হাত, পা, টাকা, পয়সা, পোশাক, বাবা, মা, সন্তান, আত্মীয়, স্বজন, বন্ধূ, খাবার সবই আছে কিন্তু একটা জিনিস নেই, তা হলো- মনের শান্তি। আর এই জিনিসটা না থাকলে পুরো সৌরমন্ডলী আপনার হাতে তুলে দিলেও বিন্দুমাত্র স্বস্তি খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। ফেরআউন বাদশার ঘটনা মনে আছে নিশ্চয়ই। হযরত মুসা আ. এর সময়কার কথা। আকাশ কালো করে মেঘের মতো আকৃতিতে মশার বাহিনী ফেরআউনকে আক্রমণ করেছিল আর কিছু মশা কান আর নাকের ভেতর দিয়ে মগজে ঢুকে গিয়েছিল। তারপর মগজে আক্রমণ। এরপরের ঘটনা তো সবারই জানা। দুই পালোয়ান নিয়োগ দেয়া হলো মাথায় আঘাত করার জন্য। আঘাত করলেই মশারা কামড়ানো বন্ধ রাখে আর ফেরআউনের শান্তি লাগে। কিন্তু সত্যি কি শান্তি পাচ্ছিল? কারণ মোটা মোটা লাঠির আঘাত তো তাকে সহ্য করতে হচ্ছিল। ফেরআউনের বিশাল সেনাবাহিনী সেদিন সামান্য মশার আক্রমণে বেদিশা হয়ে পড়েছিল। অবশেষে তার মাথা ফেটে মগজ ছিটকে মৃত্যুকে বরণ করে নিতে হলো। অথচ হযরত মুসা কালিমুল্লাহ্’র ছিল একটি লাঠি মাত্র। যা তার বিভিন্ন মু’জেযায় ব্যবহৃত হতো। সর্বোপরি মহান আল্লাহ্’র রহমত আর সাহায্য ছিল।
সুখি মানুষের জামার কথাও মনে আছে নিশ্চয়ই। সুখ পেতে হলে জামারও প্রয়োজন নেই। খালি গায়ে্ দাওয়ায় শুয়ে প্রকৃতির হাওয়া খেতে খেতেও সুখি হওয়া যায়। সুখ খুব আপেক্ষিক বিষয়। সুখি হলেই শান্তির খোঁজ মেলে। সারা জাহান বিত্ত বৈভবে রত্ন মাণিক্যে মুড়িয়ে উপহার হিসেবে নিতে পারতেন হযরত মুহামম্দ সা.। মহান রব্বুল আলামীনের সবচেয়ে প্রিয় এই হাবিবকে পৃথিবীতে শান শাওকাতে জৌলুশে অবগাহন করাতে পারতেন। অথচ তাঁকে দিয়ে কত কষ্টই না করিয়েছেন। তারপরও কত মানসিক প্রশান্তিতে দিন যাপন করেছেন এই মহামানব। অন্যদেরকেও প্রশান্তিতে রেখেছেন। যে পথ দিয়ে হযরত মুহাম্মদ সা. হেঁটে যেতেন সেই পথে অনেকটা সময় ধরে এমন শান্তিময় আবহ বিরাজ করতো যে, মানুষ বুঝতে পারতো এই পথে সেরা মানব প্রিয় নবী হেঁটে গেছেন। আর যে সকল নবীর বাদশাহী ছিল তাঁদেরকে তাঁদের সীমাবদ্ধতার কথা সবসময় স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।
পৃথিবীর মানুষগুলো এখন খুব বেশি পরিমাণে অস্থির। খুব সহজেই সবকিছু পেতে চায়। সবকিছুতেই প্রত্যাশার চাপ বেশি। সন্তান, স্বামী, অফিস, সংসার, পরিবার সবকিছু থেকে শুধু চাই চাই অভ্যাসটা এখন মজ্জাগত হয়ে গেছে। যতটা না মনের স্বাস্থ্যের কথা ভাবি, তারচেয়ে বেশি শারীরিক চাহিদা ও ভোগবাদিতার কথা ভাবি। মন বলে যে কিছু আছে তা যেন একদমই পাত্তা দেই না। আমরা ভাবি ধাতব সুখেই বুঝি মনের সুখ মেলে। আসলে তা নয়। মনের সুখ পেতে হলে মনের খোঁজ নিতে হবে। ধর্মীয় আচার পালন করা, ভালো বই পড়া, বিখ্যাত মানুষদের জীবনী পড়া, অনুপ্রেরণামূলক গল্প বা নাটক দেখা, উদার হতে শেখা, সবসময় প্রথম হবার বিষয়টিতে উন্মুখ না থাকা, বিকল্পতে সুখি থাকা, অন্যের সফলতায় খুশি হওয়া, জীবনের দুষ্ট বাঁকগুলোকে সহজভাবে নেয়া, ছোট ছোট সফলতাগুলোকে সেটিব্রেট করা, ধৈর্য্য ধরতে শেখা, উদ্দীপনামূলক গান শোনা, সবাইকে আপন ভাবা, মানবিক হওয়া, সামাজিক কাজে নিজেকে অংশগ্রহণ করানো, সৎ থাকা, খোলা মনের হওয়া, সমস্যা সমাধানে আলোচনা করা, খেলাধুলা করা, লেখালেখি করা, বেড়ানো, মহৎ দৃষ্টান্তগুলো অনুসরণ করা ইত্যাদি বিভিন্ন উপায়ে মনের স্বাস্থ্যকে উন্নত করা যায়।
মনে রাখতে হবে, মহান আল্লাহ্ পাক প্রতিটি ঘটনাকে নিয়ন্ত্রণ করেন। ঈমানদার ব্যক্তিগণ অদৃষ্টে বিশ্বাস করেন। যেকোন সমস্যাতেও ভালোর দিকটি খোঁজেন। কোন অবনমনে আক্ষেপ প্রকাশ করেন না। এটা হলে ভালো হতো, ওটা হলে ওটা হতো -এই রকম দোলাচলে থাকেন না। বরং বিশ্লেষণী হয়ে সঠিক ভাবনাটা ভাবার চেষ্টা করেন। মহান আল্লাহ্’র উপর ভরসা রেখে সততা নিয়ে জীবন যাপন করার চেষ্টা করেন। হযরত মুহাম্মদ সা. যাকে সৃষ্টি না করলে কোনকিছুই সৃষ্টি করতেন না আল্লাহ্ পাক। সেই মহানবীর জীবনে কত দুর্ঘটনা, অপমান, কষ্ট সয়েছেন। হাসান হোসাইনের ইতিহাস, খলিফাদের ইতিহাস, মুসা. আ., ঈসা আ., মরিয়ম রা., আছিয়া রা., ইব্রাহীম আ., ইসমাঈল আ., নূহ আ., আইয়ুব আ., আদম-হাওয়া আরো অনেক অনেক নবী রাসুলদের জীবনে কত রকমের পরীক্ষা ঝড়-ঝঞ্ঝা বয়ে গেছে, কখনো তাঁরা আল্লাহ্’র রহমত হতে নিরাশ হননি। অথচ আমাদের এ কি হলো যে আমরা চোখ কান বন্ধ রেখে শান্তির খোঁজে, ভাল থাকার খোঁজে ক্লান্ত?
কারো সম্পদের অভাব নেই, অথচ ভালবাসার অভাব বোধ করেন। আবার কারো সম্পদ নেই, অথচ ভালবাসা অপার। কারো সম্পদ, ভালবাসা সবই আছে তারপরও অশান্তিতে থাকেন। কারো অর্থ নেই, সুযোগ নেই, অথচ ভাল কিছু বন্ধু আছে। কারো টাকা, সম্পদ, বন্ধু, বধূ, স্বামী, সন্তান সব আছে অথচ পরিবেশ ভাল নেই। পৃথিবীতে হাজারো রকমের পরিস্থিতি পরিবেশ রয়েছে। পৃথিবীতে অপূর্ণতা থাকবেই, এটা স্বাভাবিক। অপূর্ণতা বাদ রেখে পূর্ণ জায়গাগুলো থেকেই শান্তি খুঁজে নিতে হবে। বিশ্বখ্যাত পদার্থ বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংও ২২ বছরের পর থেকেই দুরারোগ্য ব্যাধিতে (মটর নিউরন) আক্রান্ত হয়ে ৭৬ বছর বয়স পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন। গালের মাংসপেশির স্পন্দন থেকে কম্পিউটারে তা বিশ্লেষণ করে তারপর তার কথার অর্থ বুঝে নিতে হতো। এভাবেও সে প্রেম করেছেন, সংসার করেছেন কয়েকজন নারীর সাথে। বিশ্ববিদ্যালয়ে, সেমিনারে লেকচার দিয়ে গেছেন আমৃত্যু। দিয়ে গেছেন বৈজ্ঞানিক কত সূত্র ও ভবিষ্যদ্বাণী। আড়মোড় ভেঙ্গে এখনই জেগে উঠুন। হোন অনন্য মানুষ, থাকুন পরম শান্তিতে।