প্রথমেই বলি এই বিষয়ে আমার লেখার ইচ্ছে ছিলো না, কিন্তু এখন না লিখেও পারতেছি না। কিছু মানুষের আচরনে আমি পুরো হতবাক হয়ে গেছি। তাদের লজিক শুনে হাসতে হাসতে ঠোট ফেটে গেছে, কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলে গেছে।
ঘটনার শুরু সম্ভবত ব্লগার ঠাকুর মাহমুদের রোল নাম্বার ওয়ান লেখাটি থেকে। সেখানে ব্লগার হাবিব স্যার একটি মন্তব্য করেন। তার প্রতি উত্তরে ঠাকুরমাহমুদ হাবিব স্যারের ব্লগ নিক নিয়ে আপত্তি জানান এবং স্যার শব্দ বাদ দেয়ার উপদেশ দেন। যেহেতু ব্লগার হাবিব স্যার তার নিক থেকে স্যার বাদ দিয়ে হাবিব নামে বদলে নিয়েছেন, তাই আর এ বিষয়ে কিছু বলার কিছু নাই। সব ঠিকই ছিলো।
কিন্তু ঠাকুরমাহমুদ আজকে আবার একটা পোষ্ট দিয়েছেন এ বিষয়ে। এবারের বিষয় ব্লগার হাবিব এর একটি মন্তব্য। চাদগাজীর একটি মন্তব্যের প্রতিউত্তরে তিনি লিখেছিলেন, "স্যার শব্দ উচ্চারণে বাঙালীদের ইগুতে লাগে"। এই কথাটির জন্য ঠাকুরমাহমুদ প্রতিবাদ জানিয়ে পোষ্ট লিখেছেন। যদিও এই মন্তব্য কোন পোষ্টে করা হয়েছে সেটা উল্লেখ করা হয় নি বা লিংক দেয়া হয় নি। আমার ধারনা ব্লগার হাবিব যে সাময়িক পোষ্ট দিয়েছিলেন, এই মন্তব্য সেই পোষ্ট এর। একটা মুছে দেয়া পোষ্টের মন্তব্যের জন্য যদি এভাবে একটা জ্বালাময়ী পোষ্ট দিতে হয়, তবে সেটা "ইগো" তে লাগার ব্যাপারটাই প্রমান করে।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে, তাদের ঝগড়া ঝামেলায় আমি কেন ঢুকছি? কিংবা আমার কিছু বলার থাকলে আমি তাদের পোষ্টে মন্তব্য না করে আলাদা পোষ্ট কেন লিখছি?
- কারন, প্রথমে লেখাটার শিরোনামে সাময়িক শব্দটা ছিলো, মানে লেখাটা স্বল্প সময় পরেই লেখকের মুছে দেয়ার ইচ্ছা ছিলো। সম্ভবত ব্লগটিমের একজনের মন্তব্যের কারনেই তিনি মুছেন নি। আর আমি কমেন্ট করিনি কারন কাল্পনিক_ভালোবাসা নামের এক ব্লগার (ব্লগটিমের কেউ হবে) খুব সুন্দর করে মন্তব্যে ছদ্মনাম ও তার ব্যবহারের নিয়ম জানিয়ে কমেন্ট করেছেন। এই মন্তব্যের পরে আমি আর মন্তব্য করার প্রয়োজন মনে করিনি।
তবে, এখনো ব্লগে অনেকেরই ব্লগনিক হিসেবে স্যার শব্দের ব্যবহারে সমস্যা আছে। যা আমার লেখার মন্তব্যে, কারো লেখায় আমার করা মন্তব্যের উত্তরে, বা কারো লেখায় অন্য কারো করা মন্তব্যে দেখতে পারছি।
ঠাকুরমাহমুদ তার লেখায় আমার নিক প্রসঙ্গ তুলেছেন, এবং তার লেখায় একজন অতি সক্রিয় ব্লগার যিনি মাসে ৬০ থেকে ১০০+ লেখা পোষ্ট করেন তিনি আমার নিকের প্রসঙ্গ টেনেছেন। এই মহামান্য গুনধর কবি, সাংবাদিক, গল্পকার ও ব্লগার আমার লেখাতেও কড়া সুরে জানতে চেয়েছেন, আমাকে কে স্যার পদবী দিয়েছে, আমি মিলাদ দিয়ে বা আকিকা করে এই নাম রেখেছি কি না?
এই মহান মনিষী, দেশের সম্পদ, বুদ্ধিজীবি মানুষটি আবার ঠাকুরমাহমুদ এর লেখাতেও পরোক্ষভাবে আমার থেকে কিছু বিষয় জানতে চেয়েছেন।
এই লেখায় আমি এই গুনবান, মহান, জনপ্রিয়, বুদ্ধিজীবি ও বাংলা সাহিত্যের উদীয়মান ও প্রতিভাবান কবি সাহেবের প্রশ্নের উত্তর দিবো। এবং ঠাকুরমাহমুদের লেখায় তিনি কিছু ভুল তথ্য দিয়েছেন, সেটার সম্পর্কে লিখবো।
প্রথম প্রশ্নঃ
(যেটা আমার নিরাপদ বোধ করছি লেখায় করেছেন)
উত্তরঃ এই প্রশ্ন দেখে তখন ভেবেছিলাম জনাবে আলা সারকাজম করে মন্তব্য করেছেন, তাই আমার উত্তরটাও সারকাস্টিক ছিলো। এখন যেহেতু বুঝতে পারলাম আপনি সিরিয়াস মানুষ, তাই সিরিয়াস উত্তর দিচ্ছি।
না, আকিকা বা মিলাদ দিয়ে এই নাম নেই নি। ব্লগে নিক নিতে আকিকা বা মিলাদ আবশ্যক কিনা জানি না. ব্লগ টিম দয়া করে জানাবেন।
আর স্যার কোন উপাধী নয়, লেখার পরবর্তী অংশে এ বিষয়ে বিস্তারিত লেখা হয়েছে।
দ্বিতীয় প্রশ্নঃ
(ঠাকুর মাহমুদের রোল নাম্বার ওয়ান লেখায় মন্তব্য করেছেন)
(ঠাকুরমাহমুদ এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। তাতে মন না ভরলে আমার উত্তর প্রযোজ্য।)
উত্তরঃ না, মোটেও সংকোচ হয় না। স্যার শব্দটা কোন সম্মান সূচক বিশেষন বা উপাধি না।
আর কি নামে সম্মোধন করবেন এটা ভেবে বিব্রত হওয়ার কি আছে? আর কোন নামে সম্মোধন করার প্রয়োজনটাই বা কি? ব্রিটিশদের মতো সম্মোধনবিহীন কথোপকথন করবেন। আর এটা ব্লগ, আমি আপনার বাড়িতে যাচ্ছি না যে আমাকে সম্মোধন করে কথা বলতে হবে।
আর একজন ব্লগারকে সম্মোধন করতে তার নিক লিখেই সম্মোধন করাই তো সহজ বিষয়! নাকি আমার নিকে স্যার শব্দটা আছে বলেই এতো আপত্তি? আমার নিকে সম্মোধন করা আর ব্যক্তি আমাকে স্যার বলা এক করে ফেলছেন কেন?
আর যদি আমার নিকে সম্মোধন করতে গেলেই আপনার স্যার স্যার ফিল আসে, ভাবেন তো আর আমার নিক থেকেও অদ্ভুত অনেক নিক আছে এই ব্লগে। কাল্পনিক_ভালোবাসাকে তার নিকে সম্মোধন করলে কি আপনি তার প্রতি ভালোবাসা অনুভব করেন? মরুভুমির জলদস্যুকে সম্মোধন করলে ডাকাত মনে করে ভয় লাগে? ৎৎৎঘূৎৎ কে সম্মোধন করে কেমন অনুভুতি হয়? সম্মোধন না করেই মন্তব্য করুন।
ঠাকুরমাহমুদের বিষয়ে বলি, তার বেশ কয়েকটা লেখা আমি পড়েছি, আমার ভালো লেগেছে। ভালো লেখেন, হাজার পোষ্ট করা ব্লগারের মানহীন লেখা না, উপভোগ্য লেখা লিখেন। তবে নিক নিয়ে অবস্থানটা আমার ভালো লাগে নি। তার মতো পুরাতন একজন ব্লগার একটা মুছে দেয়া পোষ্টের মন্তব্য নিয়ে পোষ্ট লিখবেন এটাও কাম্য হওয়ার কথা না। যাই হোক, তার সাথে আমার বিবাদ নেই, তবে তার লেখা পড়ে আমার মনে হয়েছে কিছু ভুল তথ্য তাকে বিভ্রান্তিতে ফেলেছে। সেটাই লিখছি।
ঠাকুরমাহমুদ তার লেখায় লিখেছেন, "স্যার আসলেই এতো বড় বিষয় আন্তজার্তিক ক্ষেত্রে একমাত্র ব্রিটিশ রাণী স্যার পদবি দেওয়ার একচ্ছত্র অধিকার রাখেন। আশা করি স্যারের মর্যাদা ও মূল্য ব্লগারগণ বুঝবেন।"
- স্যার শব্দটি কোন পদবি বা উপাধি নয়। ব্রিটিশ রানী কাউকে স্যার পদবি দেন না। তিনি নাইটহুড পদবিতে ভূষিত করেন। নাইটহুড পাওয়া মানুষকে নাইট (Knight) বলা হয়। তাদেরকে সম্মোধন করতে স্যার বলা হয়। এবং নামের আগে এই স্যার যুক্ত করে ডাকা হয়। নামের পরে নয়। যেমনঃ স্যার আইজ্যাক নিউটন, স্যার এ্যান্থনী ইডেন, স্যার কিংসলে এ্যামিস।
স্যার শব্দটি কিভাবে এলো?
মধ্যযুগে বিশেষ করে ক্রুসেড এর সময়ে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর উচ্চপদের সেনাদের নাইট উপাধি দেয়া হতো, এবং তাদের স্যা'আর (Sire ) সম্মোধনে ডাকা হতো। ল্যাটিন শব্দ সিনঅর(senior) থেকে ইংরেজী স্যা'আর (Sire ), ফ্রেঞ্চ ম'সিউর(Monsieur), স্প্যানিশ সেনর (Señor), ইটালীয়ান সিনোর (Signor) শব্দগুলোর উঁপত্তি।
পরবর্তীতে সেনা ছাড়াও, জমিদার, শাসক, লর্ড, ওয়ার্ডেনদের সম্মান দেখিয়ে স্যার সম্মোধন করা হতো। স্যার কোন পদবী বা উপাধি বা বিশেষন না, উচ্চপদের সেনা বা শাসককে এই সম্মোধন করা হতো।
ভারতে ব্রিটিশ কর্মচারীরা নিজেদেরকে "ব্রিটিশ ভারতের" নাগরিকদের চেয়ে উচ্চ মর্যাদার মনে করতো এবং স্যার সম্মোধনে ডাকতে বাধ্য করতো।
মজার ব্যাপার হলো, সেখান থেকে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মানুষের ভেতর স্যার শব্দটা নিয়ে আজব ধারনা তৈরী হয়েছে। তাদের মতে নিজের থেকে উপরের স্তরের নাগরিককে,সম্মানী ব্যাক্তিকে, উচ্চপদস্থ সরকারী ব্যক্তিকে স্যার ডাকতে হবে। শিক্ষককে স্যার/ম্যাডাম ডাকতে হবে, অফিসের বসকে স্যার ডাকতে হবে...
এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন, বাংলাদেশের সংবিধান অনুসারে সরকারী কর্মচারীগনকে বা জনপ্রতিনিধিদেরকে সাধারন জনগন স্যার ডাকতে বাধ্য নন। এমন কোন রুল বা আইন নেই। তবে সরকারী কর্মচারীগন তাদের সিনিয়রদের যথাযথ সম্মোধনে ডাকবেন, তাদের একটা প্রটোকল আছে, সরকারী কর্মচারী আচরণ বিধিমালা তাদের মানতে হয়। সশস্ত্র বাহিনীতেও এমন প্রটোকল আছে, তবে এসব দেশের সাধারন জনগনের জন্য প্রযোজ্য নয়।
আইরনির ব্যাপার হচ্ছে, ইংল্যান্ড, আমেরিকায় এখন স্যার শব্দটা সাধারন মানুষকে সম্মোধন এর জন্য ব্যবহার হয়। অপরিচিতদের বা বয়স্কদের স্যার/ম্যাডাম বলে সম্মোধন করা হয়। তাদের শিক্ষকদের নাম ধরে ডাকা হয়, সাধারন মানুষ সরকারী অফিসারদের পদ-পদবি (ইন্সপেক্টর, অফিসার, জাজ) বলে ডাকে। এবং সরকারী অফিসার, পুলিশ এমনকি বিচারপতিও সাধারন মানুষকে স্যার বলে সম্মোধন করেন। বারাক ওবামা, জাস্টিন ট্রুডো তাদের সাধারন নাগরিককেও স্যার সম্মোধন করেন।
তাদের কাছে স্যার মানে জনাব, অনেকটা ভারতের জি (স্যারজি, চাচাজি, বিধায়কজি) বা মহোদয়, পাকিস্তানের সাহাব সম্মোধন এর মতো। আমরা বাঙালীরা সম্মোধন করতে আগে মশাই, মিঞা, মহাশয় বলতাম।
---------------------------------------------------------
যাই হোক, আমার ব্লগ নিক আমারে স্যার ডাকবা, হুমায়ূন আহমেদ এর একটি নাটকের ডায়ালগ থেকে নেয়া। এই শব্দ দিয়ে আমি আপনাদের স্যার ডাকার আদেশ করিনি। মজার মনে হওয়ায় ছদ্মনাম হিসেবে ব্যবহার করেছি। আমার লেখায় মন্তব্য করতে আমাকে সম্মোধন করারও প্রয়োজন নেই, আমার নিক লিখে সম্মোধন করতে আপত্তি থাকলে আ.স্যা.ডা বলে সম্মোধন করতে পারেন।
ঈশ্বর সকলের সহনশীলতা বাড়িয়ে দিক এই কামনা করি। সবার জন্য শুভ কামনা। পৃথিবী সুন্দর হোক।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২১ সন্ধ্যা ৭:৩৭