
আজকাল আমার দৈনন্দিন রুটিন একটু পাল্টে গেছে। শুধু আমার কেন, সবারই কিছুটা পাল্টেছে। কারন বিশ্বকাপের রূদ্ধশ্বাস খেলা গুলো সবই প্রায় রাতে। কিছু সাড়ে আটটায়, কিছু রাত সাড়ে বারোটায়। শহর জুড়ে নানান দেশের পতাকা। দেশে বড় কোন সম্মেলন টম্মেলন হলে পথের ধারে নানান দেশের পতাকা টানানো হয়। কিন্তু এটা তা না। প্রায় প্রতিটা ছাদেই বিভিন্ন দেশের পতাকা উড়ছে। আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিলের পতাকা চিনে না এমন লোক মনে হয় বাংলাদেশে কেউ নেই। কয়েকদিন আগে ঢাকার বাইরে গিয়েছিলাম ঘুরতে, সেখানেও দেখি একই অবস্থা। নৌকার মাঝি, যার কিনা আয় খুবই কম, নুন আনতে পান্তা ফুরায়, তারও একটা দল আছে, ছোট্ট নৌকার উপর ব্রাজিল না হয় আর্জেন্টিনার পতাকা উড়ছে। ভালোই লাগে। নিজেদের হুজুগে জাতি মনে হয় না। মনে হয় এটাই তো স্বাভাবিক।
বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে পুরো দেশ মাতোয়ারা। মানুষ খেলা দেখে, আর আমি তাদের দেখি। কাকা,মেসি,রোনালদোরা আজ সবার অতি আপনজন। কে কত ভালো খেলোয়ার তাই নিয়ে তর্ক। হাজার মাইল দূরের আর্জন্টিনা নামের দেশের মানুষগুলকি জানে, কি অপার মমতা নিয়ে এদেশের আকাশ বাতাস আমরা আকাশী করে দিয়েছি তাদের পতাকার রঙে? কিংবা স্বাম্বা জাতি কি জানে সবুজে সবুজে ভরে গেছে এদেশের ছাদগুলো , তাদেরই পতাকায়। না জানলেই কি, তারপরও আমরা এই ভালোবাসা দেখিয়ে যাবো। ফুটবলের প্রতি ভালবাসায়।
আশির দশকে দেখতাম বাবা চাচাদের একদল আবাহনী তো আর একদল মোহামেডান। আবাহনী আর মোহামেডানের খেলা হলে কথাই নেই। তখন তো আর ঘরে ঘরে টেলিভিশন ছিলো না, তাই রাস্তার মোড়ে মোড়ে মানুষ জড়ো হতো রেডিওতে খেলার ধারাভাষ্য শোনার জন্য। পাড়ায় মহল্লায় মিছিল হতো তাদের দল জিতলে। এখন আর হয় না। অনেকেই বলে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তাই এর কারন। কিন্তু আমার মত সে দায়টা যতটা না ক্রিকেটের, তার চেয়ে অনেক বেশী ফুটবল কর্মকর্তাদের। তারা আজ ফিফার দেয়া টিকেটে বিশ্বকাপ দেখতে চলে যান দক্ষিণ আফ্রিকায়। টিভিতে, পেপারে বিশ্লেষণী সাক্ষাৎকার দেন কোন দল কেমন খেললো। সেসব দেখে মনে হয় এক একজন দুঙ্গা বা ম্যারাডোনার চেয়েও বেশী বুঝেন ফুটবলটাকে। এর চেয়ে একটু কম বুঝেও যদি তারা একটু মনোযোগী হতেন আমাদের ফুটবলের প্রতি, তাহলে কি আর আমাদের বিশ্বকাপ বাছাইয়ের বাছাই পর্ব থেকেই ফিরতে হয়?
কোনদিন ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনার খেলা থাকলে দেখা যায় এক পক্ষকে আর এক পক্ষ ক্ষেপাচ্ছে, টিটকারী দিচ্ছে। আমরা কি জাতি হিসেবেই একটু দলবাজ টাইপের? স্কুলে আবিরের একদল তো নোমানের আর একটা দল। মাঝে মাঝেই তাদের মাঝে এক হাত হয়ে যায়। অফিসে করিম সাহেবের দল আর হাফিজ সাহেবের দল থাকে, রাজনীতিতে একদল বিএনপি তো আর একদল আওয়ামী লীগ আর ফুটবলে তেমনি আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিল। বেশ কিছু বছর আগে যখন বাংলাদেশ তখনো বিশ্বকাপ ক্রিকেটে সুযোগ পায় নি, তখন দেখতাম একদল ভারত আর একদল পাকিস্তান। আজকাল আর তা দেখি না। এখন সবাই বাংলাদেশ। আশরাফুল একের পর এক ডাক মারলেও সবার মনের ভেতর একটাই পতাকা । বাংলাদেশ। ফুটবলে সে সুযোগ নেই। তাই আমরা একদল আর্জেন্টিনা হয়ে যাই আর একদল হয়ে যাই ব্রাজিল।
তাই পথের রিক্সাওয়ালাটিও যখন দশটাকা দিয়ে আর্জেন্টিনা বা ব্রাজিলের একটা ছোট্ট পতাকা কিনে তার রিক্সার হ্যান্ডেল উড়িয়ে বেড়ায় তখন খারাপ লাগে না। মনে হয় নিশ্চয় ক্রিকেটের মতো একদিন ফুটবলেও এমন হবে। কেউ আর্জেন্টিনার পতাকায় পথঘাট আকাশী নীলে ভরিয়ে দেবে না, আমাদের ছাদগুলো ব্রাজিলের পতাকার সবুজের সবুজ হবে না, সেখানে সবুজের সাথে লালও থাকবে আমাদের পতাকা হয়ে। বিশ্বকাপ ফুটবলের সেই আসরে আমরাও থাকবো। আমাদের অজান্তেই হাজার মাইল দূরের কোন দেশের ছাদগুলো লাল সবুজে ভরে উঠবে।