আগেরদিনে ছোটদের সবচেয়ে বড় বিনোদন ছিল মেলায় গিয়ে বায়োস্কোপ দেখা। আমার জন্ম বায়োস্কোপের যুগে না হলেও যখন থেকে একটু একটু বুঝতে শিখেছি, তখন থেকেই সিনেমা ব্যাপারটার সাথে আমার পরিচয়। আমার মা খুব সিনেমা দেখতে পছন্দ করেন। তিনি প্রায়ই আমাকে নিয়ে সিনেমা দেখতে চলে যেতেন। তখন আমরা বরিশাল শহরে থাকতাম। আমার নানী বাড়ির পাশেই ছিলো একটা সিনেমা হল। আমার মা আমাকে নিয়ে চলে যেতেন সেই সিনেমা হলে। কত কত সিনেমা। মনে আছে তখন মাত্র মুক্তি পেয়েছে রঙিন রূপবান। আমার মা-বাবা-দাদী-নানী সবাই মিলে রঙিন রূপবান দেখতে গেলাম। তখন এখনকার মতো সিনেমা হলে পপকর্ন পাওয়া যেতো না। তবে আইসক্রিম পাওয়া যেতো। বাচ্চা স্বামী রহিমকে কোলে নিয়ে রূপবানক জঙ্গলে জঙ্গলে কেঁদে কেঁদে ফিরে, তাই দেখে আমার দাদী-নানীরা হাউমাউ করে কাঁদছে, আর আমি আমার একটা আইসক্রীম শেষ করে হাত মাখামাখি করে আর একটা আইসক্রীমের জন্য চিতকার করছি, এই হলো আমার প্রথম সিনেমা দেখার স্মৃতি। এরপর আমার মায়ের সাথে গিয়ে দেখা মুভিগুলোর একটু আধটু মনে আছে। হাতি আমার সাথী, মিস লংকা, বেইমান, চোর, বদনাম এই কয়টা সিনেমার নাম মনে আছে। আর একটা মনে আছে “ফুলশয্যা”। যদিও সিনেমার নামের মানে তখনও জানি না, তবে মনে আছে একটা দৃশ্যে আমার বাবা কিংবা মা আমার চোখ চেপে ধরেছিলেন।
সিনেমা নিয়ে আর একটা জিনিস মনে পড়ে, তখন কোন নতুন সিনেমা হলে এলে, রিক্সায় করে মাইকিং করে পাবলিসিটি করা হতো। আমার মনে আছে যখন এমন কোন মাইক সহ রিক্সা আমার দাদী বাড়ির সামনে দিয়ে যেতো, আমরা ছোট ছোট বাচ্চারা তার পেছন পেছন দৌড়োতাম। মাঝে মাঝে সেই রিক্সা থেকে প্রিন্ট করা এক কালারের নায়ক নায়িকার ছবি সহ ছোট ছোট লিফলেট ছুড়ে দেয়া হতো। সেই লিফলেট পাবার জন্য আমরা কত বহুদূর চলে যেতাম সেই সব রিক্সার পেছন পেছন। যতক্ষন লিফলেট না ছোড়া হচ্ছে আমরা দৌড়ুচ্ছি তো দৌড়ুচ্ছিই।
এরপর আমরা ঢাকা চলে আসি। ঢাকায় এসে সিনেমা দেখার স্মৃতি মনে হয় কেবল টিভিতেই সীমাবদ্ধ ছিলো প্রথমদিকে। মাসুদ মামা বলে আমার এক মামা ছিলেন যিনি মাঝে মাঝে গ্রাম থেকে ঢাকা এসে আমাদের বাসায় উঠতেন। তিনি একবার খুব আয়োজন করে একটা ভিসিআর ভাড়া করে নিয়ে এলেন। সাথে আনা হলো দুইটা সিনেমা। একটা ‘আমার তুমি’, আর একটা ‘সবার উপরে’। আমার বাবা মা উত্তম সুচিত্রার সিনেমা খুব পছন্দ করতেন। কিন্তু কোন একটা কারনে সবার উপরে সিনেমাটা চললো না। তাতে তাদের কি মন খারাপ।
এরপর মনে হয় সিনেমা দেখা হয় হুমায়ূন আহমেদ এর শঙ্খনীল কারাগার। তখনও বেশ ছোট। তাই মুভিটা খুব বোরিং লেগেছিলো।যদিও কিছুদিন আগে আবার দেখলাম। খুব ভালো মেকিং না হলেও ভাবতেই অবাক লাগে এতো সুন্দর করে কেউ কিভাবে গল্প লিখে! মনে রাখার মতো সিনেমা দেখি সত্যজিত এর মৃত্যুর পর। পথের পাঁচালী বিটিভিতে। মনে হয় তখন ক্লাশ ফাইভে পড়ি। কিন্তু কি এক মোহে দেখেছি পথের পাঁচালী। সাধারন সাদাকালো সিনেমা। তারপরও তাতেই বুদ হয়ে থাকি। নিজেকে মনে হয় অপু। মনে হয় বোন দূর্গার সাথে ছুটে বেড়াচ্ছি কাশবনে। সেটাই আমার প্রথম সত্যিকারের সিনেমা দেখা।
এরপর ভালো ভাবে সিনেমা হলে গিয়ে দেখা মুভি গুলোর মধ্যে অবশ্য বলবো দীপু নাম্বার টু। কিশোর বয়সে ভালো লাগার মতো একটা সিনেমা। কিশোর বয়সের সিনেমা প্রসঙ্গে একটা গল্প না করলেই নয়। তখন ক্লাশ টেনে পড়ি। মুখস্থ বিদ্যায় ভালো ছিলাম বলে আমি স্কুলে মাঝে মাঝেই ফার্স্টবয় হয়ে যেতাম। তখন আমাদের মেট্রিক পরীক্ষা উপলক্ষ্যে সকালের সিফটে কোচিং হতো। কোচিং এর পর হতো ক্লাশ। তো একদিন আমরা আট দশজন মিলে ঠিক করলাম যে আজ আর কোচিং এর পর ক্লাশ করবো না। তাই আমরা ক্লাশ না করে রমনা পার্কে চলে গেলাম আড্ডা দিতে। আমাদের দেখাদেখি আর একটা গ্রুপের ছয় সাতজন বললো তারাও ক্লাশ করবে না। তাই তারাও বাসায় চলে গেলো। ফলে তাদের দেখাদেখি আরো অনেকেই বাসায় চলে গেলো। আমাদের ক্লাশে সবমিলিয়ে ছাত্র ছিলো ষাটজন। ফলে ক্লাশ শুরুর পর দেখা গেলো ক্লাশে ছাত্র আছে মাত্র বিশজন। বাকি চল্লিশজনই হাওয়া। ক্লাশ টিচার ছিলেন ভয়ানক রাগী।তিনি ভয়ানক রেগে জানতে চাইলেন সাবাই কই গেছে, আর আমাদের ক্লাশের একজন জানালো যে আমি নাকি সবাইকে নিয়ে জোনাকী সিনেমা হলে জাহিদ হাসানের ‘জীবন সঙ্গী’ সিনেমা দেখতে গেছি।
ফলাফল হলো ভয়ানক। আমাদের স্কুলে ক্লাশ শুরুতে ঢুকার আগে লাইন দিয়ে কিছুক্ষন অপেক্ষা করতে হতো। আমি পরের দিন এসে লাইনে দাড়িয়ে আছি। কোথা থেকে এক জুনিয়ন এসে জিজ্ঞেস করলো ‘আপনি কি সিজার ভাই?’। আমি বললাম ‘হ্যা’। সে আরো নিশ্চিত হবার জন্য জিজ্ঞেস করলো ‘আপনি ক্লাশ টেনের রোল এক?’, আমি বললাম “হ্যা’। কোরবানীর গরুকে জবাই করার আগে তার দিকে সবাই যেমন করুনা নিয়ে তাকায় , সে আমার দিকে সেইরকম একটা চাহুনী দিয়ে বললো ‘হু হু, আজক আপনের খবর আছে, খালেক স্যার আপনাকে আজকে পিটিয়ে তক্তা বানিয়ে দিবে’ বলাই বাহুল্য খালেক স্যার হলেন আমাদের ক্লাশ টিচার এবং তিনি যখন পিটান তখন পিটিয়ে খুব উন্নত মানের তক্তাই বানান। আস্তে আস্তে আমাকে ঘিরে একটা ভীড় তৈরী হলো।যেন সবাই ফাঁসির আসামীকে দেখতে এসেছে। সবাই একই কথা বলছে, তা হলোআমাকে আজকে পিটিয়ে তক্তা বানানো হবে। একজন এসে বুদ্ধি দিলো মাইরের সময় তিরিং বিরিং লাফালে নাকি বেশী ব্যাথা লাগে না। ঠিক কিভাবে লাফাতে হবে তাও সে দেখিয়ে দিয়ে গেলো।
যথাসময় ক্লাশ শুরু হলো। স্যার রোল ডেকে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বাইরে চলে গেলেন। ফিরলেন তার বিখ্যাত তক্তা বাননোর বেতটা নিয়ে। আমাকে আর আমার আরো দুইজন বন্ধুকে লাইন দিয়ে দাঁড় করানো হলো। তারা দুইজন তিরিং বিরিং লাফানো পদ্ধতি কাজে লাগালেও আমি চুপচাপ দাড়িয়ে মার খেয়ে গেলাম। মাইরটা কেমন ছিলো আর না বলি, শুধু মনে আছে আমি একমাস বিছানায় পিঠ দিয়ে শুতে পারিনি । সবাই মনে হয় স্কুল লাইফে পালিয়ে সিনেমা দেখার কারনে শাস্তি পেয়েছে। কিন্তু সিনেমা না দেখেই আমরা শাস্তি পেলাম।
এরপর সিনেমা হলে গিয়ে অনেক মুভি দেখেছি। অবশ্যই মনে পরে ইউনিভার্সিটিতে থাকতে সবাই মিলে ‘মনের মাঝে তুমি’ দেখা। খুবই সস্তা মানের মুভি, কিন্তু তখন প্রেম বিরহের মাঝে ছিলাম। তাই কখনো নিজেকে মনে হয় রিয়াজ। যে তার মনের মানুষকে খুঁজে না পেয়ে বিরহের গান গেয়ে বেড়াচ্ছে। আর অবশ্যই মনে পরে প্রিয় মানুষটিকে নিয়ে দেখা অসংখ্য মুভির কথা মনে পড়ে। নাম বলে শেষ করা যাবে না। শেষ মনে হয় দেখেছি ‘স্পাইডার ম্যান 3D’ । এখন বেশিরভাগ মুভি ডাউনলোড করেই দেখা হয়। কিন্তু সিনেমা দেখতে হয় সিনেমা হলে গিয়ে। একসময় ইচ্ছে ছিলো সিনেমা বানাবো। স্বপ্নটা পথের পাঁচালী দেখেই শুরু। হয়তো একদিন বানাবো। স্বপ্ন কখনো মরে না।
--------------------------------------------------------------------------------
বি.দ্র. লেখা বড় হয়ে যাচ্ছে বলে শেষ করে দিলাম। প্রিয় সিনেমাগুলো নিয়ে আর একদিন লেখা যাবে।