দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের মানুষ প্রতিদিন আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যের লস এঞ্জেলসে এসে জড়ো হয়। উদ্দেশ্য ভালো থাকো। সে উদ্দেশ্য নিশ্চিতভাবে পূরন হয় গ্রীনকার্ড পেলে। কিন্তু সোনার হরিণ গ্রীনকার্ড প্রত্যাশীদের খুব কম জনই জানে এর জন্য কতো মূল্য দিতে হয়। আবার এই সোনার হরিণের জন্য অনেকে রেপরোয়া হয়ে নানা কিছু ঘটিয়ে ফেলে। এইসব কিছু শুধুমাত্র অভিবাসী নয়, অভিবাসন সম্পর্কিত কর্মজীবিদের জন্য মানবিক পরীক্ষাও বটে। আমেরিকান মুভি ‘ক্রসিং ওভার’ সেই পরীক্ষার অন্দর মহল তুলে এনেছে। সেখানে বাংলাদেশী পরিবারও বাদ পড়ে নাই।
ক্রসিং ওভার বানিয়েছেন দক্ষিণ আফ্রিকান চিত্রনাট্য লেখক, প্রযোজক, পরিচালক ওয়েন ক্রমার। তিনি যেন আবিষ্কার করছেন আমেরিকান হয়ে উঠার স্বপ্ন এবং বাস্তব অবস্থার মধ্যে ফারাকগুলো কি কি। ২০০৯ সালে মুক্তি পেলেও, মুভিটি নির্মিত হয় আরো বছর দুয়েক আগে।এটা একই নামে ১৯৯৫ সালে ক্রমারের বানানো স্বল্পদৈর্ঘ্য মুভির পুনর্নির্মাণ।
এক মুভির মধ্যে অনেকগুলো কাহিনী। মুভির চরিত্রগুলো কাহিনীর শাখা-প্রশাখা দ্বারা যুক্ত। একই ধরণের গল্প পাওয়া যায় অস্কার জয়ী ক্রাশ (২০০৪) মুভিতেও। ক্রসিং ওভারে আছে অবৈধভাবে সীমান্ত পাড়ি দেয়া ও জাল কাগজপত্র নিয়ে বসবাসরত মানুষ, আছে নির্বাসিত এবং গ্রীণকার্ড প্রসেসিং হচ্ছে এমন মানুষ। ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষের ভিন্নতা এই মুভির একটি উপলক্ষ্য। ফলে বিভিন্ন দেশ থেকে আসা মানুষের বৈচিত্র্য আচারের দেখা মেলে এই মুভিতে। মুভিটিতে দেখানো অভিবাসীদের মধ্যে আছে মেক্সিকো, স্পেন,অষ্ট্রেলিয়া, ইরান, চীন, যুক্তরাজ্য এবং বাংলাদেশের মানুষ।
কাহিনীতে নানা চরিত্রগুলো জট পাকিয়ে থাকলেও একটি কাহিনী আরেকটিকে প্রভাবিত করে নাই। একমাত্র প্রভাবক হলো আমেরিকান জীবন-যাপনের (গ্রীনকার্ড তার প্রতীক) প্রতি দুনিয়ার তাবৎ মানুষের আকাঙ্খা। সেই আকাঙ্খাই এই মুভির মূল চরিত্র। সে আকাঙ্খা নানা সংস্কৃতিতে নানান আচরণ করছে। এবার মুভির চরিত্রগুলোর সাথে পরিচিত হওয়া যাক।এই পরিচয়ই এই মুভির মর্ম খোলাসা করবে।
বেআইনীভাবে লুকিয়ে কাজ করতে গিয়ে আটক হয় মেক্সিকান নারী মারিয়া সানচেজ। শাস্তি-হয় জেল নয় স্বদেশে ফেরত।আটক করে ইমিগ্রেশন এন্ড কাস্টম এনফোর্সমেন্ট(আইসিই)’র স্পেশাল এজেন্ট ম্যাক্স ব্রগান (হ্যারিসন ফোর্ড)। মারিয়া একটা ঠিকানা দিয়ে অনুরোধ করে তার ছেলেকে যেন মেক্সিকোয় নানা-নানী’র কাছে দিয়ে আসে। ম্যাক্স প্রথমে অস্বীকৃতি জানালেও পরে মারিয়ার ছেলেকে মেক্সিকোয় পৌছে দেয়। কিন্তু মারিয়ার খোজ মেলে না। এক সময় মারিয়ার লাশ পাওয়া যায় সীমান্তের কাছাকাছি।
তাসলিমা জাহাঙ্গীর (সামার বিশিল) তিন বছর বয়সে বাবা-মা’র সাথে আমেরিকায় আসে।এখন সে কিশোরী। স্কুলে ‘৯/১১’র বিমান ছিনকারীদের কেন বুঝা উচিত’ এই নিয়ে একটা পেপার পড়ে। এর সুত্র ধরে এফবিআই এজেন্টরা তার বাসায় হানা দেয়। জব্দ করে ডায়েরী এবং ‘আত্মহত্যার নৈতিকতা’ নামে স্কুল এসাইনমেন্ট। ইন্টারনেট ঘেটে তারা আরো দেখতে পায় তাসলিমা ইসলামিক ওয়েবসাইটের সদস্য ।এইসব দেখে মনে হয়,সে সম্ভাব্য আত্মঘাতী বোমা হামলাকারীদের একজন। তাসলিমা’র বাবা নাগরিকত্ব পাবার চেষ্টা করছেন। কিন্তু এই ঘটনা পুরো পরিবারকে ঝুকির মধ্যে ফেলে। সহানুভূতিশীল ইমিগ্রেশন ডিফেন্স এটোর্নি ডেনিস ফ্রাঙ্কেল (আশলে জুড) বলে, পুরো পরিবারকে আমেরিকা ছেড়ে যেতে হবে না।তাসলিমা এখানে জম্মায় নাই, তাকে বাংলাদেশে ফিরে যেতে হবে। তার ছোট ভাইবোন এদেশের নাগরিক,বাবা-মা’র যেকোন একজন তাদের অভিভাবক হিসেবে থাকতে পারবে। বাবা ও দুই ভাই-বোনকে আমেরিকায় রেখে তাসলিমা তার মায়ের সাথে বাংলাদেশে ফিরে যায়।
অবৈধ অভিবাসী আস্ট্রেলিয়ান তরুনী ক্ল্যারা সেপার্ড। অভিনেত্রী হবার আশায় আমেরিকা এসেছে। ইমিগ্রেশন অফিসার কোল ফ্রাঙ্কেল প্রস্তাব দেয় দুই মাস তার সাথে সেক্স করলে গ্রীনকার্ডের ব্যবস্থা করে দেবে।দুই মাস পর জানায় ডাকে গ্রীনকার্ড পৌছে যাবে। ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ টের পেলে ক্ল্যারাকে আস্ট্রেলিয়ায় ফিরে যেতে হয়। কোল ফ্রাঙ্কেল গ্রেফতার হয়। যেদিন ক্ল্যারা অস্ট্রেলিয়ায় যাচ্ছে একই দিন তাসলিমা তার মায়ের সাথে বাংলাদেশে ফিরছে। অন্যদিকে কোলের স্ত্রী যিনি তাসলিমার কেস নিয়ে কাজ করছিলেন,ডিটেনশন ক্যাম্পে থাকা নাইজেরিয়ান বালিকাকে দত্তক নেন।
স্পেশাল এজেন্ট ম্যাক্স ব্রগানের ইরানী সহকর্মী হামিদ বাহাহেরী। তার বোন জাভিয়ার পেদ্রোসা নামের স্পেনিজ বিবাহিত ব্যক্তির সাথে যৌন সম্পর্কে জড়ায়। হামিদের ছোট ভাই ব্যভিচারিনী বোনকে খুন করে। হামিদ প্রমান নষ্ট করতে সাহায্য করে। যাকে বলা হয় অনার কিলিং, যদিও ‘ন্যাশনাল ইরানিয়ান আমেরিকান কাউন্সিল’র অনুরোধে এই খুনকে সরাসরি অনার কিলিং বলা হয় নাই। এখানে পুলিশ চরিত্রে কাজ করেছিলেন বিখ্যাত অভিনেতা ‘শন পেন’।পরে শন পেন’র অভিনীত দৃশ্যগুলো বাদ দেয়া হয়। ব্রগান খুনের বিষয়টি বুঝতে পারেন। হামিদের ভাই গ্রেফতার হয়।আবার খুন হওয়া জাভিয়ার পেদ্রোসা জাল কাগজপত্র বানানোর সাথে জড়িত ছিলো। যার সেবা গ্রহিতার একজন ছিলো আস্ট্রেলিয়ায় ফিরে যাওয়া ক্ল্যারা।
এছাড়া আরো আছে দক্ষিন কোরিয়ান একটি পরিবার। সেই পরিবারের ছেলে কিম ভবিষ্যত নিয়ে হতাশাগ্রস্থ । এক সময় ডাকাতিতে জড়িয়ে পড়ে। এক ডাকাতিতে হামিদের হাতে ধরা পড়লেও তাকে ছেড়ে দেয়। কিম স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে।আরো আছে ইহুদী যুবক গবীন, ধর্মীয় স্কুলে পড়াতে চায়।সমস্যা থাকা সত্ত্বেও এক রাব্বির বদান্যতায় গ্রীন কার্ড অর্জন করে। এই যুবক একসময় ক্ল্যারার প্রেমিক ছিলো।গ্রীনকার্ড পাওয়ার পর নতুন একজন জুটিয়ে নেয়।
তাসলিমা জাহাঙ্গীরের মা রোকেয়া জাহাঙ্গীরের চরিত্রে অভিনয় করেছেন আমেরিকা প্রবাসী বাংলাদেশী অভিনেত্রী নায়লা আজাদ নূপুর। কথা সাহিত্যিক আলাউদ্দিন আল আজাদ’র কন্যা নূপুর সত্তর ও আশির দশকে ঢাকার মঞ্চ, টিভি এবং চলচ্চিত্রের আলোচিত অভিনেত্রী। তিনি নাট্যকার সেলিম আল দীন রচিত নাটক অবলম্বনে আবু সাইয়িদ পরিচালিত‘কীত্তনখোলা’ (২০০০) মুভিতে অভিনয় করেছিলেন। আমেরিকাতে তিনি আরো আরেকটি মুভি ও টেলিভিশন সিরিয়ালে অভিনয় করেছেন।
ব্রগান চরিত্রে হ্যারিসন ফোর্ড দারুণ অভিনয় করেছেন। তাকে ছাড়িয়ে গেছেন ডেনিস চরিত্রে আশলে জুড। সবাই টপকে গেছে তাসলিমা জাহাঙ্গীর চরিত্রে সামার বিশিল। মুভিটিতে অনেকগুলো কাহিনী থাকলেও দর্শকের ভিন্ন ভিন্ন কাহিনীগুলো বুঝতে সমস্যা হয় না। দৃশ্যান্তরও চমৎকার। বিশেষ করে জড়ানো প্যাচানো ফ্লাইওভার প্রতীক হিসেবে দারুন লাগে। আমেরিকান রাষ্ট্র যেন এইভাবে নানান পথের পথিক নিয়ে গঠিত হয়েছে।চিত্রগ্রহনে ছিলেন জেমস ওয়াইটাকার।তার লং শটগুলো অনবদ্য। সংগীত পরিচালনায় ছিলেন মার্ক ইসাম।ক্রমারের সাথে এই মুভির প্রযোজনায় আরো ছিলেন ফ্রাঙ্ক মার্শাল।
মুভিটিতে অনেকগুলো ঘটনা। কোনটি সাধারণ আবার কোনটি নাটকীয়। দেখা যাচ্ছে তাসলিমা জাহাঙ্গীরের সাধারণ কৌতুহলের ছোট্ট ঘটনাটি মারাত্বক পরিণতি টেনে আনে। একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেও সব কৌতুহল জায়েজ না। ৯/১১ আমেরিকার ইতিহাসে ভয়ানক ঘটনা। যার প্রভাব সারা পৃথিবীতে ছড়িয়েছে। এই মুভিতে দেখা যায় প্রতিক্রিয়া স্বরূপ ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের যে সন্দেহের চোখে দেখা হয়।তাসলিমা’র প্রতি তার সহপাঠীদের আচরণ ভালো দৃষ্টান্ত।আবার রাষ্ট্রের সম্ভাব্য অপরাধী খোজার প্রবণতা অনেক মানুষের ভবিষ্যতকে অন্ধকার করে দেয়। এটা ইসলাম ধর্মাবলম্বী অভিবাসীদের জন্য একটা মেসেজ।লক্ষ্যনীয় এখানে ইহুদী এবং মুসলমানকে আলাদাভাবে দেখানো হচ্ছে।এই দুটি ঘটনা আলাদা । কারণ, অপর ঘটনাগুলোর চরিত্রের দেশ পাল্টালেও ঘটার সম্ভাবনা রহিত হয় না।
এই মুভির চরিত্রগুলো অবৈধ অভিবাসী। তাদের সমস্যা কিভাবে আমেরিকার সমস্যা হয়ে উঠে তার নমুনা এই মুভি। অবৈধ অভিবাসীদের দৌড়-ঝাপ দেয়ানোর জন্য তার আছে বিশাল বাহিনী। এই কাজগুলো যারা করে তারা লাভ করে কষ্ট আর দ্বন্ধের অভিজ্ঞতা। যা দর্শকদেরও স্পর্শ করে। অবৈধ অভিবাসন ঠিক নয়- এমন সোজা কথা এখানে নাই।কারণ অবৈধ অভিবাসন একটা বাস্তবতা। আর অবৈধ হবার পরিণতি হলো বৈধ হবার সংগ্রাম। তার ফলাফলের কয়েকটা অনুমান আমরা এই মুভিতে দেখি।
মুভির শেষ দিকে অভিবাসীদের নিয়ে এক অনুষ্ঠানে দেখি গর্বিত আমেরিকানদের শপথ। এখানে মনে হয় দুনিয়ার নানা পথ আর মত এসে আমেরিকায় মিলছে।যেটা নিয়ে আমেরিকার গর্ব আছে। কিন্তু শেষপর্যন্ত কি মত আর পথ এক থাকে। এই সুনাগরিকের প্রনোদনা কি নিজেকে ছাপিয়ে যায় না? সেটা কিভাবে সম্ভব তা নিয়ে সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় মতাদর্শিক বাহাস উঠতে পারে। সন্দেহ নাই। তারপরও ‘ক্রসিং ওভার’র চোখকে আমরা অগ্রাহ্য করতে পারি না। এটা অবৈধ অভিবাসীদের নিয়ে নির্মিত দলিল হয়ে উঠেছে।
>লেখাটি প্রবাসী পত্র -এ প্রকাশিত
আলোচিত ব্লগ
কমলার জয়ের ক্ষীণ ১টা আলোক রেখা দেখা যাচ্ছে।
এই সপ্তাহের শুরুর দিকের জরীপে ৭টি স্যুইংষ্টেইটের ৫টাই ট্রাম্পের দিকে চলে গেছে; এখনো ট্রাম্পের দিকেই আছে; হিসেব মতো ট্রাম্প জয়ী হওয়ার কথা ছিলো। আজকে একটু পরিবর্তণ দেখা... ...বাকিটুকু পড়ুন
বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?
সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী
বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন
জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন
=বেলা যে যায় চলে=
রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।
সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন