একবার নয়, হাজার বার দেখেও যেন তৃপ্ত হইনা। সমগ্র পৃথিবী যেখানে এগিয়ে যাওয়ার আহবান জানাচ্ছে তখন হাজার বছর পেছনে ফিরে যেতে ইচ্ছে জাগে। এটা আর অন্য কোথাও নয়, তা হচ্ছে হাজার বছরের ইতিহাসের লীলাভূমি, আল্লাহ তাআলার নূরের তাজাল্লীতে ধন্য, লক্ষ নবী ও রাসূলের পদভারে মুখরিত নিরাপত্তার দেশ মিশর। যার কথা কোরআনুল কারীমে চার বার উল্লেখ রয়েছে। এমন একটি দেশে আসতে পেরে আমি নিজেকে ধন্য মনে করছি। সেই সাথে এসব স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলো দর্শনে পুলকিত হচ্ছি। এরই ধারাবাহিকতায় এক শিক্ষা সফরে গিয়েছিলাম পবিত্র ভূমি "তূর পাহাড়ে"। যা আমাদের আবাসস্থল কায়রো থেকে প্রায় সাতশ' কিলোমিটার দূরে। এই শিক্ষা সফর পরিচালিত হয়েছিল "বাংলাদেশ ষ্টুডেন্টস অর্গানাইজেশন, মিশর এর সার্বিক তত্বাবধানে। আমাদেরকে সেখানে নেয়া হয়েছিল একটি বিলাসবহুল বাসে। বাস মাগরীবের পর পরই ছেড়ে যাওয়ার কথা থাকলেও তা কিছুটা বিলম্বিত হয় এবং এশার আগে কায়রো থেকে সিনা'র উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। এ সফরে আমাদের সাথে ছিলেন কায়রোস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম ও তার পরিবারবর্গ। এ শিক্ষা সফর পরিচালনায় ছিলেন ষ্টুডেন্টস অর্গানাইজেশনের সভাপতি মহিউদ্দীন ও সেক্রেটারী জেনারেল বজলুর রহমান।যাত্রা শুরুর আগ থেকেই আমরা সবাই আনন্দে মেতে উঠলাম। অত:পর সফরের দু'আ ও আল্লাহর সহায়তা কামনা করে আমরা যাত্রা শুরু করলাম। রাত্রি কালীন সফর বলে বেশী কিছু দেখা যাচ্ছিল না। তা সত্ত্বেও ভাল লাগছিল। সারা রাত না ঘুমিয়ে কাটিয়েছি আর বাইরে গাঢ় অন্ধকারের মাঝে স্থির পাহাড়গুলো দেখে আশ্চার্যান্বিত হয়েছি। অপেক্ষা করছি, কখন দেখতে পাব সেই স্বপ্নের তূর পাহাড়, যেখানে বনী ঈসরাঈলের হেদায়েতের জন্য তাওরাত অবতীর্ণ হয়। অনেক দীর্ঘ পথ চলার পর আমরা এসে উপনীত হলাম সেন্ট ক্যাথারীন জেলাস্থ তূর পাহাড়ের পাদদেশে। তখন ঘড়িতে বাজে রাত সাড়ে তিনটা। স্থান ভেদে তাপমাত্রাও যে পরিবর্তন হয় তা সে দিন ভালো ভাবে টের পেলাম। প্রচণ্ড ঠাণ্ডার কারণে আমরা বাসের মধ্যেই পর্বতারোহণের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। এক পর্যায়ে টিকেট সংগ্রহ করে পর্বতারোহণ শুরু করলাম। তখন আমাদের সাথে ইউরোপের কয়েকটি দল ছিল বলে পথটা বেশ গুঞ্জন মূখর ছিল। কিছুক্ষণ পর পর সামান্য বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। কারণ, যেভাবেই হোক সূর্যোদয় আমাদের সেখানে দেখতেই হবে। তূর পাহাড়ের চূড়া ২২৮৫ মিটার উঁচু ও আরোহণ পথ অনেক আঁকা বাঁকা বলে পরিশ্রমের মাত্রাটা একটু বেশীই হচ্ছিল। আমি তিনবার হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়েছিলাম তবে কিনারা থেকে একটু দূরে ছিলাম বলে বেঁচে গেছি। অন্যথায় তূর পাহাড়ের পাদদেশে আমার সমাধি হওয়াও অসম্ভব কিছু ছিল না, পথিমধ্যে আমরা ফজরের নামায আদায় করলাম। অত:পর আমরা আবার আরোহণ শুরু করলাম। ইতোমধ্যে সূর্য একটু একটু উঁকি দিচ্ছিল। ফলে সমগ্র তূরে সিনা অঞ্চলে আশ্চর্য রকম লাল আভা ছড়িয়ে পড়ল। সে দৃশ্যের সৌন্দর্য্য ব্যাখ্যা করতে আমার ভাষা ও কলম দু'টোই অক্ষম। একটানা আড়াই ঘন্টা চলার পর আমরা উঠে পড়লাম তূরে সিনা'র সর্বোচ্চ চূড়ায়। যেখানে পাশাপাশি একটি মসজিদ ও একটি গীর্জা আছে। তূর পাহাড়ের শীর্ষ চূড়া থেকে সমগ্র সিনাই উপত্যকাকে দেখতে পেরে আমার সমস্ত ক্লান্তি যেন কোথায় হারিয়ে গেল। অদ্ভূত এক ভাল লাগায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়লাম। সেখানে একটা বিষয় আমাকে খুবই আশ্চার্যান্বিত করেছে তা হলো, সেখানে একেকটি পাহাড় একেক রংয়ের। কোনটি কালো, কোনটি লাল আবার কোনটি খয়েরী। আমি প্রায় সাত-আটটি রংয়ের পাহাড় অবলোকন করলাম। যেগুলো প্রত্যেকটি মহান আল্লাহর নিদর্শন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের দ্বিতীয় দর্শনীয় স্থান হলো সেন্ট ক্যাথারীন গীর্জা। যা পৃথিবীর প্রাচীনতম গির্জার অন্তর্ভুক্ত। সেখানে বহু বছর আগের পুরাতন ধর্মীয় গ্রন্থের লাইব্রেরী। সেই লাইব্রেরীর মধ্যে সবচে' আকর্ষণীয় বস্তু হলো রাসূল (সা.)-এর চিঠি যা এই গির্জার নিরাপত্তার জন্যে রাসূল (সা.) হযরত আলী (রা.) কে দিয়ে লেখিয়েছেন। সেখানে লেখা আছে যে মুসলামানরা যেন তাদের ধর্মীয় স্থানগুলোর মতই অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের পবিত্র স্থাপনাগুলো নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। প্রকৃত পক্ষে ইসলামই দেখিয়েছে উদারতার সঠিক নিদর্শন। গীর্জা কমপ্লেক্সের অভ্যন্তরে সাহাবীদের আমলে তৈরী একটি মসজিদ আছে বলে শুনছি। সেখানে সবচে' আকর্ষণীয় বস্তু হলো মূসা (আ.)-এর গাছ। হযরত মূসা (আ.) যখন মাদায়েন থেকে মিশরে স্বস্ত্রীক ফিরছিলেন, পথিমধ্যে তিনি আগুনের প্রয়োজন অনুভব করলেন। তখন একটি গাছের মধ্যে আগুন দেখতে পেলেন। অত:পর তিনি সেই গাছের কাছে গেলেন এমন সময় আল্লাহ বললেন: "হে মূসা! নিশ্চয় আমি তোমার পালনকর্তা, অতএব তুমি জুতা খুলে ফেল, তুমি পবিত্র উপতক্যা "তূআ'য় রয়েছ। এবং আমি তোমাকে নির্বাচন করেছি, অতএব যা প্রত্যাদেশ করা হচ্ছে তা শুনতে থাক" [সূরা ত্বা-হা: ১১-১৩ ] আর আমি সেই গাছের সামনে দাঁড়িয়ে হতবাক নয়নে তাকিয়ে আছি। সেই গাছের পাতা দেখতে অনেটা বড়ই পাতার মতো, গাছের ডালগুলো বেয়ে উঠেছে লাউ গাছের মতো। দেখতে পেলাম, অজ্ঞতা বশত অনেকেই তাদের মনোবাসনা কাগজে লিখে তাতে ফেলছে। গাছটি হাজার বছর ধরে সেই অবিকল আগের মতই আছে। আর মহিমা প্রকাশ করছে মহান আল্লাহ তাআলার। গীর্জার পাশেই একটি বসতি আছে যার নাম বেদুইন ভিলেজ। সেখানকার অধিবাসীরা আগের মতই সহজ সরল এবং কঠিন তাদের জীবন পদ্ধতি। গীর্জা পরিদর্শন শেষে আমরা ক্লান্তি ও অবসাদগ্রস্ত হয়ে বাসে ফিরে আসলাম । কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয়ার পর দুপুরের খাবার খেলাম। এরপর গেলাম হারুন (আ.)-এর কবর যিয়ারতে। যিয়ারত ও মুনাজাত শেষে গেলাম সামেরীর গো বৎসের স্থানে। সেখান এখনও পাথরের গায়ে একটি গো বৎসের আকৃতি অঙ্কিত আছে। তার পর গেলাম সালেহ (আ.)-এর মাকামে। এ সমস্ত স্থান অবলোকনের মাধ্যমে মনে হচ্ছিলো যেন আমরা সেই হাজার বছর পেছনে ফিরে গিয়েছি। অত:পর আমরা রওয়ানা হলাম হাম্মামাতে ফেরআউনে। এটার ভেতর হতে গরম হাওয়া বের হয়ে আসে আর নীচ থেকে গরম পানি। মিশরীয়দের বিশ্বাস যে এ গরম হাওয়া যদি কারো গায়ে লাগে তাহলে চর্মরোগ দূর হয়। তারপর আমরা সবাই লোহিত সাগরের নীল পানিতে নামলাম। সাথে সাথে সমস্ত ক্লান্তি ও অবসাদ দূর হয়ে গেল। সেখানে প্রায় দু'ঘন্টা কাটানোর পর আনরা গেলাম মূসা (আ.)-এর কূপের কাছে। এখন সেখানে তিনটি কূপ অবশিষ্ট আছে। এর মধ্যে একটির নাম "বি'রে শাইখ"। এই কূপগুলোর পাশেই মনোরম খেজুর বাগান ও রয়েছ বেদুঈনদের দোকান-পাট। আমরা সেখান থেকে কিছু কেনা-কাটা করে বাসে উঠলাম। এভাবে পরীক্ষার ক্লান্তি ও কষ্ট সব পেছনে ফেলে সুন্দর ভবিষ্যতের জন্যে কায়রোর উদ্দেশ্যে রওয়ানা করলাম।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে জুন, ২০১২ রাত ১:৫৮