ব্লগে বর্তমানে বিজ্ঞাপন নিয়ে একটা অসন্তোষ দেখা যাচ্ছে। একজন ব্লগার ব্লগের একটি বিজ্ঞাপন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, তার মতো অনেকেই জানিয়েছেন এই বিজ্ঞাপন বিষয়ক জটিলতার কথা। কেউ কেউ ব্লগের দোষ দিচ্ছেন কেউ আবার ব্লগারদের দোষ দিচ্ছেন। কয়েকজনকে দেখলাম বলছেন যে কোন ব্লগার যা পছন্দ করেন, যেসব সাইট ভিজিট করেন তিনি সে রকম বিজ্ঞাপনই দেখেন। ঐ বিজ্ঞাপনটির চেয়ে এই কথাটাই সম্ভবত অনেক ব্লগারদের মনে বেশি কষ্ট দিয়েছে।
প্রথমেই আমি এই প্রশ্নটির উত্তর দিয়ে নেই, এই বিজ্ঞাপনের সাথে কোন ব্লগারের রুচি বা ইন্টারনেট এ্যাক্টিভিটির কোন সম্পর্ক নেই।
কেন দেখি?
--------------------------------
তাহলে প্রশ্ন আসে তাহলে এই বিজ্ঞাপন কেন দেখি?
উত্তর হচ্ছে, এই বিজ্ঞাপন যিনি দিয়েছেন সেই বিজ্ঞাপনদাতা কোন টার্গেট সেট করেন নি। এই বিজ্ঞাপন যাকে খুশি দেখাক, তার সমস্যা নেই। (বিস্তারিত পরে লিখেছি)
দায়ী কে?
--------------------------------
আরেকটা প্রশ্ন এসে যায়, সামু ব্লগে এমন অপ্রাসঙ্গিক বিজ্ঞাপন প্রকাশে দায়ী কে? ব্লগার গন? সামু ব্লগ? নাকি গুগল?
উত্তর হচ্ছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি ও ইন্টারনেট ব্যবহারকারীগন (বিস্তারিত নিচে লিখেছি)
কিভাবে কাজ করে?
--------------------------------
আরো একটি প্রশ্ন তাহলে চলে আসে, এই বিজ্ঞাপন কিভাবে কাজ করে?
এই বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এই বিষয়টি বুঝলে বাকি সব পরিস্কার হয়ে যাবে।
কিছু বিষয় আগে বুঝতে হবেঃ
♦ কোন প্রোডাক্ট বা সার্ভিসের বিজ্ঞাপন দেয় ঐ প্রোডাক্ট/সার্ভিস প্রদানকারী কোম্পানি। যেমনঃ ইউনিলিভার, মেরিল পেট্রোলিয়াম জেলী, নোমস কিংবা আলোচিত বিজ্ঞাপনের অনলাইন গেম কোম্পানি।
♦ মোবাইল অ্যাপ/গেমস, সামু ব্লগ বা কোন ওয়েবসাইট, ইউটিউব চ্যানেল, ফেসবুক ভিডিও এগুলো হচ্ছে এ্যাড পাবলিশার। অর্থাৎ যেখানে বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়।
♦ বিজ্ঞাপনদাতা থেকে কোন বিজ্ঞাপন গ্রহন করা এবং প্রকাশ করার দায়িত্ব পালন করে এ্যাড-নেটওয়ার্ক কোম্পানি সমূহ। বর্তমানে বহুল পরিচিত কিছু এ্যাড নেটওয়ার্ক কোম্পানি হচ্ছেঃ ফেসবুক অ্যাড, গুগল অ্যাড (এ্যাডসেন্স), মাইক্রোসফট অ্যাডভারটাইজিং, ডাবলক্লিক (এটাও গুগলের), বাইডু অ্যাড, চিটিকা ইত্যাদি। সামু ব্লগ গুগল এ্যাডসেন্স এবং ডাবলক্লিক এ্যাড নেটওয়ার্কের পাবলিশার।
♦ আমরা যারা বিজ্ঞাপন দেখি, আমরা হচ্ছি বিজ্ঞাপন দর্শক বা পটেনশিয়াল কাস্টমার।
নিচের চিত্র দেখলে ব্যাপারটা পরিস্কার হবে।
এখানে সামু ব্লগের কোন ভূমিকা নেই। কি বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হবে সেটি গুগল অ্যাড/ডাবলক্লিক ঠিক করে। সামু ব্লগ এই ক্ষেত্রে গুগল অ্যাডকে এই ওয়েবসাইটে বিজ্ঞাপন প্রকাশের অধিকার দিয়েছে।
বিষয়টি তুলনা করতে পারি বিলবোর্ড এর মাধ্যমে। আমাদের দেশে সড়ক-মহাসড়কের পাশের দালানের ছাদ/জমিতে বিলবোর্ড তৈরী করে ভাড়া দেয়া হয়। বিলবোর্ডের মালিক বিজ্ঞাপনী সংস্থাকে ভাড়া দেন, এবং বিজ্ঞাপনী সংস্থা বিজ্ঞাপন প্রদর্শন করেন। এক্ষেত্রে কি বিজ্ঞাপন দেয়া হবে এর উপর বিলবোর্ড মালিকের কোন দায় থাকে না।
ছবিঃ বিলবোর্ড
এবার আগের প্রশ্নটির উত্তর খোজার পালা। এমন অপ্রাসঙ্গিক বিজ্ঞাপন প্রকাশে দায়ী কে?
শুনতে অবাক লাগলেও সত্য, এমন বিজ্ঞাপন প্রকাশের জন্য দায়ী করতে হবে আমাদের দেশের অর্থনীতি ও ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদেরকে।
আমাদের দেশের ই-কমার্স ও ই-সার্ভিস এর খাত খুবই সংকীর্ণ। ই-কমার্স যাও একটু এগিয়েছিলো, বাটপার ভ্যালী এবং চিটার মার্ট দের কারনে ইকমার্স একদম মুখ থুবড়ে পরেছে। এখন সাধারন জনতার আর ইকমার্স এর উপর কোন ভরসা নাই। তারা ইন্টারনেটে কেনাকাটা করেন না।
এছাড়া আমাদের দেশের সিংহভাগ মানুষ ইন্টারনেট বলতে শুধু ফেসবুক, ইউটিউব, পাবজি, ফ্রি-ফায়ার, তিন পাত্তি, লুডু এসব বোঝেন।
তাহলে বোঝা যাচ্ছে এই দেশের মানুষ ইন্টারনেটে কেনাকাটা করে না এবং তারা শুধু সোস্যাল মিডিয়া এবং গেমস (জুয়া হলেও এটা মোবাইল গেম) নিয়েই ব্যস্ত। এ্যাড নেটওয়ার্কগুলো তাহলে এই দেশের মানুষদের কিসের বিজ্ঞাপন দেখাবে? গেমস এবং জুয়ার সাইটগুলোর বিজ্ঞাপনই তো দেখাবে, তাই না?
এবং এই গেমস সাইটগুলোর ভিজিটর/প্লেয়ারদের বেশিরভাগ টিনএজার ও পুরুষ হওয়ায় বিজ্ঞাপনও এমন যৌন-আবেদনময় ভাবে তৈরী করা হয়। তবে যেহেতু খোলামেলা নগ্নতা ও যৌনতা নেই, তাই এই বিজ্ঞাপন প্রকাশে আইনি বাধাও নেই।
প্রথম প্রশ্নের উত্তরে আবার ফিরে যাই, সামুতে আমরা এমন অপ্রাসাঙ্গিক বিজ্ঞাপন কেন দেখি?
অনেকেই বলেন এইসব বিজ্ঞাপন ইউজারের ইন্টারনেট হিস্টোরি ও রুচির কারনে দেখায়। এই কথাটি আংশিক সত্য। আপনার মোবাইলে সংযুক্ত ইমেইল একাউন্ট (এ্যান্ড্রয়েড ফোনর ক্ষেত্রে জিমেইল) এর মাধ্যমে আপনার সকল ব্রাউজিং, এ্যাক্টিভিটি, পছন্দ অপছন্দ যাচাই বাছাই করে আপনার একটা এ্যাড প্রোফাইল তৈরী করা হয়। আপনি কোন জিনিষ পছন্দ করেন, ইন্টারনেটে কি খোজেন এগুলোর উপর ভিত্তি করে বিজ্ঞাপন দেখানোর উদ্দেশ্যে এটা করা হয়। আবার বিভিন্ন ওয়েবসাইটে গুগল ও ফেসবুকের কিছু সার্ভিস (ফেসবুক লাইক বাটন, কমেন্ট, শেয়ার বাটন, এ্যানালাইটিক্স ইত্যাদি) ব্যবহার করায় সেই সাইটেও গুগল ও ফেসবুক আপনাকে ট্রাক করে।
মনে করেন আপনি হঠাৎ মনে করলেন একিটি প্রাইভেট জেট প্লেন কিনবেন, আপনি বিভিন্ন ওয়েবসাইট ঘুরে ঘুরে জেট প্লেন এর সুবিধা, মডেল, দাম, ভাড়া দেখলেন। এরপর ফেসবুক ওপেন করলেই দেখবেন আপনার ফেসবুকে জেট প্লেন ভাড়া/বিক্রির বিজ্ঞাপন দেখাচ্ছে। এর কারন হলো আপনি যে ওয়েবসাইট গুলো ভিজিট করেছেন, ফেসবুক সেখানে আপনাকে দেখে বুঝে গেছে আপনি জেট প্লেন সম্পর্কে আগ্রহী। তাই এই বিজ্ঞাপন দেখিয়েছে। (আমার নিজের পরীক্ষা করা)
বিজ্ঞাপন দেখানো হয় দুই ভাবে, একটা পটেনশিয়াল কাষ্টমারদের টার্গেট করে আরেকটা পণ্যের প্রচার বাড়াতে সকল শ্রেনীকে টার্গেট করে।
টার্গেটেট বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে কোম্পানিগুলো চায় পটেনশিয়াল কাস্টমারদের কাছে পণ্যের প্রচার করতে। একারনেই ললিপপ বা চকোলেট মাফিন এর বিজ্ঞাপন বাচ্চাদের অনুষ্ঠানে, রান্নার মশলা, কসমেটিক্স, স্যানিটারি ন্যাপকিন এর বিজ্ঞাপন সন্ধ্যারাতের (এই সময়ে মহিলা দর্শক বেশি থাকে) নাটকের ফাকে দেখানো হয়। এই কারনে গার্লস কলেজ এর পাশের বিলবোর্ডে নারী প্রসাধনীর বিজ্ঞাপন, বাসস্ট্যান্ডের বিলবোর্ডে গাড়ির যন্ত্রাংশের বিজ্ঞাপন বেশি দেখা যায়।
আবার সিমেন্ট, মোবাইল ফোন, কলরেট এর বিজ্ঞাপন সার্বজনীন। প্রায় সবখানেই দেখা যায়। তারা পণ্যের প্রচার করতেই বিজ্ঞাপন দেয়, সেল বাড়াতে না।
সামু ব্লগে এমন উল্টা পাল্টা বিজ্ঞাপন কেন আসে?
---------------------------------------------------------
সামু ব্লগের কন্টেন্ট বাংলা ভাষায় এবং বহুমুখী। কোন একটা নির্দিষ্ট বিষয়ে এখানে লেখা হয় না। যার যে বিষয়ে খুশি লিখতে পারে। এই কারনে গুগল এই ব্লগে টার্গেটেড বিজ্ঞাপন দেখাতে পারে না। তাছাড়া আগেই বলেছি আমাদের দেশের মানুষ অনলাইনে কেনাকাটা করে না, আর তাই দেশি প্রোডাক্ট এর বিজ্ঞাপনও কম। তারপরেও আমরা অনলাইনে যা বিজ্ঞাপন দেখি সেগুলো পন্যের প্রচারের জন্য, সেল বাড়াতে টার্গেটেড বিজ্ঞাপন না। তাই গুগলের ভান্ডারে আমাদের জন্য প্রাসঙ্গিক বিজ্ঞাপন কম থাকায় এমন অপ্রাসাঙ্গিক বিজ্ঞাপনগুলোই আমাদের দেখানো হয়। এদেশের মানুষ অনলাইন জুয়া ও গেমস বেশি খেলে, তাই এই দেশে অনলাইন গেমস ও বেটিং রিলেটেড বিজ্ঞাপন বেশি।
আমাদের দেশ থেকে ইন্টারনেট ব্যবহার করলে এইসব বিজ্ঞাপনই চোখে পড়বে।
সামু ব্লগের এই বিজ্ঞাপন টির সাথে কোন ব্লগারের রুচি বা ইন্টারনেট এ্যাক্টিভিটির কোন সম্পর্ক নেই।
এই সকল এ্যাড নেটওয়ার্ক আমার আইপি এ্যাড্রেস দিয়েই বিচার করে আমি কোন দেশ থেকে ইন্টারনেট ব্যবহার করি। সেই অনুযায়ি বিজ্ঞাপন দেখায়। এই কারনে আমি ভিপিএন এর মাধ্যমে ভিন্ন ভিন্ন দেশের আইপি দিয়ে সামু ভিজিট করেছি।
বাংলাদেশের আইপি
--------------------------
১) প্রথম পাতা (বাংলাদেশি কোম্পানির বিজ্ঞাপন, পন্যের প্রচারের লক্ষ্যে বিজ্ঞাপন)
২) মনিরা সুলতানার ব্লগ (একটি বাংলাদেশী ও একটি অপ্রাসাঙ্গিক গেমস সাইটের বিজ্ঞাপন)
৩) সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই এর ব্লগ পাতা (অপ্রাসাঙ্গিক বিজ্ঞাপন)
হংকং এর আইপি
------------------------
১) প্রথম পাতা (হংকং এর মানুষদের টার্গেট করে দেয়া বিজ্ঞাপন)
২) মরুভূমির জলদস্যু ব্লগ পাতা (হংকং/চায়না বেজড বিজ্ঞাপন)
কানাডার আইপি
--------------------------
১) প্রথম পাতা (কানাডিয়ান প্রোডাক্ট এর বিজ্ঞাপন)
২) সেডরিক এর ব্লগ (কানাডিয়ান ইকমার্স এর বিজ্ঞাপন)
যুক্তরাস্ট্রের এর আইপি
------------------------
১) প্রথম পাতা (ইউএস বেজড বাইক রেন্টাল সার্ভিস এর বিজ্ঞাপন)
২) মোস্তফা কামাল পলাশ এর ব্লগ (প্রোজেক্ট ম্যানেজমেন্ট সার্টিফাইড কোর্স এর বিজ্ঞাপন)
তুরস্কের আইপি
------------------------
১) প্রথম পাতা (এভিয়েশন ও গেমস সাইট এর বিজ্ঞাপন)
২) গুলশান কিবরীয়া এর পোস্টের কমেন্ট (তন্ত্র-মন্ত্র ঝাড়-ফুক দেয়া শামান (ওঝা) এর বিজ্ঞাপন)
সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, উক্ত বিজ্ঞাপন জিওটার্গেট অডিয়েন্স এর জন্য দেখানো হয়, কোন একক ব্লগার বা সামু ব্লগের কারনে নয়। অতএব আমরা অযথা কাউকে দোষারোপ না করি।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জানুয়ারি, ২০২২ রাত ১১:৪৩