই ।
আবার শহরে ফিরে আসা । এইবার আমার ইচ্ছাতেই ফিরে আসা । নটরডেম কলেজে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে সুযোগ পেয়ে ভর্তি হয়েছি । প্রবল ইচ্ছার টানে শহরের জীবন শুরু করি ।কিছুদিন পর বুঝতে পারি শহর আমার জন্য নয় । তখন মেসে উঠেছিলাম গার্মেন্টস চাকরি জীবিদের সাথে । কারণ , কোন নিকট আত্মীয় তাদের বাসায় জায়গা নেই বলে রাখে নি । কলেজ থেকে এসে আমার মত করে ঘুমিয়ে পরতাম । সন্ধ্যায় রুমমেট রা চাকরি থেকে এসে হাসি -ঠাট্টা , তাস খেলা আরো কত কি করতো । তখন ঐ পরিবেশ টা আমার পড়ার জন্য উপযুক্ত ছিলো না সেটা আসতে আসতে বুঝতে পারি । এক নিকট আত্মীয় পরামর্শ দিলো ," তুই যদি কলেজ পাশ করে ভালো কোন ভার্সিটিতে সুযোগ না পাস তাহলে ন্যাশনাল ভার্সিটিতে পড়ে ৭/৮ বছর লেগে যাবে অনার্স পাস করতে । তার চেয়ে তুই পলিটেকনিকে ভর্তি হয়ে যা । ঐখান থেকে ৪ বছরে পাশ করে একটা চাকরি পেয়ে যাবি " । ওনার এই কথাটা আমার খুব মনে ধরেছিলো ।
কিছুদিন পর পলিটেকনিকে পরীক্ষা দিলাম । রেজাল্টে জানতে পারলাম আমি কুমিল্লায় সুযোগ পেয়েছি । বাবাকে বললাম , আমি নটরডেম ছেড়ে দিব । বাবার উত্তর বলে বোঝানোর মত না । অনেকটা বাবার অ-মতে নটরডেম কলেজ ছেড়ে আমার কুমিল্লায় ফিরে যাই । সে খানেই আমার ঢাকার জীবন সমাপ্তি হয় ।
পলিটেকনিকে ভর্তি হয়ে ঐ এলাকার একজন আমাকে লজিং করে দেয় । তিন বেলা থাকা-খাওয়ার বিনিময়ে তাদের একজনকে পড়ানো । খুব নিকট লোকজন ছাড়া কাউকেই আজ পর্যন্ত এই লজিং কথা কাউকেই বলি নাই । কেন বলতে চাইতাম না সেটা সত্যি আমি জানি না । হয়ত ব্যাপারটা তখন অন্য ভাবে নিত । পলিটেনিক শেষ করলাম । অনেক টা নিজের যোগ্যতায় চাকরি পেলাম আরএফএল কোম্পানিতে । পোস্টিং ,হবিগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক , সিলেট । তল্পিতল্পা সহ চলে যাই হবিগঞ্জে । যেখানে কোম্পানি থেকে আমাকে কোয়ার্টারে থাকতে দেওয়ার হয় । ভাল ভাবেই দিন গুলো চলে যাচ্ছিলো । অল্প কিছু দিনে খুব ভালো কিছু কলিগ পেয়ে যাই । এবং আমার সিনিয়র বস আমাকে খুব ভালো ভাবেই দেখতেন । সব সময় বলতেন , কম চাপ দিতে । কিন্তু কিছু দিন চাপ বাড়তে থাকলো । কারণ, ইন্ডাস্ট্রি এর ভিতরে যে কোন জায়গায় যে কোন কন্সট্রাকশান কাজে দরকার হলে একমাত্র আমাদের দু-জন কেই ডাক দিত । কারণ , আমরা কমন ডিপার্টমেন্টের ইঞ্জিনিয়ার । সবার কমন সমস্যা গুলোই সল্ভ করাই আমাদের দায়িত্ত ছিলো । কিছুদিন পর অফিসিয়াল নোটিশ এলো , আমাকে অন্য আরেকটা কোয়ার্টারে ট্রান্সফার করে দিসে । দুই দিনের মধ্যে আমাকে সেখানে যেতে হবে । খুব খারাপ লেগেছিলো । কারণ , যে জায়গাটা দিয়ে আমি প্রথম শুরু করি সে জায়গা টার প্রতি আমি দুর্বল হয়ে গেসি । কেন জানি তখন মনে হয়েছিলো , অন্য জায়গায় গেলে আমার কোনভাবেই ভালো লাগবে না । এবং সেটাই হলো , অফিসিয়াল নোটিশে নতুন জায়গায় গেলাম । কিন্তু কোন ভাবেই ভালো লাগে নি । কিন্তু কাউকেই কিছু বলার মত ছিলো না । কাউকে বোঝাতেও পারছি না । আমি বুঝতে পারি , এটা কর্পোরেট লাইফ যে কোন পরিস্থিতিতে আমাকে যে ভাবেই সামাল দিতে । অতটুকু জ্ঞান আমার ছিলো । কিন্তু মন থেকে জায়গা পরিবর্তন করার ব্যাপারটি মানতে পারলাম না । কিন্তু , কাউকে বিষয় টি বুঝতেও দিচ্ছি না । একটা সময় রাগ করে চাকরি থেকে অব্যাহতি দিয়ে চলে আসি । কিন্তু সেটা যে শুধু আমার জায়গা পরিবর্তন করার জন্য সেটা আজো কাউকে বলি নি । আমি জানি , এই কথাটা কাউকে বললে , সে হয়ত আমাকে রোগী ছাড়া আর কিছুই বলবে না । কিন্তু , আমি জানি এই ছোট ব্যাপারটা আমার মনে কতটুকু দাগ কেটে ছিলো ।
মস্কো , রাশিয়া !
২০১৬ সাল অক্টোবর মাস ।
চাকরীর ঘুছিয়ে গত বছরের শেষ নাগাদ রাশিয়ান ফেডারেশন বৃত্তি নিয়ে মস্কো তে চলে আসি । খুব ভালো ভাবেই শুরু টা হয়েছিলো । খুব ভালো ভাবে সব কিছু পাই । যেমন টা আমি মন থেকে চেয়েছিলাম । কিন্তু ইউনিভার্সিটির নিয়ম অনুযায়ী প্রথম বছরের বছরের পর প্রত্যেক ছাত্রকে তার জায়গা পরিবর্তন করতে হয় । কিছুদিন আগে আমাকে ব্যাপারটি জানিয়ে দেয় । কথাটা শোনার পর বুকের ভেতর কেমন জানি করতে থাকে । এই স্থান পরিবর্তন নিয়ে জীবনে অনেক কিছু আমি হারিয়েছি । অনেক মানুষ কে হারিয়েছি । অনেক ভালো কিছু সুযোগ হারিয়েছি । কিন্তু , কেউ কি বুঝতে পারে এই ছোট্ট একটা বিষয় আমার জীবনে কত বড় পরিবর্তন , ব্যবধান তৈরি করে । আমার ভিতরে কত বড় দাগ কাটে !!!
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৭ রাত ২:৫৫