পত্রিকায় দেখতে এখানে ক্লিক করুন।
আরেকটি লেখা এখানে ক্লিক করুন বর্তমান র্যাব একটি মূর্তমান আতংক এবং বাংলাদেশীদের গলায় বিষকাঁটা।
আরেকটি লেখা এখানে ক্লিক করুন
কাকরাইল ও শান্তিনগরে আমার দেখা একটি ভয়াবহ অভিজ্ঞতা।
মানবাধিকার আইনজীবী উইলিয়াম নিকোলাস গোমেজ তাকে অপহরণ করে একটি গোয়েন্দা সংস্থা ও র্যাব সদস্যরা ব্যাপক নির্যাতন চালিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন। ই-মেইলে পাঠানো দীর্ঘ অভিযোগপত্রে তিনি নির্যাতনের বিস্তারিত বর্ণনা দেন। পরে টেলিফোনেও তিনি এ নিয়ে কথা বলেন। তার অভিযোগ, গত ২১ মে সায়েদাবাদ থেকে তাকে ধরে নিয়ে অকথ্য ভাষায় গালাগাল এবং উলঙ্গ করে তার ওপর দিনভর নির্যাতন চালানো হয়। একই সঙ্গে পানির সঙ্গে তাকে এমন কিছু পান করানো হয় যে, যাতে বর্তমানে তিনি চরম অসুস্থবোধ করছেন। অ্যাডভোকেট নিকোলাস গোমেজ তার ই-মেইলে স্বাভাবিকভাবে বাঁচার গ্যারান্টি চেয়েছেন। তবে র্যাবের পক্ষ থেকে উইলিয়াম গোমেজকে নির্যাতনের অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে। র্যাবের মিডিয়া ও লিগ্যাল উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার এম সোহায়েল আমার দেশকে বলেন, ‘না এরকম কোনো ঘটনা ঘটেনি।’ অভিযোগ নিয়ে সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তাদের সঙ্গে বারবার যোগাযোগ করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
উইলিয়াম নিকোলাস গোমেজের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে জানা যায়, চিকিত্সার জন্য বর্তমানে তিনি নেপাল রয়েছেন। টেলিফোনে এ আইনজীবী আমার দেশকে বলেন, ‘নির্যাতনের পর গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে এশিয়ান মানবাধিকার কমিশন গত ২৭ মে আমাকে নেপালে নিয়ে আসে। এখানে আমি চিকিত্সা নিচ্ছি। আমার সন্তান স্ত্রী দেশে রয়েছে। জানি
না ওদের ওপর আবার কী নির্যাতনের খড়গ নেমে আসে।’ গোমেজ তার নিজের এবং পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা দাবি করেছে।
আইনজীবী গোমেজ তার অভিযোগে বলেন, ‘২১ মে শনিবার সকাল। কিছু কাজের জন্য আমি বাইরে বেরিয়েছি। কাজ সেরে যখন সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালের কাছ থেকে বাসায় ফিরছিলাম, এক লোক আমাকে ডাক দেন। লোকটি আমার চেয়ে লম্বা, ৫ ফুট ৭ ইঞ্চি হবে। বাসাবোর দিকে যাওয়ার রাস্তায় অপেক্ষমাণ কালো রঙের একটি মিটসুবিশি জিপ গাড়ির কাছে যাওয়ার অনুরোধ করেন তিনি। আমি সহযোগিতার মানসিকতা নিয়ে গাড়িটির কাছে যাই। আমার ধারণা ছিল লোকটি হয়তো পথ ভুলে গেছেন। কিন্তু গাড়িটির কাছে যাওয়ার পর লোকটি আমাকে আগে থেকেই খোলা থাকা দরজা দিয়ে ধাক্কা মেরে ভিতরে ঢুকিয়ে দেন। এ সময় ভিতরে অন্য একজন লোক বসা ছিলেন। দুই ব্যক্তি আমার ডানে ও বামে বসে পড়েন। তারা আমার নাম উইলিয়াম গোমেজ কিনা জানতে চান। আমি হ্যাঁ বললে তারা আমার চোখে কালো চশমা পরিয়ে দেন, যা চোখে দিলে আর কিছুই দেখা যায় না। একই সঙ্গে আমার মাথায়ও মুখোশ পরিয়ে দেন। তারা আমার ব্যাগ, মোবাইল ফোন ও মানিব্যাগ নিয়ে নেন। এরপর আমার মাথার দু’দিকে অস্ত্র ধরে বলে, ‘কুত্তার বাচ্চা কোনো শব্দ করবি না। তাইলে এখনই গুলি কইরা দিমু। তোরে মারার অর্ডার আছে।’ এ সময় ড্রাইভারের বাম পাশে বসা এক লোক গাড়ি সরাসরি হেডকোয়ার্টারে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। গাড়ি দ্রুত চলতে শুরু করলে হঠাত্ অপহরণকারীদের কাছে একটি ফোন আসে। যার কাছে ফোন তিনি জবাব দেন, ‘স্যার, স্যার, কুত্তার বাচ্চারে ধরছি; স্যার স্যার, এখনই হ্যান্ডকাফ দিতাছি।’ গাড়ি দ্রুতগতিতে চলছিল। এরপরই আমাকে হ্যান্ডকাফ পরানো হয়।
প্রায় ৪০ মিনিট চলার পর গাড়িটি একটি জায়গায় থামলে আমাকে বাইরে আনা হয়। দু’জন দু’দিক থেকে আমার হাত ও কাঁধ ধরে সামনে হাঁটতে বলে। আমি বললাম, ‘আমি দেখতে পারছি না। কিভাবে সামনে যাব? তখন একজন আমাকে বলে, ‘কুত্তার বাচ্চা দেখস না? র্যাবের সবকিছু তোরা দেখস। এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন, অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের তোর বাপেরা কিভাবে বাঁচায় দেখব।’
তারা আমাকে কোনো একটা কিছুর মধ্যে ঢুকায় এবং একজনকে ৯-এ চাপ দিতে বলে। তখন আমি বুঝলাম এটা লিফট। আমি কোনো একটি ভবনের নবম তলায় যাচ্ছি। তারা আমাকে একটি রুমে ঢোকায় এবং সম্পূর্ণ নগ্ন করে ফেলে। কেউ একজন বললেন, ‘জারজের বাচ্চা মুসলমানি করা, আবার নাম দিছে খ্রিস্টান। এই কুত্তার বাচ্চা র্যাব, আর্মির বিরুদ্ধে কাজ করবে না কে করবে? সব জারজগুলা এই কাজ করে।’
তখন অন্য লোকটি বললেন, ‘তাড়াতাড়ি! ব্রিগেডিয়ার স্যার আসছেন। এখন বেশি কথা বলা যাবে না। স্যারেরা তাদের কাজ করবেন; অনেক মোটা ফাইল আছে কুত্তার বাচ্চার নামে।’ তারা আমাকে ফ্লোরে ফেলে দেয় এবং বলে, সেজদা দে কুত্তার বাচ্চা।’
আমি বুঝতে পারছিলাম না কী বলব। তখন এক লোক আমাকে জোর করে সেজদার মতো করায় এবং বলে মাথা যেন ফ্লোরে না লাগে। আবার বলে, ‘সেজদা দিয়া থাকবি জারজের বাচ্চা। মাথা তুলবিতো ... গরম ডিম দিমু। হঠাত্ লোকটি আমার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দেয় এবং বলে, স্যার স্যার, বিষয় রেডি।’ পুরো শরীরে কোনো কাপড়চোপড় না থাকায় আমি ভীষণ ঠাণ্ডা অনুভব করছিলাম। এ সময় একটি অপরিচিত কণ্ঠ জানতে চায়, ‘উইলিয়াম গোমেজ, শেষ কবে বিদেশে গিয়েছিলে? ‘গত আগস্টে মনে হয়’—আমি উত্তর দেই। ‘তুই তারিখ ভুলে গেছস, খানকির পোলা। জারজের বাচ্চা, আরটিএইচকে (রেডিও টেলিভিশন হংকং) গিয়া কী কইছস ভুইলা গেছস? কত টাকা পাইছস এইসব দেশবিরোধী কথা বলার জন্য?’ আমি খারাপ কিছু বলিনি জানালে তারা আরটিএইচকে রেডিও প্রোগ্রাম চালু করে এবং বলে, ‘তুই আর তোর এএইচআরসি একমাত্র ভালো, আর হাসিনা খারাপ?’
এ সময়ে আমি দু’বার ফ্লোরে পড়ে যাই। আমি অনুভব করলাম আমার নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে। আমি ভীষণ ঠাণ্ডা অনুভব করছিলাম। এ পর্যায়ে তারা আমার কাছে জানতে চায়, শেষ কবে আমি খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাত্ করেছি? টাকা কোথায়? যে কোটি টাকা পেয়েছো তা কোথায়? আমি বললাম জীবনে কখনও খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করিনি। আমি একজন ধর্মনিরপেক্ষ লোক হিসেবে কখনও কোনো ডানপন্থী লোকের সঙ্গে মিশি না। তখন নতুন কণ্ঠে শুনলাম, ‘কুত্তার বাচ্চা, মিশুর (গার্মেন্ট আন্দোলনে সম্পৃক্ত থাকায় কারাবরণকারী মোশরেফা মিশু) কেসে খালেদা জিয়ার কাছ থেকে কত টাকা পাইছস?’
এ অবস্থায় একজন, যিনি ইংরেজিতে কথা বলছিলেন, ভিনদেশি বলে মনে হয়েছে, আমার কাছে জানতে চাইলেন, ‘এএইচআরসি আপনাকে সোর্স মানি হিসেবে কত টাকা দিয়েছে? র্যাব এবং পুলিশে আপনার কত লোক আছে?’ তিনি আরও জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি মিশুর বিবৃতি কাস্টডি থেকে কিভাবে সংগ্রহ করলেন? আপনি মিশুর মুক্তির জন্য দক্ষিণ কোরিয়ায় কিভাবে প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করলেন?
আমি নীরব থাকলাম। কেননা আমার মনে হচ্ছিল আমার মগজ মাথার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে। তখন একজন জিজ্ঞাসাবাদকারী, যিনি আগেও আমাকে প্রশ্ন করেছেন, বললেন, ‘কুত্তার বাচ্চা চুপ কেন? গলা ফাটাইয়া তোর বাপেরা তো সারা পৃথিবীতে কইতাছে র্যাব নিষিদ্ধ করতে। তোর বাপেদের নিষিদ্ধ করমু, আজকে তোরে আগে নিষিদ্ধ কইরা নেই।’
এরপর তারা জানতে চাইলেন, পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে কবে গিয়েছিলাম? আইএসআই কর্মকর্তাদের সঙ্গে কখন দেখা করেছি?
আমি বললাম, কখনও কাশ্মীর যাইনি। তারা বলল, আমাদের কাছে তথ্য আছে যে, তুই বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, র্যাব ও পুলিশ ধ্বংস করার জন্য আইএসআই কর্তৃক নিযুক্ত হয়েছিস।
আমি বললাম, আমার আইএসআই’র কোনো কর্মকর্তার সঙ্গে কখনও দেখা হয়নি। আমি একজন মানবাধিকার কর্মী। আমি শুধু এএইচআরসি’র জন্য কাজ করি। তারা বলল, ‘আমরা জানি যে, তুই এএইচআরসি’র দালাল। তারা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মহা শত্রু। তোর বস বাংলাদেশ সফরে এসে বলে গেছে, সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করবে। বাসিলের (এএইচআরসি’র সাবেক নির্বাহী পরিচালক) সমস্যা কী? ওই কুত্তার বাচ্চা তো নিজ দেশ থেকে বহিষ্কার হয়েছে। কুত্তার বাচ্চার সাহস কীভাবে হয়, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে কথা বলার।... পোলা, তুই বীরগঞ্জ (দিনাজপুর জেলার একটি থানা) থানা পুড়িয়ে দেয়ার জন্য টাকা দিছস। ডিজিএফআই, এনএসআই রিপোর্টে তাই কয়। এএইচআরসি আর আইএসআই কত টাকা দিছিল? পুলিশের অসম্মান করস? তোর বাপেরা আইসা দেশ চালাইব? তোর সব মেইল আমাদের কাছে আছে? ক কুত্তার বাচ্চা! থানা বার্ন করতে কারে কত টাকা দিছস?’
আমি বললাম, ‘আমি সব সময় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে। এএইচআরসি থেকে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ শিখিনি।’
তখন ওই লোকটি বললেন, ‘আহারে! কত সাধু! তোরাই দেশের সম্মান শেষ কইরা দিতাছস। দেশের উন্নয়ন বন্ধ কইরা দিতাছস। দেশের বাইরে মুখ দেখাইতে পারি না।’
অন্য একজন তখন জিজ্ঞেস করলেন, মানবাধিকার কর্মী রাজ্জাকের ঘটনায় সেনা কর্মকর্তাদের মানহানি ঘটাতে কত টাকা পেয়েছিস? আমি বললাম, ‘আমি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে নই। কিন্তু সেখানে কিছু খারাপ লোক আছে। ক্ষমতা গ্রহণের সময় তারা কিছু মানুষ হত্যা করে। লোকটি তখন বললেন, কুত্তার বাচ্চা! আর্মি খারাপ আর তোমরা ভালো? জারজের বাচ্চা! এনএসআই’র ফাইলে তোর চৌদ্দগুষ্টির খবর আছে। তোর বাপেদের সব খবর আছে। তুই দুলালকে ডিস্টার্ব করস কেন? রাজিব সজীবরে ডিস্টার্ব করস কেন? এই সময় হঠাত্ করে ফোন বেজে উঠল। ফোন ধরে একজন বললেন, স্যার, স্যার, শেষ পর্যায়ে, স্যার।
তখন ওই বিদেশি, যিনি মাতৃভাষা ইংরেজিতে কথা বলছিলেন, জানতে চাইলেন, বাসিল কখন বাংলাদেশে আসবেন?
বললাম, বাসিল সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোর বস আসরাফুজ্জামান কখন আসবে? আমি আবারও বললাম জানি না।’
আমি তখন খুব তৃষ্ণার্ত বোধ করছিলাম। পানি চাইলাম। একটি লোক আমাকে পানি দিল। পানি একটু গরম ছিল এবং স্বাদ স্বাভাবিক পানির মতো নয়। অন্য লোক বললেন, ‘রাজ্জাক একটা দালাল ও প্রতারক। আমাদের ভালো কর্মকর্তা তোর মতো ডাকাতদের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করেছেন। তিনি তার ভাইকে জারজ রাজ্জাককে ধরে এনে চোখ তুলে দেয়ার নির্দেশ দেন। বলেন, চোখটা তুইলা নে। এই কুত্তার বাচ্চা শালার পোলা যেন আর দেখতে না পারে। কুত্তার বাচ্চা রাজ্জাকের জন্য আমাদের ঘুম হারাম। সব জায়গা থেইকা শুধু মেইল আর চিঠি। তুই কুত্তার বাচ্চা ক—কত টাকা পাইছস? পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেটদের বলে দেয়া হয়েছে। এই বার যত খুশি ফাইট কর। ওই শালার পোলা রাজ্জাকের কেস এ কোর্ট আর পুলিশকে আমরা যা রায় দিতে কমু, তাই দিবে।
এ সময় অন্য একজন বললেন, এএইচআরসিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কুত্তার বাচ্চা আছে। আমি তাকে চিনি কিনা জানতে চাইল। বললাম, না। তখন লোকটি বললেন, ‘কুত্তার বাচ্চা তুই চিনস না? আমরা তাকে ভালো শিক্ষা দিয়েছি। সবগুলা দেশদ্রোহী। এইগুলা এই দেশে থাকার যোগ্য নয়। পাসপোর্টগুলো নিয়ে ফেলা দরকার এই কুত্তার বাচ্চাদের।’
আমার কাছে আরও জানতে চাওয়া হলো, কূটনৈতিক মিশনের কারা আমাদের সাহায্য করছে, কোন দেশ অর্থের জোগান দিচ্ছে? আমি বললাম, আমাদের কোনো ফান্ড নেই। জানতে চাইল, কেন আমি ভারতের জেলে আটক বাংলাদেশীদের সম্পর্কে আগ্রহী? কেন আমি ভারতের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকা সরকারের নিন্দা করছি?
ওই লোক আরও জানতে চাইলেন, সরকারের ভেতরের তথ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাছে কে সরবরাহ করেছে? তারা পোস্টার এবং স্টিকার সম্পর্কে জানতে চাইলেন। প্রশ্ন ছিল, পোস্টার ও স্টিকারের নকশা কে করেছে, কে ছাপিয়েছে? বললাম, ডিজাইনারকে চিনি না। একমাত্র জামান ভাই (এএইচআরসি’র স্টাফ মেম্বার) জানেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা ইনস্টিটিউটে তার বন্ুব্দ রয়েছেন। কিন্তু যিনি ছাপিয়েছেন তাকে এবং প্রেসও চিনি। কিন্তু সঠিক ঠিকানা জানি না। তারা জানতে চাইলেন, তুই এসব জিনিস পার্লামেন্টে পাঠিয়েছিস কেন? আমরা সংসদ সদস্যদের কাছ থেকেও অভিযোগ পেয়েছি। তারা নির্যাতন নিয়ে আইন করার কথা বলছিলেন। তাদের জানা উচিত, এই আইন কখনোই পাস হবে না। আমরা এটা নিশ্চিত করব।’
এসময় একজন কর্মকর্তা বললেন, ওর বিরুদ্ধে একটা রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা দেন। তখন অন্য একজন বললেন, না একটা জঙ্গি মামলা দেই। তখন বিদেশিরা বলবে, ও একটা সন্ত্রাসী।
আমি কান্না শুরু করলাম। বললাম, আমার ছোট দুটি ছেলে আছে। দয়া করে আমাকে মাফ করে দিন। আমি কখনও আর এ ধরনের কাজ করব না।
তখন তাদের একজন বললেন, ‘কুত্তার বাচ্চা। তুমি করবা না। তোমার বাবারা তো আজকেই আসতাছে। বিজো ফ্রান্সিস ও জিজো পল। আমরা জানি না মনে করছ! হারামির বাচ্চা, আমাদের ঘুম হারাম কইরা আবার বাইরে থেকে হারামির বাচ্চাদের ডাইকা নিয়া আনতাছো। দেশের উন্নয়ন আর সম্মান শেষ কইরা দিতাছস।
আমি বললাম, ‘আমি আর কখনও এএইচআরসিতে যাব না, কাজও করব না। তখন লোকটি বললেন, তোর কাজ ছেড়ে দেয়ার দরকার নেই। বিজো এবং জিজো বাংলাদেশে থাকা পর্যন্ত ভালোভাবে কাজ কর। আমাদের বৈঠক সম্পর্কে তাদের কিছু বলবি না। স্বাভাবিকভাবে কাজ কর। আমাদের কথা ভালোভাবে শোন। না হলে আমরা জানি কীভাবে শোনাতে হয়।
তখন আমাকে তারা অন্য একটি রুমে নিয়ে প্যান্ট শার্ট পরতে বলে এবং রুম থেকে বের করে নিয়ে এসে একই গাড়িতে তোলে। আমার চোখ খুলে দিলে দেখতে পাই, সেই একই ব্যক্তি গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে আছেন এবং তার হাতে আমার ব্যাগ, মোবাইল ফোন এবং মানিব্যাগ রয়েছে। সেই একই গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে লোকটি বললেন, ‘কুত্তার বাচ্চা! মুখ খুললে মাগুর মাছ দিয়া খাওয়ামু। আমরা তোর সব দেখতাছি।
এই দিনের পর থেকে আমার শারীরিক অবস্থা ক্রমান্বয়ে খারাপ হচ্ছে। পানিতে কিছু মিশিয়ে দিয়েছিল বলে আমার ধারণা। আমার দু’পা বিশেষ করে হাঁটু এবং জোড়া ব্যথা করছে। কখনও কখনও অবশের মতো মনে হয়। হাতে কোনো জোর পাই না। মনে হচ্ছে, যে কোনো সময় পড়ে যাব। ঠিকভাবে ঘুমোতে পারি না। কোনো ছোট্ট শব্দও আমার কাছে খুব বড় মনে হয়। আমার মেরুদণ্ডেও ব্যথা হচ্ছে। আমি প্রায়ই কান্নায় ভেঙে পড়ি, যখন মনে পড়ে তারা আমাকে উলঙ্গ করে এবং জারজ নামে ডাকে।
আমার এখন আত্মহত্যা করতে ইচ্ছা করে। তারা আমাকে অপমান-অপদস্ত করেছে। কিন্তু আমি কিছুই করতে পারিনি।
আমার মনে হচ্ছে, আমার জীবন শেষ হয়ে গেছে। তারা আমাকে সকাল সাড়ে ১০টায় নিয়ে যায় এবং বিকাল সাড়ে ৩টায় বাসায় ফিরে আসি। আমি নির্যাতনের ঘটনা একটি মুহূর্তের জন্যও ভুলতে পারি না। আমি খুব কষ্ট পাই যখন মনে পড়ে আমাকে উলঙ্গ করার কথা এবং দাসের মতো নাকে খত দেয়ার কথা।
আমার বিরুদ্ধে আইএসআইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ থাকার অভিযোগ এনেছে। কিন্তু আমি এ ধরনের লোক নই। আমার জীবনে কখনও কাশ্মীর বা পাকিস্তান যাইনি।
আমি খুব হতাশ এবং ক্লান্তি বোধ করছি। আমার মাথায় ব্যথা হচ্ছে। আমার মাথার মধ্যে কী যেন ঘুরছে। আমাকে যারা উলঙ্গ করেছে তাদের জানাতে চাই, আমি ক্ষমতাহীন, গরিব ও দুর্বল লোক। কিন্তু আমি নির্ভীক। নিরাপত্তা বাহিনী যেভাবে হত্যা করে, তাদের হাতে আমি সেভাবে নিহত হতে চাই না। আমি ভালোভাবে ঘুমাতে চাই। আমি এখনও মানবাধিকার আইনজীবী হিসেবে বেঁচে থাকতে চাই।পত্রিকায় দেখতে এখানে ক্লিক করুন।
আরেকটি লেখা এখানে ক্লিক করুন বর্তমান র্যাব একটি মূর্তমান আতংক এবং বাংলাদেশীদের গলায় বিষকাঁটা।
আরেকটি লেখা এখানে ক্লিক করুন
কাকরাইল ও শান্তিনগরে আমার দেখা একটি ভয়াবহ অভিজ্ঞতা।
মানবাধিকার আইনজীবী উইলিয়াম নিকোলাস গোমেজ তাকে অপহরণ করে একটি গোয়েন্দা সংস্থা ও র্যাব সদস্যরা ব্যাপক নির্যাতন চালিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন। ই-মেইলে পাঠানো দীর্ঘ অভিযোগপত্রে তিনি নির্যাতনের বিস্তারিত বর্ণনা দেন। পরে টেলিফোনেও তিনি এ নিয়ে কথা বলেন। তার অভিযোগ, গত ২১ মে সায়েদাবাদ থেকে তাকে ধরে নিয়ে অকথ্য ভাষায় গালাগাল এবং উলঙ্গ করে তার ওপর দিনভর নির্যাতন চালানো হয়। একই সঙ্গে পানির সঙ্গে তাকে এমন কিছু পান করানো হয় যে, যাতে বর্তমানে তিনি চরম অসুস্থবোধ করছেন। অ্যাডভোকেট নিকোলাস গোমেজ তার ই-মেইলে স্বাভাবিকভাবে বাঁচার গ্যারান্টি চেয়েছেন। তবে র্যাবের পক্ষ থেকে উইলিয়াম গোমেজকে নির্যাতনের অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে। র্যাবের মিডিয়া ও লিগ্যাল উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার এম সোহায়েল আমার দেশকে বলেন, ‘না এরকম কোনো ঘটনা ঘটেনি।’ অভিযোগ নিয়ে সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তাদের সঙ্গে বারবার যোগাযোগ করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
উইলিয়াম নিকোলাস গোমেজের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে জানা যায়, চিকিত্সার জন্য বর্তমানে তিনি নেপাল রয়েছেন। টেলিফোনে এ আইনজীবী আমার দেশকে বলেন, ‘নির্যাতনের পর গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে এশিয়ান মানবাধিকার কমিশন গত ২৭ মে আমাকে নেপালে নিয়ে আসে। এখানে আমি চিকিত্সা নিচ্ছি। আমার সন্তান স্ত্রী দেশে রয়েছে। জানি
না ওদের ওপর আবার কী নির্যাতনের খড়গ নেমে আসে।’ গোমেজ তার নিজের এবং পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা দাবি করেছে।
আইনজীবী গোমেজ তার অভিযোগে বলেন, ‘২১ মে শনিবার সকাল। কিছু কাজের জন্য আমি বাইরে বেরিয়েছি। কাজ সেরে যখন সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালের কাছ থেকে বাসায় ফিরছিলাম, এক লোক আমাকে ডাক দেন। লোকটি আমার চেয়ে লম্বা, ৫ ফুট ৭ ইঞ্চি হবে। বাসাবোর দিকে যাওয়ার রাস্তায় অপেক্ষমাণ কালো রঙের একটি মিটসুবিশি জিপ গাড়ির কাছে যাওয়ার অনুরোধ করেন তিনি। আমি সহযোগিতার মানসিকতা নিয়ে গাড়িটির কাছে যাই। আমার ধারণা ছিল লোকটি হয়তো পথ ভুলে গেছেন। কিন্তু গাড়িটির কাছে যাওয়ার পর লোকটি আমাকে আগে থেকেই খোলা থাকা দরজা দিয়ে ধাক্কা মেরে ভিতরে ঢুকিয়ে দেন। এ সময় ভিতরে অন্য একজন লোক বসা ছিলেন। দুই ব্যক্তি আমার ডানে ও বামে বসে পড়েন। তারা আমার নাম উইলিয়াম গোমেজ কিনা জানতে চান। আমি হ্যাঁ বললে তারা আমার চোখে কালো চশমা পরিয়ে দেন, যা চোখে দিলে আর কিছুই দেখা যায় না। একই সঙ্গে আমার মাথায়ও মুখোশ পরিয়ে দেন। তারা আমার ব্যাগ, মোবাইল ফোন ও মানিব্যাগ নিয়ে নেন। এরপর আমার মাথার দু’দিকে অস্ত্র ধরে বলে, ‘কুত্তার বাচ্চা কোনো শব্দ করবি না। তাইলে এখনই গুলি কইরা দিমু। তোরে মারার অর্ডার আছে।’ এ সময় ড্রাইভারের বাম পাশে বসা এক লোক গাড়ি সরাসরি হেডকোয়ার্টারে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। গাড়ি দ্রুত চলতে শুরু করলে হঠাত্ অপহরণকারীদের কাছে একটি ফোন আসে। যার কাছে ফোন তিনি জবাব দেন, ‘স্যার, স্যার, কুত্তার বাচ্চারে ধরছি; স্যার স্যার, এখনই হ্যান্ডকাফ দিতাছি।’ গাড়ি দ্রুতগতিতে চলছিল। এরপরই আমাকে হ্যান্ডকাফ পরানো হয়।
প্রায় ৪০ মিনিট চলার পর গাড়িটি একটি জায়গায় থামলে আমাকে বাইরে আনা হয়। দু’জন দু’দিক থেকে আমার হাত ও কাঁধ ধরে সামনে হাঁটতে বলে। আমি বললাম, ‘আমি দেখতে পারছি না। কিভাবে সামনে যাব? তখন একজন আমাকে বলে, ‘কুত্তার বাচ্চা দেখস না? র্যাবের সবকিছু তোরা দেখস। এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন, অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের তোর বাপেরা কিভাবে বাঁচায় দেখব।’
তারা আমাকে কোনো একটা কিছুর মধ্যে ঢুকায় এবং একজনকে ৯-এ চাপ দিতে বলে। তখন আমি বুঝলাম এটা লিফট। আমি কোনো একটি ভবনের নবম তলায় যাচ্ছি। তারা আমাকে একটি রুমে ঢোকায় এবং সম্পূর্ণ নগ্ন করে ফেলে। কেউ একজন বললেন, ‘জারজের বাচ্চা মুসলমানি করা, আবার নাম দিছে খ্রিস্টান। এই কুত্তার বাচ্চা র্যাব, আর্মির বিরুদ্ধে কাজ করবে না কে করবে? সব জারজগুলা এই কাজ করে।’
তখন অন্য লোকটি বললেন, ‘তাড়াতাড়ি! ব্রিগেডিয়ার স্যার আসছেন। এখন বেশি কথা বলা যাবে না। স্যারেরা তাদের কাজ করবেন; অনেক মোটা ফাইল আছে কুত্তার বাচ্চার নামে।’ তারা আমাকে ফ্লোরে ফেলে দেয় এবং বলে, সেজদা দে কুত্তার বাচ্চা।’
আমি বুঝতে পারছিলাম না কী বলব। তখন এক লোক আমাকে জোর করে সেজদার মতো করায় এবং বলে মাথা যেন ফ্লোরে না লাগে। আবার বলে, ‘সেজদা দিয়া থাকবি জারজের বাচ্চা। মাথা তুলবিতো ... গরম ডিম দিমু। হঠাত্ লোকটি আমার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দেয় এবং বলে, স্যার স্যার, বিষয় রেডি।’ পুরো শরীরে কোনো কাপড়চোপড় না থাকায় আমি ভীষণ ঠাণ্ডা অনুভব করছিলাম। এ সময় একটি অপরিচিত কণ্ঠ জানতে চায়, ‘উইলিয়াম গোমেজ, শেষ কবে বিদেশে গিয়েছিলে? ‘গত আগস্টে মনে হয়’—আমি উত্তর দেই। ‘তুই তারিখ ভুলে গেছস, খানকির পোলা। জারজের বাচ্চা, আরটিএইচকে (রেডিও টেলিভিশন হংকং) গিয়া কী কইছস ভুইলা গেছস? কত টাকা পাইছস এইসব দেশবিরোধী কথা বলার জন্য?’ আমি খারাপ কিছু বলিনি জানালে তারা আরটিএইচকে রেডিও প্রোগ্রাম চালু করে এবং বলে, ‘তুই আর তোর এএইচআরসি একমাত্র ভালো, আর হাসিনা খারাপ?’
এ সময়ে আমি দু’বার ফ্লোরে পড়ে যাই। আমি অনুভব করলাম আমার নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে। আমি ভীষণ ঠাণ্ডা অনুভব করছিলাম। এ পর্যায়ে তারা আমার কাছে জানতে চায়, শেষ কবে আমি খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাত্ করেছি? টাকা কোথায়? যে কোটি টাকা পেয়েছো তা কোথায়? আমি বললাম জীবনে কখনও খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করিনি। আমি একজন ধর্মনিরপেক্ষ লোক হিসেবে কখনও কোনো ডানপন্থী লোকের সঙ্গে মিশি না। তখন নতুন কণ্ঠে শুনলাম, ‘কুত্তার বাচ্চা, মিশুর (গার্মেন্ট আন্দোলনে সম্পৃক্ত থাকায় কারাবরণকারী মোশরেফা মিশু) কেসে খালেদা জিয়ার কাছ থেকে কত টাকা পাইছস?’
এ অবস্থায় একজন, যিনি ইংরেজিতে কথা বলছিলেন, ভিনদেশি বলে মনে হয়েছে, আমার কাছে জানতে চাইলেন, ‘এএইচআরসি আপনাকে সোর্স মানি হিসেবে কত টাকা দিয়েছে? র্যাব এবং পুলিশে আপনার কত লোক আছে?’ তিনি আরও জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি মিশুর বিবৃতি কাস্টডি থেকে কিভাবে সংগ্রহ করলেন? আপনি মিশুর মুক্তির জন্য দক্ষিণ কোরিয়ায় কিভাবে প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করলেন?
আমি নীরব থাকলাম। কেননা আমার মনে হচ্ছিল আমার মগজ মাথার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে। তখন একজন জিজ্ঞাসাবাদকারী, যিনি আগেও আমাকে প্রশ্ন করেছেন, বললেন, ‘কুত্তার বাচ্চা চুপ কেন? গলা ফাটাইয়া তোর বাপেরা তো সারা পৃথিবীতে কইতাছে র্যাব নিষিদ্ধ করতে। তোর বাপেদের নিষিদ্ধ করমু, আজকে তোরে আগে নিষিদ্ধ কইরা নেই।’
এরপর তারা জানতে চাইলেন, পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে কবে গিয়েছিলাম? আইএসআই কর্মকর্তাদের সঙ্গে কখন দেখা করেছি?
আমি বললাম, কখনও কাশ্মীর যাইনি। তারা বলল, আমাদের কাছে তথ্য আছে যে, তুই বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, র্যাব ও পুলিশ ধ্বংস করার জন্য আইএসআই কর্তৃক নিযুক্ত হয়েছিস।
আমি বললাম, আমার আইএসআই’র কোনো কর্মকর্তার সঙ্গে কখনও দেখা হয়নি। আমি একজন মানবাধিকার কর্মী। আমি শুধু এএইচআরসি’র জন্য কাজ করি। তারা বলল, ‘আমরা জানি যে, তুই এএইচআরসি’র দালাল। তারা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মহা শত্রু। তোর বস বাংলাদেশ সফরে এসে বলে গেছে, সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করবে। বাসিলের (এএইচআরসি’র সাবেক নির্বাহী পরিচালক) সমস্যা কী? ওই কুত্তার বাচ্চা তো নিজ দেশ থেকে বহিষ্কার হয়েছে। কুত্তার বাচ্চার সাহস কীভাবে হয়, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে কথা বলার।... পোলা, তুই বীরগঞ্জ (দিনাজপুর জেলার একটি থানা) থানা পুড়িয়ে দেয়ার জন্য টাকা দিছস। ডিজিএফআই, এনএসআই রিপোর্টে তাই কয়। এএইচআরসি আর আইএসআই কত টাকা দিছিল? পুলিশের অসম্মান করস? তোর বাপেরা আইসা দেশ চালাইব? তোর সব মেইল আমাদের কাছে আছে? ক কুত্তার বাচ্চা! থানা বার্ন করতে কারে কত টাকা দিছস?’
আমি বললাম, ‘আমি সব সময় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে। এএইচআরসি থেকে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ শিখিনি।’
তখন ওই লোকটি বললেন, ‘আহারে! কত সাধু! তোরাই দেশের সম্মান শেষ কইরা দিতাছস। দেশের উন্নয়ন বন্ধ কইরা দিতাছস। দেশের বাইরে মুখ দেখাইতে পারি না।’
অন্য একজন তখন জিজ্ঞেস করলেন, মানবাধিকার কর্মী রাজ্জাকের ঘটনায় সেনা কর্মকর্তাদের মানহানি ঘটাতে কত টাকা পেয়েছিস? আমি বললাম, ‘আমি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে নই। কিন্তু সেখানে কিছু খারাপ লোক আছে। ক্ষমতা গ্রহণের সময় তারা কিছু মানুষ হত্যা করে। লোকটি তখন বললেন, কুত্তার বাচ্চা! আর্মি খারাপ আর তোমরা ভালো? জারজের বাচ্চা! এনএসআই’র ফাইলে তোর চৌদ্দগুষ্টির খবর আছে। তোর বাপেদের সব খবর আছে। তুই দুলালকে ডিস্টার্ব করস কেন? রাজিব সজীবরে ডিস্টার্ব করস কেন? এই সময় হঠাত্ করে ফোন বেজে উঠল। ফোন ধরে একজন বললেন, স্যার, স্যার, শেষ পর্যায়ে, স্যার।
তখন ওই বিদেশি, যিনি মাতৃভাষা ইংরেজিতে কথা বলছিলেন, জানতে চাইলেন, বাসিল কখন বাংলাদেশে আসবেন?
বললাম, বাসিল সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোর বস আসরাফুজ্জামান কখন আসবে? আমি আবারও বললাম জানি না।’
আমি তখন খুব তৃষ্ণার্ত বোধ করছিলাম। পানি চাইলাম। একটি লোক আমাকে পানি দিল। পানি একটু গরম ছিল এবং স্বাদ স্বাভাবিক পানির মতো নয়। অন্য লোক বললেন, ‘রাজ্জাক একটা দালাল ও প্রতারক। আমাদের ভালো কর্মকর্তা তোর মতো ডাকাতদের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করেছেন। তিনি তার ভাইকে জারজ রাজ্জাককে ধরে এনে চোখ তুলে দেয়ার নির্দেশ দেন। বলেন, চোখটা তুইলা নে। এই কুত্তার বাচ্চা শালার পোলা যেন আর দেখতে না পারে। কুত্তার বাচ্চা রাজ্জাকের জন্য আমাদের ঘুম হারাম। সব জায়গা থেইকা শুধু মেইল আর চিঠি। তুই কুত্তার বাচ্চা ক—কত টাকা পাইছস? পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেটদের বলে দেয়া হয়েছে। এই বার যত খুশি ফাইট কর। ওই শালার পোলা রাজ্জাকের কেস এ কোর্ট আর পুলিশকে আমরা যা রায় দিতে কমু, তাই দিবে।
এ সময় অন্য একজন বললেন, এএইচআরসিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কুত্তার বাচ্চা আছে। আমি তাকে চিনি কিনা জানতে চাইল। বললাম, না। তখন লোকটি বললেন, ‘কুত্তার বাচ্চা তুই চিনস না? আমরা তাকে ভালো শিক্ষা দিয়েছি। সবগুলা দেশদ্রোহী। এইগুলা এই দেশে থাকার যোগ্য নয়। পাসপোর্টগুলো নিয়ে ফেলা দরকার এই কুত্তার বাচ্চাদের।’
আমার কাছে আরও জানতে চাওয়া হলো, কূটনৈতিক মিশনের কারা আমাদের সাহায্য করছে, কোন দেশ অর্থের জোগান দিচ্ছে? আমি বললাম, আমাদের কোনো ফান্ড নেই। জানতে চাইল, কেন আমি ভারতের জেলে আটক বাংলাদেশীদের সম্পর্কে আগ্রহী? কেন আমি ভারতের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকা সরকারের নিন্দা করছি?
ওই লোক আরও জানতে চাইলেন, সরকারের ভেতরের তথ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাছে কে সরবরাহ করেছে? তারা পোস্টার এবং স্টিকার সম্পর্কে জানতে চাইলেন। প্রশ্ন ছিল, পোস্টার ও স্টিকারের নকশা কে করেছে, কে ছাপিয়েছে? বললাম, ডিজাইনারকে চিনি না। একমাত্র জামান ভাই (এএইচআরসি’র স্টাফ মেম্বার) জানেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা ইনস্টিটিউটে তার বন্ুব্দ রয়েছেন। কিন্তু যিনি ছাপিয়েছেন তাকে এবং প্রেসও চিনি। কিন্তু সঠিক ঠিকানা জানি না। তারা জানতে চাইলেন, তুই এসব জিনিস পার্লামেন্টে পাঠিয়েছিস কেন? আমরা সংসদ সদস্যদের কাছ থেকেও অভিযোগ পেয়েছি। তারা নির্যাতন নিয়ে আইন করার কথা বলছিলেন। তাদের জানা উচিত, এই আইন কখনোই পাস হবে না। আমরা এটা নিশ্চিত করব।’
এসময় একজন কর্মকর্তা বললেন, ওর বিরুদ্ধে একটা রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা দেন। তখন অন্য একজন বললেন, না একটা জঙ্গি মামলা দেই। তখন বিদেশিরা বলবে, ও একটা সন্ত্রাসী।
আমি কান্না শুরু করলাম। বললাম, আমার ছোট দুটি ছেলে আছে। দয়া করে আমাকে মাফ করে দিন। আমি কখনও আর এ ধরনের কাজ করব না।
তখন তাদের একজন বললেন, ‘কুত্তার বাচ্চা। তুমি করবা না। তোমার বাবারা তো আজকেই আসতাছে। বিজো ফ্রান্সিস ও জিজো পল। আমরা জানি না মনে করছ! হারামির বাচ্চা, আমাদের ঘুম হারাম কইরা আবার বাইরে থেকে হারামির বাচ্চাদের ডাইকা নিয়া আনতাছো। দেশের উন্নয়ন আর সম্মান শেষ কইরা দিতাছস।
আমি বললাম, ‘আমি আর কখনও এএইচআরসিতে যাব না, কাজও করব না। তখন লোকটি বললেন, তোর কাজ ছেড়ে দেয়ার দরকার নেই। বিজো এবং জিজো বাংলাদেশে থাকা পর্যন্ত ভালোভাবে কাজ কর। আমাদের বৈঠক সম্পর্কে তাদের কিছু বলবি না। স্বাভাবিকভাবে কাজ কর। আমাদের কথা ভালোভাবে শোন। না হলে আমরা জানি কীভাবে শোনাতে হয়।
তখন আমাকে তারা অন্য একটি রুমে নিয়ে প্যান্ট শার্ট পরতে বলে এবং রুম থেকে বের করে নিয়ে এসে একই গাড়িতে তোলে। আমার চোখ খুলে দিলে দেখতে পাই, সেই একই ব্যক্তি গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে আছেন এবং তার হাতে আমার ব্যাগ, মোবাইল ফোন এবং মানিব্যাগ রয়েছে। সেই একই গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে লোকটি বললেন, ‘কুত্তার বাচ্চা! মুখ খুললে মাগুর মাছ দিয়া খাওয়ামু। আমরা তোর সব দেখতাছি।
এই দিনের পর থেকে আমার শারীরিক অবস্থা ক্রমান্বয়ে খারাপ হচ্ছে। পানিতে কিছু মিশিয়ে দিয়েছিল বলে আমার ধারণা। আমার দু’পা বিশেষ করে হাঁটু এবং জোড়া ব্যথা করছে। কখনও কখনও অবশের মতো মনে হয়। হাতে কোনো জোর পাই না। মনে হচ্ছে, যে কোনো সময় পড়ে যাব। ঠিকভাবে ঘুমোতে পারি না। কোনো ছোট্ট শব্দও আমার কাছে খুব বড় মনে হয়। আমার মেরুদণ্ডেও ব্যথা হচ্ছে। আমি প্রায়ই কান্নায় ভেঙে পড়ি, যখন মনে পড়ে তারা আমাকে উলঙ্গ করে এবং জারজ নামে ডাকে।
আমার এখন আত্মহত্যা করতে ইচ্ছা করে। তারা আমাকে অপমান-অপদস্ত করেছে। কিন্তু আমি কিছুই করতে পারিনি।
আমার মনে হচ্ছে, আমার জীবন শেষ হয়ে গেছে। তারা আমাকে সকাল সাড়ে ১০টায় নিয়ে যায় এবং বিকাল সাড়ে ৩টায় বাসায় ফিরে আসি। আমি নির্যাতনের ঘটনা একটি মুহূর্তের জন্যও ভুলতে পারি না। আমি খুব কষ্ট পাই যখন মনে পড়ে আমাকে উলঙ্গ করার কথা এবং দাসের মতো নাকে খত দেয়ার কথা।
আমার বিরুদ্ধে আইএসআইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ থাকার অভিযোগ এনেছে। কিন্তু আমি এ ধরনের লোক নই। আমার জীবনে কখনও কাশ্মীর বা পাকিস্তান যাইনি।
আমি খুব হতাশ এবং ক্লান্তি বোধ করছি। আমার মাথায় ব্যথা হচ্ছে। আমার মাথার মধ্যে কী যেন ঘুরছে। আমাকে যারা উলঙ্গ করেছে তাদের জানাতে চাই, আমি ক্ষমতাহীন, গরিব ও দুর্বল লোক। কিন্তু আমি নির্ভীক। নিরাপত্তা বাহিনী যেভাবে হত্যা করে, তাদের হাতে আমি সেভাবে নিহত হতে চাই না। আমি ভালোভাবে ঘুমাতে চাই। আমি এখনও মানবাধিকার আইনজীবী হিসেবে বেঁচে থাকতে চাই।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা জুলাই, ২০১১ সন্ধ্যা ৭:১৫