আমি যদি আপনাকে জিজ্ঞেস করি, বাংলাদেশের ক্রিকেটে সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যাক্তিটি কে? আপনার উত্তরটা কি হবে?
আমি জানি কেউ নাজমুল হাসান পাপন এর কথা বলবেন, কেউ খালেদ মাহমুদ সুজনের কথাও বলবেন। কেউবা মাশরাফির নামটাও বলবেন। দূর্জয়, জালাল ইউনুস বা ববি সাহেবদের নামও বলতে পারেন।
যদি সত্যটা জানতে চান, তাহলে বলি। বাংলাদেশের ক্রিকেটে সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি মাঙ্গামুনি গামিনি ডি সিলভা। মিরপুর শেরে বাংলা স্টেডিয়াম এর কিউরেটর তিনি।
পরিচয়ঃ শ্রীলংকান ক্রিকেটার, প্রথম শ্রেনীর ক্রিকেট খেলেছেন, আম্পায়ার হিসেবে ৬৬ টা আন্তর্জাতিক ম্যাচ পরিচালনা করেছেন। তারপর ১৩ বছর ধরে মিরপুর শেরে বাংলা স্টেডিয়ামের প্রধান কিউরেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
বাংলাদেশের জন্য তার অবদানঃ
১) মিরপুর স্টেডিয়ামের আউটফিল্ডের মান ধ্বংস করে দেয়া।
খুবই নিম্নমানের আউটফিল্ড ও পিচ তৈরী করায় মিরপুর শেরে বাংলা স্টেডিয়ামকে একবছরের ব্যবধানে তিনটি ডিমেরিট পয়েন্ট পাইয়ে দেয়া। (পাচ বছরে ৫ টি ডিমেরিট পয়েন্ট হলে ভেন্যু ১ বছরের জন্য নিষিদ্ধ হয়ে যায়)
২) বিপিএল টি২০ এর মান নষ্ট করে দেয়া।
টি২০ টুর্নামেন্ট মানেই চার-ছক্কার ফুলঝুড়ি। বলে বলে বাউন্ডারি। তাই বিসিবি থেকে ব্যাটিং সহায়ক উইকেট করতে নির্দেশ দেয়া হলেও গামিনি সাহেব বারবার বোলিং সহায়ক উইকেট তৈরী করেন। ফলে চার ছক্কার উত্তেজনা পূর্ন ম্যাচের পরিবর্তে লো-স্কোরিং নিরস ম্যাচ দেখতে হয়।
৩) মাঠের ঘাসের রং পরিবর্তন
অযত্নে অবহেলায় মিরপুরের সবুজ ঘাসের সুন্দর স্টেডিয়ামকে ধূসর ম্লান ঘাসের শ্বশান বানিয়ে ছেড়েছেন।
৪) তথ্য পাচার করে বাংলাদেশের ম্যাচকে চ্যালেঞ্জিং বানানো
২০১৮ সালে ত্রিদেশীয় টূর্ণামেন্টের ফাইনালে বাংলাদেশ-শ্রীলংকা ম্যাচের আগের দিন শ্রীলংকার কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহের সাথে গোপনে দেড় ঘন্টার বৈঠক করেন গামিনি। বাংলাদেশ থেকে যেমন পিচ চাওয়া হয়েছিলো, তার ঠিক উল্টোটা তৈরী করেছিলেন। স্পস্টভাবে নিষেধ করা সত্বেও ম্যাচের আগের দিন পিচে পানি ঢেলেছিলেন। ফলে ফাইনালে পিচ খুবই অস্বাভাবিক আচরন করে, স্বাগতিক হিসেবে বাংলাদেশ পিচের আচরন বুঝতেই পারছিলো না, হোম কন্ডিশনের কোন সুযোগই নিতে পারেনি। কিন্তু শ্রীলংকা ফাইনালে পিচের সর্বোচ্চ সুবিধা তুলে নেয়। পিচের আচরন কেমন হবে, কেমন বল আসবে, টসে জিতলে কি নেয়া উচিৎ, একাদশ কিভাবে সাজানো উচিৎ সব তাদের আগে থেকেই যেন জানা ছিলো। এই টুর্নামেন্টে শ্রীলংকা বাংলাদেশকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়।
৫) অস্ট্রেলিয়ার অনুরোধে বুড়ো আঙুল দেখানো
বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতির কারনে অস্ট্রেলিয়া বাংলাদেশে পাচ ম্যাচের টি২০ সিরিজ খেলতে আসার জন্য কিছু শর্ত দিয়ে দেয়। যেমন সকল ম্যাচ অফিসিয়াল, স্টাফ, খেলোয়ারদের ১০ দিনের কোয়ারেন্টিন করতে হবে, বায়ো-বাবলে থাকতে হবে। যারা কোয়ারেন্টিনে থাকবে না, তারা যেন মাঠে প্রবেশ না করে।
এই শর্ত জেনেও তিনি সিরিজের ঠিক ১৪ দিন আগে নিজ দেশ শ্রীলংকায় ছুটি কাটাতে চলে যান। এবং সিরিজের কয়েকদিন আগে ফিরে বিসিবির নির্দেশকে pha-que বলে নিজের ইচ্ছামতো মাঠে ঢুকেন, মাঠ পরিদর্শন করেন।
প্রভাব ও ক্ষমতাঃ গামিনি ডি সিলভাকে কেন আমি বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি বলেছি তা বলছি এবার।
১) কখনো শাস্তির সম্মুখিন না হওয়া
বারবার নানা অভিযোগ আসলেও বিসিবি কখনো তার বিরুদ্ধে কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়নি। শুধু শোকজ নোটিশ পাঠিয়ে দায় সেরেছে।
২) বারবার চুক্তি নবায়ন
খারাপ মানের উইকেট ও আউটফিল্ড বানানোতে শেরে বাংলা স্টেডিয়ামের ভাগ্যে আইসিসি থেকে তিনটি ডিমেরিট পয়েন্ট জুটলেও তাকে কোন শাস্তি/জবাবদিহির মুখে ফেলা হয়নি। খারাপ কাজ করেও বারবার তার চুক্তি নবায়ন করা হয়েছে।
গামিনি ডি সিলভা ১৩ বছর ধরে এই পদে আসীন আছেন
৩) সমালোচনা করলে শাস্তি
২০১৭ বিপিএলে নিম্নমানের পিচ বানানোতে রংপুর ও কুমিল্লার ম্যাচ শেষে দুই দলের অধিনায়ক তামিম ও মাশরাফি মাঠের সমালোচনা করেন। তামিম বিজয়ী দল কুমিল্লার ক্যাপ্টেন ছিলো, কিন্তু মাঠের এই বাজে মান নিয়ে চুপ থাকতে পারেনি। তামিম মাঠের কোয়ালিটিকে জঘন্য বলে এবং সাথে গামিনি ডি সিলভার সমালোচনা করে। ফলে তামিমকে বিচারের আওতায় আনা হয়, শুনানিতে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করা হয় এবং ৫ লক্ষ টাকা জরিমানা করা হয়। যদিও গামিনিকে শুনানিতে ডাকা হয় নি।
৪) সুযোগ সুবিধা
বিসিবির অন্যান্য কিউরেটর থেকে অনেক বেশি সুযোগ সুবিধা পান গামিনি। বিসিবির অন্যান্য দেশি কিউরেটর থেকে ৬ গুন বেশি বেতন, গাড়ি ও ফ্লাট দেয়া হয়েছে তাকে।
৫) বিসিবির আনুকুল্য
২০১৮ সালের ত্রিদেশীয় টুর্নামেন্টে শ্রীলংকাকে গোপনীয় তথ্য পাচার, পিচে আগের দিন পানি ঢালা ও হাথুরুসিংহের সাথে গোপন বৈঠক বিষয়ে একটি টিভি চ্যানেলে রিপোর্ট প্রচারিত হলেও বিসিবি তদন্তে গামিনির বিরুদ্ধে কোন প্রমান পায়নি। উল্টো বিসিবি প্রেসিডেন্ট ম্যাচ হারার জন্য খেলোয়ারদের দায়ী করে ও যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে জ্বালাময়ী বক্তব্য দেন। আর খালেদ মাহমুদ সুজন গামিনি ডি সিলভার কোন দোষ নেই বলে বক্তব্য দেন।
৬) গামিনির চাকরি যাবে না
শত অভিযোগ, আইসিসির ডিমেরিট পয়েন্ট, ক্রিকেটারদের পক্ষ থেকে অভিযোগ কোন কিছুই গামিনি ডি সিলভাকে সরাতে পারে নি। উল্টো ২০১৮ সালে কান্ডের পর খালেদ মাহমুদ সুজন সাংবাদিকদের বলেন, ওর চাকরির পেছনে না লাগতে। তার মতে গামিনি ডি সিলভা বাংলাদেশের জন্য অনেক ভালো কাজ করেছেন, তার মতো কিউরেটর আর নেই। আমরা হারি কারন আমাদের ক্রিকেটাররা ভালো খেলতে পারে না। গামিনির কোন দোষ নেই। [সূত্রঃ বাংলানিউজ২৪, ফেব্রুয়ারি ১২, ২০১৮]
২০১৮ তে বিসিবি নতুন দুজন বিদেশী কিউরেটর নিয়োগ দিলেও, গামিনি ডি সিলভাকে চাকরিচ্যুত করবেনা বলে সাফ জানিয়ে দেয়। বিসিবির পরিচালক ইসমাইল হায়দার মল্লিক বলেন, ‘গামিনি থাকবেন। তাকে সরানোর কোনো চিন্তা নেই। তার পারফরম্যান্স তো খারাপ নয়। তাকে কেন সরানো হবে?" বিসিবির মিডিয়া বিভাগের চেয়ারম্যান জালাল ইউনুস-ও নিশ্চিত করেন গামিনিকে সরানোর কোন পরিকল্পনাই নেই বিসিবির।[সূত্রঃ মানবজমিন ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮]
নতুন কিউরেটরদের ভেতর প্রবীণ হিংনিকারকে চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। আর সঞ্জীব আগারওয়ালকে খুলনা ও সিলেট স্টেডিয়ামের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। গামিনি তার জায়গায় আজও সগৌরবে বহাল আছেন।
তো আবার আপনাকে জিজ্ঞেস করি, বাংলাদেশের ক্রিকেটে সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যাক্তিটি কে?
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই আগস্ট, ২০২১ রাত ১:২৫