গতকাল ছিল ১২ রবিউল আওয়াল, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ সা. এর জন্ম ও ওফাত দিবস। ৫৭০ খ্রীষ্টাব্দের সোমবার ছিল ০৮ রবিউল আওয়াল। আর সে কারণেই মহানবীর জন্ম তারিখ নিয়ে মোহাদ্দেসগণ ও আলেমদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন মত থাকলেও ১২ রবিউল আওয়াল তাঁর ওফাত দিবস এতে কোন সন্দেহ নেই। আমাদের কাছে এমন এক সময়ে তাঁর জন্ম ও ওফাত দিবস আসলো, যখন ফ্রান্সে তাঁর ব্যঙ্গচিত্র অংকনের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছে সকল ধর্মপ্রাণ বিশ্ব মুসলিম উম্মা ও বিশ্ব নেতারা। উদারপন্থী ভিন্ন মতাবলম্বীনেতারাও এই ধরনের উস্কানীর জন্য কড়াভাবে ফ্রান্স ও সেদেশের প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রনের সমালোচনা করেছেন। মুসলমান ধর্মপ্রাণ মানুষের হৃদয়ের গহীনে থাকা নবী সা. এর প্রতি তাদের ভালোবাসা প্রকাশে কোন কার্পণ্যতা নেই। চলুন জেনে নেই, সাহাবীরা মুহাম্মদ সা. কে কতটা ভালবাসতেন, কেমন করে জান-মাল দিয়ে অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেছেন তাঁর সুন্নত ও জীবন-যাপন।
মুহাম্মদ সা. এর হিজরতের সময় শত্রুর আক্রমণ থেকে বাঁচতে পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাঁর সাথে ছিলেন হযরত আবুবকর রা.। মক্কা থেকে মদীনার দিকে যেতে দীর্ঘ পাহাড়ি পথ পাড়ি দিতে যেয়ে দু’জনই খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েন। গুহায় আশ্রয় নেবার পর আবু বকর রা. এর কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েন মুহাম্মদ সা. । এ সময় গুহায় বিষাক্ত কোন পোকামাকড় এবং বিষাক্ত সাপ ঢুকে যেন নবী সা. কে কামড়াতে না পারে, সেজন্য তার পরনের জামা ছিঁড়ে গুহার চারপাশে থাকা ছিদ্রগুলো বন্ধ করে দিয়েছেন। একটি ছিদ্র বন্ধ করার জন্য কোনকিছু না পেয়ে তার পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে বন্ধ করে রেখেছিলেন। হঠাৎ সেই আঙ্গুলে বাইরে থেকে একটি বিষাক্ত সাপ দংশন করে। বিষক্রিয়ার কারণে প্রচণ্ড ব্যথায় আবু বকর রা. এর চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরতে লাগলো। গরম সেই অশ্রুজল মুহাম্মদ সা. এর বদন মোবারকে পড়ে। সাথে সাথেই হযরত মুহাম্মদ সা. জেগে উঠে আবু বকর রা. কে জিজ্ঞেস করলেন কেন এতো কষ্ট সইলেন তার জন্য? মুহাম্মদ সা. তাঁর লালা মোবারক সেই আঙ্গুলে লাগিয়ে দিলে তার ব্যথা সেরে ওঠে। নিজের জীবন সংহার হতে পারে জেনেও আবু বকর রা. এইভাবেই মুহাম্মদ সা. এর সেবায় নিবেদিত ছিলেন।
মিরাজে গমনের কয়েকমাস পূর্বের ঘটনা, মুহাম্মদ সা. আবু বকরকে বলেছিলেন, আমার বোধহয় মিরাজের যাবার সংবাদ আসতে পারে। প্রয়োজনীয় নির্দেশনা শুনতে ও আমাকে সহায়তা করতে তুমি প্রস্তুত থেকো। মিরাজের ঠিক আগেরদিন গভীররাত্রে আবুবকরের বাড়িতে যেয়ে দরজায় টোকা দিলেন মুহাম্মদ সা. । এক টোকাতেই দরজা খুলে মুখোমুখি হলেন আবু বরক রা.। নবী করিম সা. জিজ্ঞেস করলেন- এক টোকা দিতেই দরজা খুলে দেল যে? তুমি ঘুমাওনি? আবু বকর রা. বললেন- হে মহাম্মদ সা., প্রায় ছয়মাস আগে আপনি আমাকে বলেছিলেন, আমি যেন প্রস্তুত থাকি, আপনি মিরাজে গমন করবেন। সেই থেকে আজ অবধি একটি রাত্রের জন্যও আমি আমার পিঠ বিছানায় ঠেকাইনি। আমি ঘুমিয়ে গেলে কোন রাত্রীতে এসে আপনি যদি আমাকে ডেকে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকেন, তবে আপনার কষ্ট হবে ভেবে এবং আপনার সাথে বেয়াদবী হবে ভেবে আমি এই দরজাতেই হেলান দিয়ে সারারাত্র দাঁড়িয়ে কাটিয়েছি। যাতে করে আপনি ডাকা মাত্রই, আমি মুহূর্তেই আপনার খেদমতে হাজির হতে পারি।
হিজরতে যাবার পথে আবু বকর রা. মক্কা শরিফের দিকে তাকাচ্ছিলেন আর কাঁদছিলেন। নবী করিম সা. জিজ্ঞেস করলেন- আবু বকর, মক্কায় তোমার স্বজন, পরিবার পরিজন রেখে, নিজের ভিটা ভূমি ছেড়ে মদীনার দিকে যাচ্ছো বলে মন খারাপ হচ্ছে? এই জন্য কাঁদছো? আবু বকর চোখ মুছতে মুছতে বলেছিলেন- ইয়া রাসুলুল্লাহ্, আমি ঐসব কারণে কাঁদছি না। আপনার মতো রাহমাতুল্লিল আ’লামীনকে যে মক্কাবাসীরা চিনলো না, সেই দুঃখ ও কষ্টেই আমি কাঁদছি।
একবার হযরত আলী রা. তার শিশুপুত্র হোসাইনকে কোলে তুলে আদর করছিলেন। হোসাইন রা, আলীকে প্রশ্ন করলেন- বাবা, তুমি আমাকে আদর করছো কেন? আলী রা. জবাবে বললেন- তোমাকে স্নেহ করি, ভালবাসি তাই। হোসাইন রা. আবার জিজ্ঞেস করলেন- বাবা, তুমি আর কাকে কাকে ভালবাসো? আলী রা. বললেন- তোমার ভাই হাসানকে, তোমার মা ফাতিমাকে আর মুহাম্মদ সা.কে। হোসাইন এবার আবারো প্রশ্ন করলেন- বাবা, তুমি কাকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসো? হযরত আলী রা. জানালেন- হোসাইন তুমি শুনে রাখো, আমি সবচেয়ে আমাদের প্রিয় রাসুল, নবী, বিশ্বের সেরা মানুষ, শ্রেষ্ঠনবী হযরত মুহাম্মদ সা. কে সবচেয়ে বেশি ভালবাসি, তোমার চেয়েও বেশি ভালবাসি আমার প্রাণের চেয়েও বেশি ভালবাসি। উনি যদি ডাক দেন তবে পৃথিবীর সবকিছু ফেলে, এমনকি তোমাকেও কোল থেকে ছুঁড়ে ফেলে তাঁর ডাকে সাড়া দিতে ছুটে যাবো।
একবার এক ইহুদি ও এক মুসলিমের মধ্যে জমি নিয়ে বিরোধ হলো। বিচারের জন্য তারা রাসুলুল্লাহের কাছে আসলেন। রাসুলুল্লাহ্ বিচারের রায় দিলেন, যা কি না মুসলিমের বিপক্ষে গেলো। এতে সেই মুসলিম ভাইটি খুব মনঃক্ষুন্ন হলেন এবং এই বিচারটি পুনরায় করার জন্য হযরত ওমর রা. এর কাছে গেলেন। ওমর রা. পুরো ঘটনাটি শুনে রাগান্বিত হয়ে ঘর থেকে তলোয়ার বের করে আনলেন- বললেন, মুহাম্মদ সা. এর বিচার যে মানে না, তার বিচার এই তলোয়ারের মাধ্যমেই করতে হবে।
হযরত মুহাম্মদ সা. এমনই এক ১২ রবিউল আওয়ালে এই পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। ওমরের কানে যখন এই সংবাদ এলো, তখন ওমর তার শরীরের পোশাকে ঝোলানো তলোয়ার খাপ থেকে একটানে বের করে চিৎকার করে বলতে থাকলেন- যে বলবে, মুহাম্মদ মারা গেছেন, যে বলবে মুহাম্মদ সা. আর নেই, তার শিরচ্ছেদ করবো আমি। নবী সা. কখনোই আমাদের ছেড়ে চলে যেতে পারেন না। তাঁর মুত্যু হতে পারে না। অবশেষে তাঁকে অনেক বোঝানোর পর অর্থাৎ মানুষকে যে মরতেই হবে, পবিত্র কোরআনের এই সমস্ত আয়াত শুনিয়ে তাকে শান্ত করা হয়।
মুহাম্মদ সা. এর মৃত্যুর ঠিক পর থেকেই বেলাল রা. মদীনার মসজিদে নববীতে আর আযান দেননি। তিনি বলেছিলেন- যে আযান শুনে প্রিয় নবী সা. নামাজে দাঁড়াতেন, সেই নবীই যখন নেই, তখন আর আমার আযান দেবার কোন প্রয়োজন নেই। দুঃখে কষ্টে, বিরহে তিনি মদীনা ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যান। তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। অনেকদিন পর, বেলাল রা. হঠাৎই মদীনার নববীতে আসলেন। হোসাইনের অনেক অনুরোধে সেদিন তিনি শেষবারের মতো নববীতে আযান দেন। আযান দিতে থাকার সময়- হাইয়া আলাস সালা, হাইয়া আলাস সালা বলতে বলতেই দাঁড়ানো থেকে মাটিতে পড়ে যান। তারপর থেকেই তিনি অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়েন। একসময় হযরতের বিরহে তিনিও বিদায় নেন পৃথিবী থেকে।
এইরকম বহু উদাহরণ রয়েছে- মহানবীর প্রেমে সাহাবীরা কেমন পাগল ছিলেন। আমাদের উচিৎ তার প্রতি প্রেম ও ভালবাসা প্রদর্শনের জন্য তাঁর সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরা। মহান আল্লাহ্ পাকের কোরআনকে আঁকড়ে ধরা। তবেই সত্যিকার অর্থে তাঁর প্রতি ভালবাসা ও টান প্রমাণ করা যাবে। আজকের এই দিনে যারা তাঁর সুন্নাহ মোতাবেক জন্মদিন বা ওফাত দিবস পালন না করে বেদাত করছে, তাদেরকেও সে পথ থেকে ফিরে এসে সুন্নাতের পথে কোরআনের পথে চলতে হবে। জীবদ্দশাতে মুহাম্মদ সা. বিধর্মী ও ইহুদিদের সাথে কোন এবাদতে বা কোন অনুষ্ঠানের সাথে মুসলমানদের কোনকিছু যেন মিলে না যায়, সে ব্যাপারে সাহাবীদেরকে সতর্ক করেছেন বার বার, যা তাঁর হাদিসে ও সুন্নাতে বিশদভাবে বর্ণিত রয়েছে।
প্রিয় বন্ধুরা, এই পোস্টটির ভিডিও উপস্থাপনা ভার্সন Free SKY tv চ্যানেলটিতে দেখে নিতে পারেন। সাবস্ক্রাইব করার জন্যও অনুরোধ রইল। লিঙ্ক: https://youtu.be/qj3pV0ZjcLo