অফিস থেকে একটা মোবাইল ফোন পেলাম, স্মার্ট ফোন। কিছুদিন পরে ফোনটিতে কিছু সমস্যা দেখা দিল, তাই ফোনটি আর warranty card নিয়ে আমি গেলাম বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্স এ। নীচ তলার ব্রান্ড প্রমোটররা আমাকে বলল তাদের কাস্টমার কেয়ার সেন্টার উপরের একটি ফ্লোর এ । গেলাম সেখানে। কাস্টমার কেয়ার এক্সিকিউটভ সব শুনে ব ল ল, “ স্যার আপনি যে সেটটি কিনেছেন, তার ক্যাশ মেমো লাগবে, শুধু warranty card এ হবেনা”। আমি বললাম, “দেখুন, ফোনটি আমার অফিস আমাকে দিয়েছে, তাই তারা আমাকে শুধু warranty card দিয়েছে, কোনো ক্যাশ মেমো দেয়নি। আর এটাই ছিল খুব স্বাভাবিক, কারণ অফিস তো একটি দুইটি সেট কিনে নাই, আর তাই মূল্যের ক্ষেত্রেও নিশ্চয়ই একটা ছাড় পেয়েছে Corporate discount হিসেবে। তাই আমার কাছে ক্যাশ মেমো থাকার কথা নয়”। তবুও সেই কাস্টমার কেয়ার এক্সিকিউটভ আ মাকে বলল যে তাহলে কোনো সেবা আমাকে দেওয়া সম্ভব না। আমি বিষয়টি নিয়ে ঐ কাস্টমার কেয়ার সেন্টার এর ম্যানেজার এর সাথে কথা বললাম। এও বললাম, “দেখুন আমি তো ইচ্ছা করলে এখন একটা ক্যাশ মেমো বানিয়ে নিয়ে আসতে পারি, সেটা না করে আমি আপনাকে তো সমস্যাটি বুঝিয়ে বলছি, প্লিজ একটু হেল্প করেন ”। সে উত্তরে বলল, “ক্যাশ মেমো ছাড়া আপনাকে warranty দেয়া সম্ভব না, দরকার হলে বাইরের কোথাও থেকে ঠিক করিয়ে নেন”। বাইরের কোথাও থেকে ঠিক করার এই সাজেশন শুনে আমার মেজাজ খারাপ হল বেশ। পরবর্তীতে আমি পরিচিত একটি দোকান থেকে একটি ক্যাশ মেমো নিয়ে এসে ফোনটি ঠিক করাই। ক্যাশ মেমো ছাড়া ফোন ঠিক হবে না, এরকম নিয়ম থাকতে পারে , কিন্তু ঐ কাস্টমার কেয়ার সেন্টার এর ম্যানেজার এর ব্যবহারে আমি বেশ বিরক্ত হয়েছিলাম। আমি নিশ্চিত যে, আমার মতো এরকম অভিজ্ঞতা কম বেশি সবারই আছে আমাদের দেশে । অথচ বর্তমান পৃথিবী এখন শুধু চটকদার বিজ্ঞাপণ নয়, উন্নত গ্রাহক সেবার বা কাস্টমার সার্ভিস-এর দিকে মনোযোগ দিচ্ছে। কারণ আগামী দিনের বাজার নির্ধারিত হবে উন্নত মানের গ্রাহক সেবার বিচারে।
আশার কথা এই যে, আমাদের দেশেও এখন গ্রাহক সেবার দিকে অনেকেই মনোযোগী হচ্ছেন। কিন্তু এখনও অনেক ক্ষেত্রেই ( দুই একটি ক্ষেত্র ব্যতীত, যেমন- ব্যাংক, টেলিকম ) আমরা এখন ও বেশ পিছিয়ে। উন্নত গ্রাহক সেবা যেকোনও ব্যবসাতে সবচেয়ে গুরুত্তপুর্ণ নিয়ামক। ব্যবসাতে চমৎকার বিজ্ঞাপণ থাকতে পারে, মূল্যহ্রাস দিয়ে গ্রাহকদের আক্রষ্ট করা যেতে পারে, এটা ফ্রি,সেটা ফ্রি- কত কি করা যেতে পারে- কিন্তু উন্নত গ্রাহক সেবার অভাবে ( যেমন- after sales service) ক্রেতাগুলো যদি পুনরায় ফিরে আসা ক্রেতাতে (repeat customer) পরিণত না হয়, তবে ব্যবসাতে টিকে থাকা কঠিন হবে।
উন্নত গ্রাহক সেবা মাত্রই গ্রাহক এর আস্থা অর্জন ও গ্রাহক কে সন্তুষ্ট করা যেন গ্রাহক পুনরায় ঐ নির্দ্দিষ্ট ব্রান্ডের প্রতি আস্থা রাখতে পারে। আর গ্রাহক বা ক্রেতা সন্তুষ্ট থাকলে সে তার এই ভাল অভিজ্ঞতার কথা আর পাঁচ জনের সাথে বিনিময় (share) করবে। ভেবে দেখুন,কিভাবে একজন থেকে আরেকজন আপনার পণ্য এর কথা সহজেই জেনে যাচ্ছে। আর বর্তমানে পণ্য প্রচারের অন্যতম শক্তিশালী মাধ্যম Word of mouth এভাবেই কাজে লাগানো যাবে। আর এই উন্নত গ্রাহক সেবার মূল মন্ত্র হল “ You will be judged through what you do, not what you say” - অর্থাৎ “ আপনি কাস্টমারকে কি সেবা দিতে পারলেন সেটাই আসল, কি প্রতিশ্রুতি দিলেন সেটা নয়”। উন্নত গ্রাহক সেবা নিশ্চিত ক রতে চাইলে নিম্নের ধাপগুলো অনুসরন করা যেতে পারে-
১। যেসব ব্যবসাতে গ্রাহকদের প্রতিনিয়ত খোজ নেয়ার সম্ভাবনা আছে (যেমন-সেবাখাত) সেগুলোতো বটেই, এমন কি নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য কিংবা অন্য কোন ব্যবসাতে ও একটি contact point থাকা জরুরী-যাকে আমরা hotline বলে থাকি। তবে সবচেয়ে যেটা গুরুত্তপূর্ণ তা হ ল ফোনটি কারো না কারো ধরতেই হবে।যদি দিনের মধ্যে ৮ ঘন্টাও এই সেবা বিদ্যমান থাকে, সেক্ষেত্রেও নিশ্চিত করতে হবে ফোনটি কেউ না কেউ ধরছে এবং সব প্রশ্নের উত্তর দেয়ার এবং সমস্যা সমাধানের আন্তরিক চেষ্টা করছে। এজন্য কাস্টমার কেয়ার প্রতিনিধিকে যথাযথ প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত হতে হবে-ভাষা ও ব্যবহার অত্যন্ত পরিশীলিত হতে হবে এবং সেই সাথে থাকতে হবে ধৈর্য্য ,হতে হবে ইংরেজী ও বাংলা ভাষাতে মোটামুটি দক্ষ ।
২। অতিরিক্ত প্রতিশ্রুতি (over promise) না দেয়াই ভাল। যদি কোন কাস্টমারকে বলতে হয় যে আগামী ২৪ ঘন্টার মধ্যে অথবা আগামী মঙলবারের মধ্যে আপনার সমস্যার সমাধান হবে-তা হলে তা নিশ্চিত হয়েই বলতে হবে। আপনার ঘরের রং এর consultant কিংবা ফার্নিচার মেরামত এর মিস্ত্রী আসবে বলে আপনি অফিস থেকে বসকে বলে আগে আগে বের হলেন, কিন্তু কেউ এল না। সেক্ষেত্রে সেই কাস্টমার এর কখনই ব্রান্ডটি সম্পর্কে ভাল ধারণা থাকবে না । এরক ম যদি কোনো কারণে প্রতিশ্রুতি রাখা স ম্ভব না হয় কিংবা সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধির কাস্টমার এর বাসা বা অফিসে যেতে দেরী হয় ( যেম ন-ট্রাফিক জ্যাম, খারাপ আবহাওয়া), তবে পূর্বেই তা কাস্টমারকে জানাতে হবে যথেষ্ট সময় হাতে রেখে এবং অবশ্যই বলতে হবে “ আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত”।
৩। গ্রাহকের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে-ফোনে কিংবা সামনা সামনি, এমন কি তার কথা যদি হয় হাস্যকর কিংবা আঞ্চলিকতার টানে পরিপূর্ণ। এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, একজন কাস্টমার আমার ব্রান্ডটিকে ভালবাসে বলেই আমার ব্রান্ডটির উপর আস্থা রাখে। সু্তরাং শ্রদ্ধা তার প্রাপ্য। একটি সত্যি উদাহরণ দেই। আমেরিকাতে এক গ্রাহক একবার কম্পিউটার নিয়ে দোকান এ গিয়ে রাগত স্বর এ বলল, তার কিবোর্ড কাজ করছে না – কাস্টমার সার্ভিস এর প্রতিনিধি প্রথমেই বুঝতে পেরেছে যে ঐ ব্যক্তি কিবোর্ড –এর তার আদৌ লাগায়নি। তারপর ও তার পুরো অভিযোগ শুনে সে বলল, “স্যার, আপনি মনে হয় তারটি লাগিয়েছিলেন, কিন্তু মনে হয় সেটি আবার কোনো কারণে খুলে গিয়েছে।” সুতরাং গ্রাহকের কথা পুরো শোনার মধ্যে গ্রাহকের একটা সস্তি আছে। সে কারণেই ডাক্তার এর কাছে গিয়ে রোগীদেরকে প্রায়ই অভিযোগ করতে শোনা যায়, “ডাক্তার সাহেব আমার কথা ভাল ভাবে শুনলেন ই না”। যদিও ডাক্তার রোগীর সমস্যা হয়তো ধরতে পেরেছেন।
৪। সমস্যার কথা বলা (complaining) কাস্টমার যেকোন ব্যবসার সবচেয়ে বড় সম্পদ ( prospect)।কারণ তারা সমস্যার সমাধান পেলে loyal customer এ পরিণত হয় । এভাবেই এ ধরণের কাস্টমারদের সেবা দিয়ে এদেরকে fan এ রুপান্তর করতে হবে। ভবিষ্যতে এরাই হবে Brand advocate ( সেই ধরণের কাস্টমার যারা ব্রান্ডের পক্ষে কথা বলে তাদের পরিচিত মানুষ জনের কাছে)। আমরাও কিন্তু নিজের অজান্তেই অনেক ব্রান্ডের Brand advocate । আমরা আমাদের ব্যবহ্রত কোন ব্রান্ডের থেকে ভাল কোন কাস্টমার সার্ভিস পেলে কি অন্যের সাথে share করি না? কাস্টমার যদি অকারণ দোষারোপও করে, হাসিমুখে তার সাথে ব্যবহার করতে হবে। কারণ customer has all rights.
৫। কখনও কখনও গ্রাহক সেবা নিশ্চিত করতে গেলে লাভের দিকে তাকালে চলবে না। কারণ এটা এক ধরণের বিনেয়োগ। সামান্য বেল্টের একটা বাকলস্ ছিড়ে গেলে দোকানদার আপনাকে যদির আরে ক টা বাকলস্ বিনামূল্যে দেয়, আপনি বেশ খুশী হবেন। এভাবেই সে আপনার মন জিতে নেবে। আপ নি ঐ দোকানে আবারও যাবেন। এই একি concept কাজে লাগিয়ে অনেক বড় বড় কোম্পানীগুলোও কাস্টমারদের ফ্রি সার্ভিস বা priority service দিয়ে থাকে।
৬। সবসময় ই গ্রাহককে অতিরিক্ত তথ্য দিতে হবে , তবে তা সময় বুঝে। একটি পণ্য কিনে আরেকটি পণ্য কিনছে এমন সময় কোনও অতিরিক্ত তথ্য দিতে গেলে কাস্টমার বিরক্ত হতেই পারে। সুতরাং সময় বুঝে প্রয়োজনে অনুমতি নিয়ে কাস্টমারকে অতিরিক্ত তথ্য দিতে হবে, জানাতে হবে বিশেষ কোনো অফার এর কথা, ডিস্কাউন্ট কুপন, র্যা ফেল ড্র, ফ্রি অফার সম্পর্কে। ইদানিং মোবাইল ফোন কোম্পানী, বিভিন্ন ব্যাংক গ্রাহকদের কলের সাথে এগুলো নিজ থেকেই বলে দিচ্ছে। গ্রাহক এর কাছে অতিরিক্ত তথ্য থাকলে গ্রাহকের সিদ্ধান্ত নেয়া সহজ হয়।
উপরের এই নিয়মগুলো খুবই সাধারণ – এগুলো মেনে চললেই একটি স্থায়ী কাস্টমার গ্রুপ গড়ে উঠবে। বিজ্ঞাপণ খরচ ও কমে আসবে অনেক-তা নিশ্চিত করেই বলা যায়।
শুরু করেছিলাম কাস্টমার সার্ভিস এর আমার একটি বাজে অভিজ্ঞতার উদাহরণ দিয়ে। ভাল অভিজ্ঞতাও আছে। ইন্টারনেট সংযোগ নিতে চাচ্ছিলাম একটি নামকরা বিদেশী কোম্পানী থেকে- আক্রষ্ট হয়েছিলাম একটি বান্ডেল অফার থেকে। কোম্পানীটির customer service থেকে বলল লোক পাঠাবে। আমি বললাম, “ছুটির দিনে”। ছুটির দিনেই লোক এল, তাও ফোন করে যথাসময় এ। নেটওয়ার্ক পরীক্ষা করে বলল, “আপনি খুব বেশী স্পীড পাবেন না আপনার বাসা থেকে, কারণ নেটওয়ার্ক সিগনাল দুর্বল।আমি বলব সংযোগটি না নিতে”। আমি ওদের সার্ভিস নেইনি, কিন্তু অনেককে বলেছি এই সততা ও আন্তরিকতার কথা। আমার থেকে শুনে কিন্তু বেশ কয়েকজন ঐ কোম্পানী থেকে ইন্টারনেট সার্ভিসটি নিয়েছে এবং এখনও ব্যবহার করছে । সুতরাং আমার কাছে সার্ভিসটি বিক্রি করতে না পারলেও আমার মন তারা ঠিক জয় করেছিল তাদের আন্তরিক কাস্টমার সার্ভিস দ্বারা। প্রতিযোগীতার বাজারে টিকে থাকতে চাইলে উন্নত গ্রাহক সেবার কোন বিকল্প নাই। আমাদের দেশেও গ্রাহক সেবার ( বিশেষ করে বেসরকারী পর্যায়ে) উন্নতি হচ্ছে ধীরে ধীরে,আরও হবে ইনশাআল্লাহ্। আমি আশাবাদী।
[আমার এই লেখাটি দৈনিক বণিক বার্তায় প্রকাশিত হয়েছিল]