ব্রয়লার মুরগী কেনার জন্য দোকানের সামনে অপেক্ষা করছি। বারো বছরের একটি ছেলে ছয় বছর বয়সী একটি ছেলেকে ইশারা দিয়ে বলল- অই দ্যাখ, স্যারে কি চায়? একদম ছোট্ট একটি ছেলে কাছে এসে জানতে চাইলো- কী ধরনের মুরগী চাই? তার কচি ঠোঁট গলিয়ে যেন এখনো স্পষ্ট করে কথাই বের হতে চাচ্ছিল না। তারপরও শিখে নেয়া পেশাদার বিক্রেতার মতো করে স্বভাষায় প্রশ্ন করলো আমাকে। আমি কী মুরগী কিনবো! তাকেই যেন দেখছিলাম। এর আগের বার এই দোকানে এমন পিচ্চি বয়সের কাউকে দেখিনি। মনে হচ্ছে নতুন নিয়োগ দেয়া হয়েছে। খুব কষ্ট হলো তাকে এই বয়সেই কাজে নেমে যেতে দেখে। ক্রেতার চাহিদা বুঝে মুরগী খাঁচা থেকে ধরে জবাইয়ে সহযোগিতা করা, ক্যাশে টাকা রাখা, কোন টাকা ফিরতি থাকলে তা ক্রেতাকে ফেরত দেয়া, গরম পানিতে মুরগী চুবানো, ড্রেসিং করার মেশিনে মুরগী ঢোকানো, পলিথিনে প্যাকেট করে ক্রেতার হাতে দেয়া ইত্যাদি সব কাজই তাকে করতে হচ্ছে। কিছু ভুল হচ্ছে, তা আবার কিশোর ছেলেটা তাকে ধমক দিয়ে দিয়ে শিখিয়ে দিচ্ছে। মনে হচ্ছে কতো বড় মানুষ সে, সব অর্ডারই যেন সে বুঝতে পারছে। এইসব দেখে আমার অমন কাছাকাছি বয়সের সন্তানের মুখচ্ছবি ভেসে উঠলো। চোখের কোণে কখন জল জমা হয়ে গড়িয়ে গেছে বুঝতেই পারিনি। এমনও তো হতে পারে ছোট্ট এই শিশুটির বাবা বা মা বেঁচে নেই। এই বয়সেই তাকে জীবিকার ঘানি টানতে হচ্ছে। কচি ঐ হাতদু’টি যেন ঠিক আমার সন্তানের হাত। হঠাৎ করেই এই এক বাবার বুক যেন ডুকরে নয়, হাউমাউ করে কেঁদে উঠতে চাইলো।
আবার পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে ভাবলাম- এই করোনা মহামারীতে কতজনের যে চাকরি গেছে তার কি কোন ইয়ত্তা আছে? যাদেরও চাকরি আছে তারা কোনমতে টিকে আছে। মানবসম্পদ বিভাগের একজন প্রধান হিসেবে আমার কাছে প্রায় প্রতিদিনই অনেক মোবাইল কল আসে। তাদের কাছ থেকে শুনতে পাই বিভিন্ন অভিজ্ঞতার কথা। কষ্টের কথা। এই সময়ে কারখানার উৎপাদন কম, এনজিওগুলোর ফান্ড কমে গেছে, কিছুক্ষেত্রে অফিস পরিচালনার জন্য সামান্য কিছু ফান্ড দেয়া হলেও শুধু নিভু নিভু করে প্রকল্পগুলোর হাল ধরে রেখেছে তারা। কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো খুব সাবধানে বুঝে শুনে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। যেন হাতে ধরে ধরে খরচ ও বিনিয়োগ করছে। প্রত্যেকটা খরচ যেন একেবারে চোখের সামনে দিয়ে স্পষ্ট করে দেখা যাচ্ছে। মুনাফা কম হোক, ব্রেকইভেনটা যেন পড়ে না যায় –এই অবস্থায় চলছে সব। এর খড়গ নেমে এসেছে স্বাভাবিকভাবেই কর্মচারিগণের উপরও। তাদের বেতনের উপর কাটছাঁট হয়েছে। অর্ধেক বেতনে অনেকেই কাজ করছেন, কারো আবার পুরো বেতনটাই নেই, শুধু চাকরি আছে। মহামারী শেষে বা এর মধ্যেও ক্ষতি পুষিয়ে লাভের মুখ দেখলে বেতন ভাতা সব হিসেব করে পরে দেয়া হবে। অনেক পেশাতেই অনলাইনে কোন কাজ নেই। সরাসরি মাঠে ময়দানে যেয়ে কাজ করতে হয় এমন চাকরির ক্ষেত্রে কী বিকল্প থাকতে পারে?
মানুষের হাতে যা সঞ্চয় ছিল সবই প্রায় অনেক আগেই শেষ হয়েছে। এখন তাহলে কীভাবে জীবন যাপন করবে? এ নিয়ে ভাবনার মধ্যেই অনেকেই তার অনেক ভাললাগার ঢাকা শহর বা অন্যান্য শহর ছেড়ে নিজ নিজ ভিটেয় চলে গেছেন। নিজের বসত বাড়িতে নিজের হাতে সব্জি লাগিয়ে আর কিছু জমিজমা থাকলে তা দিয়ে কোনমতে দিনাতিপাত করছেন। এমন অবস্থায় ছোট্ট ঐ শিশুর চাকরি করার দৃশ্যটি যেন আমার চোখ অনেক পেছনের স্মৃতিতে ফিরিয়ে নিয়ে গেলো। খবিজলের দোকান নামে আমাদের এলাকায় একটি মুদির দোকান ছিল। এখনো আছে। কিন্তু সেই জৌলুস নেই। কারণ এখন অনেক হালনাগাদ, অনেক পণ্যে ঠাসা নতুন নতুন দোকান চারপাশে তৈরী হয়েছে। খবিজলের সেই দোকানে পণ্যাদি কেনার জন্য অনেক দূরের গ্রাম থেকেও লোকজনকে আসতে দেখেছি। দোকানটিতে একটি ছোট্ট শিশু কাজ করতো। ঠিক এই শিশুটির মতোই। নূর নিদান নামের সেই শিশুটি লেখাপড়া করার কোন সুযোগ পায়নি। সেই দোকানেই তার শৈশব, কৈশোর, যুবক বয়স থেকে মধ্য বয়স পেরিয়েছে। এখন সে থানার বাজারে বিরাট দোকানের মালিক। নিজের জমি, দেয়াল দেয়া বাড়ি, মাছের ঘের, পুকুর, সব্জি বাগান -গ্রামে বসেই কোটিপতি সে। এখন তাকে দেখে কী বোঝার কোন উপায় আছে যে সে অশিক্ষিত? সুন্দর করে শুদ্ধ ভাষায় কথা বলে, মেম্বার চেয়ারম্যানদের সাথে মেশে, কখনো কখনো স্থানীয় এমপি’র সাথেও বসে চা থেতে দেখা যায়। শুধু নিজের পরিশ্রম আর একাগ্রতা দিয়ে লেখাপড়া না করেও নিজের পায়ে শক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত সে। তার ছেলেমেয়েরাও এখন স্থানীয় স্কুলে ও কলেজে লেখাপড়া করছে। তার ঘরে এখন ইউএইচডি টিভি, ইন্টারনেট, পালঙ্ক, সোফা, দেয়ালে টানানো সবুজপ্রকৃতি ও নানা দৃশ্যাবলীর ওয়ালম্যাট, টাইলস্ ফ্লোর, অ্যাটাচড্ বাথরুম, গ্যাস সংযোগসহ রান্না ঘর আরো কতো কী!
আক্ষেপ করে দুঃখ ভাগাভাগি করে নেয়া বন্ধুরা বলে- অথচ, এতো এতো পড়ালেখা করে ডিগ্রি নিয়ে প্রশিক্ষণ করে জীবনে কী পেলাম? হিসেব কষতে গেলে লজ্জায় পড়তে হয়? অনেকেই প্রশ্ন করে এই অবস্থা কেন আপনার? এতোগুলো বছর, সময় তাহলে আপনি কী করলেন? হ্যাঁ সত্যি, বানের জলে ভেসে গেছে সময়গুলো। তথাকথিত শিক্ষিত হওয়া, গাড়ি ঘোড়া চড়ার স্বপ্ন বাদ দিয়ে যদি এই ছোট্ট শিশুটির মতো একেবারে মায়ের পেট থেকে পড়েই কর্মজীবনে প্রবেশ করতে পারতাম, তবে বোধকরি নূর নিদানের কাছাকাছি না হতে পারলেও কম হতাম না। অন্ততঃ এমন শিক্ষিত-অনিশ্চিত জীবন থেকে নিশ্চয়ই মুক্তি মিলতো।
এটা নিশ্চয়ই ঠিক যে, সুস্থ সভ্যতার জন্য শিশু শ্রম নিঃসন্দেহেই অনভিপ্রেত; এই অপরাধ ও অন্যায় এই সমাজের পূর্বসূরিদের, দায়িত্ববানদের, সমাজ ও রাষ্ট্রচালকদের। একটি স্বাভাবিক জীবন ব্যবস্থা ও সভ্য, সুস্থ, সুন্দর পৃথিবীর জন্য সবার উন্নয়ন ঘটুক মননে, মেধায়, অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতায় ও স্বচ্ছন্দ স্বাভাবিকতায়।