আমেরিকার এক গ্রামে এক বুড়ো কৃষক দম্পতি ছিলো, পশু পালন ও কৃষিকাজ করতো। তাদের দুটি গাধা ছিলো। একটি বুড়ো গাধা আরেকটি অল্প বয়সী গাধা। অল্প বয়সী গাধাটিকে দিয়ে ভার বহন, মালামাল আনা নেয়ার কাজ চলে যেত বিধায় বুড়ো গাধাটি একদমই কাজ করতো না। তাকে মেরে-বকেও কাজ করানো যেতো না। গাধা সাধারনত বোকা ও কর্মঠ প্রানী হলেও ভীষন একগুয়ে ও ঘাড়তেড়া প্রকৃতির প্রানী। [১]
বুড়ো গাধাটি সারাদিন মাঠে ঘাটে ঘুরে বেড়াতো, আশে পাশের খামারের গরু-গাধা-ভেড়াগুলোকে খামোখা উপদেশ দিয়ে বেড়াতো। কেউ তার উপদেশ গুরুত্ব দিয়ে না শুনলেও, তাকে এক পয়সার পাত্তা না দিলেও, গাধাটা নিজেকে ভয়াবহ রকম জ্ঞানী ও ইতিহাসের মহান সৃষ্টি বলে মনে করতো। এই গাধাটি এলাকার খেলার মাঠে বসে বসে বাচ্চাদের খেলা দেখতো, এবং খামাখা কোন কারন ছাড়া বাচ্চাদের বিরক্ত করতো।
এর ভেতর একটা কুকুরের সাথে গাধাটির পরিচয় হয়, কুকুরটি এই খামার ওই খামার থেকে এটা সেটা খাবার চুরি করতো এবং সারাদিন চুরি করা খাবার দেখিয়ে দেখিয়ে নিজে রান্না করেছে বলে প্রচার করতো। যদিও সবাই জানতো কুকুরটি মহা চোর, অনেকে হাতে নাতে প্রমানও করে দিয়েছিলো চুরির ব্যাপারটা। কিন্তু কথায় আছে চোরে না শুনে ধর্মের কাহিনী।
এই কুকুরটি আর গাধাটির ভেতর ভীষন সখ্যতা গড়ে উঠে। গাধাটি খেলার মাঠে "ঢ্যাচুউউ ... ঢ্যাচুউউউ...." বলে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতো এবং কুকুরটি গাধার হাতে পায়ে তেল ঘষতে ঘষতে প্রশংসা করতো, "বস.. কি গানটা গাইলেন না আজকে! একদম মান্না দে ফেল! আপনার দরদমাখা সুরে গাওয়া দেখেই আমার চোখে পানি চলে আসছে" অথবা, "গুরুজি, এতো ভালো কিভাবে গান আপনে? এই গান শুনলে সুবীর নন্দী আপনাকে ষাষ্টাঙ্গে পেন্নাম করবে গড প্রমিজ।"
কুকুর আর গাধার এই বিরক্তিকর কর্মকান্ডে মাঠের বাচ্চারা বিরক্ত হয়ে তাদের বকে-ধমকে যতই দূরে সরিয়ে দিতো, ততই গাধা আর কুকুর মাঠে বারবার ফিরে আসতো। ধীরে ধীরে গাধার দলে কুকুর ছাড়াও একটা ভেড়া, একটা পাঠা ও একটা মুরগি যোগ হয়। গাধা দলবদ্ধ থাকতে ভালোবাসে, সে গাধা ছাড়াও নানা রকম প্রানীর সাথে দলবেধে থাকতে পারে [২]
এই পাঠা, ভেড়া, মুরগি ও কুকুর গাধার বেসুরে "ঢ্যাচুউউ ... ঢ্যাচুউউউ...." শুনে আনন্দে লাফাতে লাফাতে হাত তালি দিতো, প্রশংসায় ভাসিয়ে দিতো, বিনিময়ে গাধাও এই কুকুরকে, মুরগিকে পিঠে বসিয়ে মাঠে ঘুরে বেড়াতো।
গাধা মুরগিকে এভাবে পিঠে চড়িয়ে ঘুড়ে বেড়ায়
গাধার পিঠে চড়ে কুকুর নিজেকে ভাগ্যবান মনে করে
এদিকে কাজকর্ম না করে গাধা এইভাবে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়ালেও মালিক দম্পতি গাধাটাকে কিছু বলতো না, কারন পিটালেও এই গাধার লজ্জা হয়না। কয়েকবার পায়ে শিকল পড়িয়ে রাখা হয়েছে, মুখে গোমাই[৩] ঠুসে রাখা হয়েছে, যাতে চেচামেচি করতে না পারে। কিন্তু আগেই বলেছি, বুড়ো গাধাটি ভীষন একগুয়ে, বেয়াড়া ও বেহায়া। কোন কিছুতেই শিক্ষা হয় না। পরে গাধার মালিক কৃষক দম্পতি হালই ছেড়ে দিয়েছে।
আজও গাধা তার দলবল নিয়ে আবার খেলার মাঠে এসে বাচ্চাদের একে ওকে খোচা দিচ্ছে, চেচিয়ে মাথা ধরাচ্ছে, আগ বাড়িয়ে বিরক্ত করছে ও জ্ঞান দিচ্ছে। এদিকে কুকুরটি আবার গাধাকে প্রশংসা করতে করতে আজ মুখে ফেনা তুলে ফেলছে। সে গান জুড়ে দিলো, "আমি এই এলাকার সেরা রাঁধুনী। আমার উস্তাদ এই পৃথিবীর সর্বকালের সেরা গায়ক। আসো আমাদের পেন্নাম করো।"
এই গান শুনে খেলার মাঠের ছেলেগুলো হাসতে হাসতে লুটোপুটি খেয়ে বললো, "গাঁজা কয় পোটলা টানছো বাপধন?"
পাঠা ও মুরগি এবার গুরুদেব এর এই অপমান সহ্য করতে পারলো না। কচি পাঠাটি মোড়ে দাড়িয়ে মাইকে ঘোষনা দিলো, "সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট গায়ক কে? আসেন ভোট দেন"
স্বভাবতই এই কচি পাঠাকে কেউ কখনো গুরুত্ব দেয় না, তার ছাগলামি দেখে সবাই দূরে বসে হাসি তামাশা করছে, মাঝে মাঝে দুয়েকজন এসে মজাচ্ছলে ভোট(?) দিয়ে যাচ্ছে। ওদিকে মুরগি আবার তার বন্ধু-বান্ধব নিয়ে দল বেধে গাধা ও কুকুরকে ভোট দিয়ে গেলো।
একদিন পর কচি পাঠা ঘোষনা দিলো, আমাদের গুরু গাধা-স্যার স্বরনকালের সর্বশ্রেষ্ঠ গায়ক। আমাদের কুকুর ভাইয়া টুকটাক চুরি -চামারি করলেও, সে একজন গুনী ও সেরা রাধুনী। আর গাধা এই প্রশংসা শুনে আহ্লাদে গদ গদ হয়ে ম্যাড ইন বাংলাদেশ সিনেমার শহীদুল আলম সাচ্চুর মতো ডায়ালগ দিতে থাকলো, "হ্যা আমিই... আমিই.... আমিই সেই লোক... যার এতো গুরুত্ব.. আমিই সেই লোক"
এবার খেলার মাঠের ছেলেগুলো বিরক্ত হয়ে গেলো, অনেক সহ্য করা গেছে। আর কতো? গাধাকে ধরে পাছায় দমাদম লাথি মেরে ভাগিয়ে দিলো। গাধা এবারও ঘাড়তেড়ামি করে শুয়ে পড়লো, "যাবো না আমি, আমি কিন্তু সেই লোক, যার এতো গুরুত্ব! আমিই সেই লোক। আমি যাবো না এখান থেকে।"
একটা ছেলে ভয় দেখালো, "তুমি চুপচাপ চলে যাও তো গাদ্ধু, নাহলে ধরে ঐ কূপে ফেলে দিবো কিন্তু।"
গাধার একগুয়েমি আরো বেরে গেলো, "যাবো না.. যাবো না.... যাবো না আমি, আমি কিন্তু সেই লোক, যার এতো গুরুত্ব! আমিই সেই লোক। আমি যাবো না এখান থেকে।"
এবার ছেলেগুলো মাঠের পাশে থেকে পঁচা গাজা পাতা [৪] এনে গাধার উপর ছিটিয়ে দিলো। গাধা চোখ বুজে থাকায় মনে করলো তাকে বুঝি কবর দেয়া হচ্ছে। সে চুপি চুপি গাজা খাওয়া শুরু করলো। গাজা খেয়ে গাধা হাই হয়ে নেশাগ্রস্থ হয়ে গেলো। তার মনে হলো সে ধীরে ধীরে উপরে উপরে বহু উপরে উঠে যাচ্ছে।
সন্ধ্যা হয়ে গেলে গাধাকে রেখে বাচ্চারা সবাই যে যার বাড়িতে ফিরে গেলো। গাধা নেশাগ্রস্থ হয়ে টলতে টলতে নিজের আস্তাবলে ফিরে গেলো। এবং চিৎকার করে বলতে লাগলো, "ডায়নোসর চলে গেছে, ম্যামথ চলে গেছে, গাধা আজও বীরদর্পে টিকে আছে।"
চেচামেচি শুনে মালিক উকি দিয়ে গাধাকে একবার দেখে আবার ফিরে গেলো। কি করবে, বুড়া গাধা, মারলেও শিক্ষা হয় না। থাক সে তার মতো।
---------------------------
বিদ্রঃ আমি পশুপ্রেমী, তাই বছর শেষ হবার আগে একটা পশু বিষয়ক গল্প লিখলাম। কেমন হয়েছে কমেন্টে জানাবেন।
টীকাঃ
---------
♦ [১] [২] এর তথ্যসূত্রঃ হ্যাবিটাট ফর হর্সেস
♦ [৩] গরু বা মহিষের মুখে বাঁশের তৈরী একটা খাচা পরানো হয়, যাতে এখানে-ওখানে মুখ দিতে না পারে। এটি টোনা, টোপা, ঠুসি বা গোমাই নামে পরিচিত
♦ গল্পের সাথে মিলিয়ে ছবি খুজছিলাম, কিছু প্রাসাঙ্গিক ছবি পেয়ে যুক্ত করে দিলাম। প্রথম ও তৃত্বীয় ছবির ক্রেডিট ফটোগ্রাফার ডেভিড কেয়ার্ড এর। এগুলো ২০১৩ সালে বিবিসিতে প্রকাশিত।
♦ [৪] অনেক খামারে শূকরের খাবার হিসেবে গাজা ব্যবহৃত হয়
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে ডিসেম্বর, ২০২১ রাত ১১:১৬