চারদিকে এমন গবেষণা ও এগিয়ে যাওয়ার এ যুগেও এ বীরপুরুষদের সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না। আমরা বনে-জঙ্গলে পালিয়ে বেড়ানো চে-গু’র ছবি বুকে নিয়ে গর্ব করি, নেপোলিয়ন, মুসোলিনি সম্পর্কে জানতে আগ্রহী, হিটলারের বাঙ্কার আর তার প্রেমিকার নাম-ধাম নিয়ে উৎসাহ বোধ করি- স্যার রিচার্ড , আলেকজান্ডার এদের আড়ালে বীর মুজাহিদ সুলতান সালাহুদ্দিন আল আইউবি , গজনির সুলতান মাহমুদ, মুহাম্মদ বিন কাসিম এই মহাপুরুষদের জীবনী ও কর্মকাণ্ড আমরা কয়জনে জানি বা জানার চেস্টা করি ।
গজনীর সুলতান মাহমুদ কিংবদন্তী এক নাম যিনি ভারত উপমহাদেশের তৎকালিন অত্যাচারী হিন্দু রাজাদের জন্য ছিলেন এক ভয়ংকর আতংক । তৎকালিন ভারতের অসহায় ও অত্যাচারিত মুসলমানদের জন্য তিনি ছিলেন মুক্তির দুত।
সবুক্তগীনের মৃত্যুর পর তার জ্যেষ্ঠ পুত্র সুলতান মাহমুদ ৯৯৭ খৃস্টাব্দে গজনীর সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং ৯৯৮ খৃস্টাব্দে খোরাসানের সামানীয়দের পরাজিত করে স্বীয় আধিপত্য মজবুত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করেন। অতঃপর মাহমুদ ‘সুলতান' উপাধি গ্রহণ করে তৎকালীন আব্বাসীয় খলিফা কাদির বিল্লাহর আনুগত্য স্বীকার করে পত্র প্রেরণ করেন। এতে খলিফা সন্তুষ্ট হয়ে তাকে ‘ইয়ামিন-উদ-দৌল্লা' এবং ‘আমিন-উল-মিল্লাত' উপাধিতে ভূষিত করেন।
তিনি মূর্তি পূজারী পৌত্তলিক ও নিষ্ঠুর হিন্দু রাজাদের বিরুদ্ধে ১৭ বার ভারত আক্রমণ করেছিলেন। সামরিক মেধা ও দক্ষতায় তৎকালীন কোনো নৃপতিই তার সমকক্ষ ছিল না। সতেরবার ভারত অভিযানে তিনি প্রতিবারই বিজয়ী হন।
তিনি ছিলেন একজন নিবেদিত প্রান খাঁটি মুসলিম । যদিও বিধর্মী ইতিহাসবিদেরা তার এই ধর্ম প্রান ব্যাক্তিত্বকে আড়াল করে উনাকে লুটেরা হিংস্র সুলতান হিসাবেই চিত্রিত করেছে । এতে উনার দ্বীনের প্রতি নিবেদিত কর্ম গুলি মিথ্যা ইতিহাসের আড়ালে হারিয়ে গেলেও পরবর্তীতে মুসলমান ইতিহাসবিদেরা মিথ্যা ইতিহাসের মেঘের আড়াল হতে সুলতান মাহমুদের সত্য ইতিহাস মধ্যাহ্ন সূর্যের আলোর মতই প্রজ্বলিত করেছেন। এতে আমরা দেখতে পাই তিনি ছিলেন ইসলামের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া একজন খাঁটি মুসলিম। যিনি ব্যাক্তিগত জীবনেও ছিলেন পরহেজগার ও মুত্তাকী । তিনি তাকওয়ার দিক দিয়েও ছিলেন অন্যতম একজন বাদশাহ। যুদ্ধের ময়দানে যখন শ্ত্রুদের আক্রমণে তিনি পরাজয়ের দ্বার প্রান্তে চলে যেতেন, তখন সেই ময়দানেই তিনি তার বাহন হতে নেমে দুই রাকাত নামায পড়ে আল্লাহর কাছে কাতর মনে সাহায্য চাইতেন । এতে আল্লাহতালা তার দোয়া কবুল করে উনাকে বিজয় দান করতেন । এই রকম ঘটনা উনার জীবনে বহুবার ঘটেছে।
একদিনের ঘটনা রাজ দরবারের সমস্ত কাজকর্ম শেষ করে তিনি সেদিন বড়ই ক্লান্ত বোধ করছিলেন। তাই তাড়াতাড়ি বিশ্রাম লাভের জন্য সুলতানের মন উদগ্রীব হয়ে উঠে। তিনি বিশ্রামের জন্য গৃহে প্রবেশ করলেন। নরম বিছানায় গা এলিয়ে দেবার জন্য এগিয়ে যান। হঠাৎ গৃহমধ্যে একটি তাকের দিকে তাঁর নজর পরে। সেখানে একটি কুরআন শরীফ রাখা ছিল। কুরআন শরীফ আল্লাহর কিতাব। পবিত্র কিতাব। বিছানার উপর শয়ন করলে কুরআনের দিকে পা চলে যায়। কুরআনের দিকে পা ছড়িয়ে শয়ন করার চাইতে বড় বেয়াদবি আর কি হতে পারে।এই চিন্তায় সুলতান অস্থির হয়ে পড়েন। তিনি মনে করেন বিছানার খাটটি অন্যদিকে ফিরিয়ে দেই, তাহলে কুরআনের দিকে মাথা হয়ে যাবে। যেই কথা সেই কাজ। তিনি সঙ্গে সঙ্গেই খাটটি ঘুরিয়ে দেন।
এবার সুলতান শয়ন করতে গেলেন। কিন্তু হঠাৎ আবার মনে হলো আল্লাহর কিতাব আমার ঘরে থাকবে আর আমি তা পড়বো না? আমি শুয়ে আরাম করবো ? আল্লাহর কিতাবে যা লেখা আছে আমি তা পালন করবো না ? আল্লাহর কিতাবেত আমাদের কথা লেখা আছে। অথচ আমি তা জানবো না ? ঘুমিয়ে রাত কাটাবো, আমি এত বড় গাফেল ? সুলতানের আবার মনে হলো, কুরআন শরিফটা পাশের ঘরে রেখে এলেই তো হয়। তাহলে আমি আরাম করে শয়ন করতে পারবো।
এ চিন্তা মনে আসার সাথে সাথেই সুলতানের মন কেঁপে ওঠে।সুলতান মনে মনে বললেন। হায়, আমি কত বড় পাষণ্ড হয়ে গেছি। নিজের আরামের জন্য আল্লাহর পবিত্র কিতাবকে এ ঘর থেকে সরিয়ে দিতে চাচ্ছি। আল্লাহর সাথে আমি কত বড় গোস্তাখী করছি। ঝর ঝর করে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে থাকে সুলতানের চোখ দিয়ে।
সে রাতে আর সুলতান বিছানায় শয়ন করতে পারেননি। কোরআন তেলোয়াত করতে করতে সারা রাত পার করে দেন।।
আল বিরুনি , ফিরিশ্তা,গারদিজ, উতবি ও বায়হাকির মত বিখ্যাত ও নির্ভরযোগ্য ইতিহাসবিদ্গন লিখেছেন
সুলতান মাহমুদ তৎকালীন বুজুর্গ আবুল হাসান খেরকানি রহমতুল্লাহ আলাইহির মুরিদ ছিলেন । আবুল হাসান খেরকানি রহমতুল্লাহ আলাইহি এমনই এক বুজুর্গ যার জন্মের প্রায় ৫০ বছর আগে হযরত বায়েজিদ বোস্তামি রহমতুল্লাহ আলাইহি উনার জন্মস্থান গ্রামের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বলে ছিলেন এই চোরদের গ্রামে এক মহান বুজুর্গ জন্ম গ্রহন করবে।
সেই বুজুর্গ আবুল হাসান খেরকানি রহমতুল্লাহ আলাইহির দরবারে তিনি নিয়মিত যাতায়াত করতেন । তিনি নিজেই হযরত আবুল হাসান খেরকানি রহমতুল্লাহ আলাইহি এর দরবারে যেতেন । একজন সুলতান হিসেবে তিনি কখনও আবুল হাসান খেরকানি রহমতুল্লাহ আলাইহি কে দরবারে ডেকে পাঠান নাই । তিনি ছদ্মবেশে বুজুর্গের দরবারে যেয়ে ইসলাহ ও পরামর্শ নিতেন । সেখানে তিনি আত্ম পরিচয় গোপন করে নিজেকে সুলতানের দুত হিসেবে পরিচয় দিতেন। তাই হযরত আবুল হাসান খেরকানি রহমতুল্লাহ আলাইহি মজলিসে সুলতানের উপস্থিতিতে বলতেন ”আমার একথা ভাবতে ভাল লাগে যে গজনীর সুলতানের দূত সুলতান নিজেই হন । এটা প্রকতই মুসলমানের আলামত।
আমরা সবাই জানি যে পানিপথের ১ম যুদ্ধ হয়েছে ১৫২৬ সালে। বাবর পানিপথের ১ম যুদ্ধে ইব্রাহিম লোদীকে পরাজিত করেন। পানিপথের ১ম যুদ্ধের পর বাবর ততক্ষন পর্যন্ত খাদ্য গ্রহণ করেন নাই যতক্ষন না পর্যন্ত বাবর কে ইব্রাহিম লোদির লাশ দেখানো হয়েছে। ইব্রাহিম লোদীর লাশ দেখানোর পর বাদশাহ বাবর খাদ্য গ্রহন করেছিলেন।
মধ্য এশিয়ার যেই সব স্থানীয় শাসক সুলতান মাহমুদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল সুলতান মাহমুদ তাদেরকেও হত্যা করেছিলেন। মধ্যযুগে এক মুসলমান সুলতান আরেক মুসলমান সুলতান কে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রায়ই হত্যা করতেন। সুলতান মাহমুদ মোট ১৭ বার ভারত অভিযানেই ভারতের বিভিন্ন দেশীয় রাজা যেমন জয়পাল, আনন্দপাল, সুখপাল কে যুদ্ধে পরাজিত করেন। সেই সময়ের মধ্যযুগীয় নীতি অনুসারে সুলতান মাহমুদ চাইলেই পরাজিত সকল দেশীয় হিন্দু রাজাকে হত্যা করতে পারতেন । কিন্তু তিনি উনার সাথে যুদ্ধে পরাজিত একজনও দেশীয় হিন্দু রাজাকে হত্যা করেন নি। শুধু সুলতান মাহমুদ নয় ভারতের মহান মুসলিম শাসকরা কখনই কোন পরাজিত হিন্দু রাজাকে হত্যা করতেন না। ভারতের মুসলিম শাসকরা অমুসলিমদের প্রতি যে ঔদার্য্য দেখিয়েছে জ্বলজ্যান্ত ইতিহাস তার সাক্ষী। আজকে যেইসব হিন্দু ভারতের মহান মুসলিম শাসকদের এই সব মহানুভবতার কথা অস্বীকার করতে চায় তারা আসলেই সব জ্ঞানপাপী।
সুলতান মাহমুদ মোট ১৭ বার ভারত আক্রমন করেছিলেন। যেই মন্দিরের অভিযান নিয়ে পৌত্তলিক ইতিহাস বিদরা সুলতান মাহমুদকে লুটেরা ও মন্দির ধ্বংস কারী হিসেবে আখ্যায়িত করেন সেই সোমনাথ মন্দিরে অভিযান চালিয়েছেন উনার ভারত আক্রমনের ১৬ তম অভিযানের সময়। সুলতান মাহমুদ যদি শুধুমাত্র ধর্মীয় কারনে সোমনাথ মন্দিরে অভিযান পরিচালনা করতেন তাহলে তো সুলতান মাহমুদ উনার ভারত আক্রমনের ১ম অভিযানেই সোমনাথ মন্দির আক্রমণ করতেন। এই ১৭ বার ভারত আক্রমনের সময়ে সুলতান মাহমুদ খালি সোমনাথ মন্দির ছাড়া আর কোন মন্দিরেই উনি কোন অভিযান পরিচালনা করেননি। সোমনাথ মন্দির আক্রমণ করার জন্য সুলতান মাহমুদ খাইবার গিরিপথ অতিক্রম করে ভারতের গুজরাটে আসেন। সুলতান মাহমুদ যদি হিন্দু বিদ্বেষী হতেন তাহলে তো গজনী থেকে গুজরাট আসার পথে রাস্তায় অনেক মন্দির পড়েছিল, সেগুলো নিশ্চয়ই সুলতান মাহমুদ অক্ষত রাখতেন না। সুলতান মাহমুদের জীবনীর উপর লেখা এনায়েত উল্লাহ আল তামাসের লিখিত বিখ্যাত ইতিহাসিক বই “সুলতান মাহমুদ গজনবীর ভারত অভিযান” থেকে আমরা জানতে পারি যে তৎকালিন সোমনাথ মন্দিরের পুরাহিতরা একজন মুসলিম তরুনীকে ঐ মন্দিরে বলী দেওয়ার উদ্দেশে অপহরণ করে । তাদের কথিত ভগবানের অনুগ্রহ পাওয়ার আশায় কল্পিত ভগবান সোমনাথের স্বর্ণ নির্মিত মূর্তির সামনে ঐ মুসলিম তরুনীকে ধর্ষণ ও হত্যা করে। মন্দিরের পুরাহিত কর্তৃক একজন মুসলিম তরুণীকে ধর্ষন ও হত্যা করার খবরটি সুলতান মাহমুদ জানতে পেরে /গজনী থেকে ৪২ দিনে প্রায় হাজার মাইল পথ হেঁটে ১০২৫ সালের ৬ জানুয়ারী সুলতান মাহমুদ সোমনাথের মন্দিরের অনতিদূরে পৌঁছেছিলেন। এরপর সোমনাথ মন্দির আক্রমন করে এবং সোমনাথ মন্দিরটি সম্পূর্ণ রুপে ধ্বংস করেন, এবং এই সোমনাথ মন্দিরের মূর্তির কিছু খণ্ডাংশ তৎকালিন বাগদাদের খলীফা আল ক্বাদির কে উপহার হিসাবে প্রেরন করেন। এর থেকে বুঝা যায় যে সুলতান মাহমুদ সুদীর্ঘ প্রায় হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে সোমনাথ মন্দির আক্রমণ করেছেন কোন স্বর্ণ অলংকারের লোভে নয় । সোমনাথ মন্দিরের স্বর্ণ অলংকার গনিমতের মাল হিসাবে নিয়ে যাওয়া হয়। যা প্রত্যেকটি যুদ্ধে বিজিত দল বা জাতি করে থাকে।
আর তথাকথিত সোমনাথ মন্দিরের সেই ২০০ মন স্বর্ণ উদ্ধারের লোভে যদি সুলতান মাহমুদ সোমনাথ মন্দিরে অভিযান চালাতেন তাহলে তো ভারত বর্ষের সকল মন্দিরেই সুলতান মাহমুদ অভিযান পরিচালনা করতেন। কারন সেই সময়ে হিন্দুরা তাদের টাকা পয়সা সব মন্দিরের অভ্যন্তরে গচ্ছিত রাখত। মূলত সেই মুসলিম তরুনীকে ধর্ষন ও সোমনাথ মন্দিরের বিগ্রহের সামনে বলী দেয়ার কারনেই সুলতান মাহমুদ সোমনাথ মন্দিরে অভিযান চালিয়েছিলেন।
সুলতান মাহমুদ ১৭ যুদ্ধের সংক্ষিপ্ত বিবরণ
(১) সামানন্ত দুর্গ দখল : ভারতবর্ষে সুলতান মাহমুদ সর্বপ্রথম ১০০০ খৃস্টাব্দে এক সামরিক অভিযানের মাধ্যমে লামদানা ও পেশোয়ারের মধ্যবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত সীমান্ত দুর্গগুলো অধিকার করেন ।
(২) জয়পালের বিরুদ্ধে অভিযান : ১০০১ খৃস্টাব্দে সুলতান মাহমুদ পিতৃ শত্রু জয়পালের মোকাবিলা করেন। সবুক্তগীনের কাছে দু'বার পরাজিত হয়েও জয়পাল মুসলিম আক্রমণের বিরোধিতা ও তাদের সাথে সম্পাদিত সন্ধিচুক্তি ভঙ্গ করে বিশ্বাসঘাতকতা করেন।
(৩) ভীরার রাজার বিরুদ্ধে অভিযান : ১০০৪-৫ খৃস্টাব্দে ভীরার রাজা বিজয় রায়ের বিরুদ্ধে মাহমুদ এক সামরিক অভিযান করেন। বিজয় রায় মাহমুদকে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তা ভঙ্গ করলে মাহমুদ তার বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেন।
(৪) মুলতান অভিযান : মুলতানের শাসনকর্তা আবুল ফাত্তাহ দাউদ গজনীর সুলতান মাহমুদের সম্প্রসারণবাদকে প্রতিহত করার জন্য জয়পালের পুত্র আনন্দপালের সাথে সখ্যতা স্থাপন করেন। মুলতানের শাসনকর্তার অনৈসলামিক কার্যকলাপ এবং বিদ্বেষ ও বিশ্বাসঘাতকতামূলক আচরণে ক্রুদ্ধ হয়ে মাহমুদ ১০০৫-৬ খৃস্টাব্দে পাঞ্জাবের মধ্য দিয়ে মুলমানের দিকে অগ্রসর হলেন। কারামাতী নেতা দাউদের প্ররোচণায় আনন্দপাল মাহমুদের গতিরোধ করলে তিনি পরাজিত হয়ে কাশ্মীর উপত্যকায় আশ্রয় নেন। অতঃপর মাহমুদ দাউদকে সমুচিত শিক্ষা প্রদানের জন্য মুলতান অবরোধ করেন। সাতদিন অবরুদ্ধ থাকার পার দাউদ মাহমুদের কাছে আত্মসমর্পণ করেন,।
(৫) সুখপালের বিরুদ্ধে অভিযান : সুলতান মাহমুদ ও মোঙ্গল নেতা ইলাক খানের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ চলার সুযোগে সুখপাল ১০০৭ খৃস্টাব্দে ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করে পুনরায় হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করেন এবং বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। বলখের যুদ্ধের সমাপ্তির পর মাহমুদ সুখপালকে শায়েস্তা করার জন্য অভিযান করেন। কিন্তু সীমান্তে পৌঁছৈ সংবাদ পেলেন যে, তার আমরিগণ সুখপালকে পরাজিত ও বন্দী করেছে। সুখপালকে ৪,০০,০০০ দিরহাম জরিমানা এবং যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয়া হয়।
(৬) আনন্দপালের বিরুদ্ধে অভিযান : কারামাতী নেতা দাউদকে সহায়তার জন্য ১০০৮-৯ খৃস্টাব্দে সুলতান মাহমুদ একটি শক্তিশালী বাহিনী নিয়ে আনন্দপালের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। সমূহ বিপদের আশঙ্কায় আনন্দপাল পার্শ্ববর্তী হিন্দু রাজন্যবর্গের কাছে সাহায্যের আবেদন জানান, তার আহবানে সাড়া দিয়ে উজ্জয়িনী, কনৌজ, কালিঞ্জর, দিল্লী এবং আজমীরের হিন্দুরাজন্যবর্গের সম্মিলিত বাহিনী মাহমুদের গতিরোধের জন্য পাঞ্জাবের দিকে অগ্রসর হয়। সুলতান মাহমুদের নেতৃত্বাধীন মুসলিম বাহিনী পেশোয়ার ও ওয়াইহিন্দের মধ্যবর্তী অঞ্চলে হিন্দুদের নির্মমভাবে পরাজিত ও বিধ্বস্ত করেন।
(৭) প্রতিরোধমূলক অভিযান : ১০০৯-১০ খৃস্টাব্দে সুলতান মাহমুদ ভারতবর্ষে সপ্তম অভিযান পরিচালনা করেন। তবে তাঁর এ অভিযানের উদ্দেশ্য দেশ জয় ছিল না, বরং পরাজিত হিন্দু রাজাদের বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য করা এ অভিযানের লক্ষ্য ছিল।
(৮) দাউদের পরাজয় : ১০১০ খৃস্টাব্দে দুর্ধর্ষ ঘোর উপজাতিদের বিদ্রোহ নির্মূল করে সুলতান মাহমুদ মুলতানের শাসনকর্তা বিশ্বাসঘাতক দাউদের বিরুদ্ধে পুনরায় অভিযান পরিচালনা করেন, কারামাতী নেতা দাউদ যুদ্ধে পরাজিত হলে তাকে ঘোরের দুর্গে বন্দী করা হয়।
(৯) ত্রিলোচন পালের বিরুদ্ধে অভিযান : সুলতান মাহমুদের কাছে পরাজিত হয়ে বশ্যতা স্বীকার করলেও আনন্দপাল লবণগিরি অঞ্চলে পুনরায় শক্তি সঞ্চয় করতে থাকেন, তার মৃত্যুর পর তদীয় পুত্র ত্রিলোচনপাল নন্দনায় রাজধানী স্থানান্তর করে সৈনবাহিনীকে সুসংবদ্ধ করেন। ১০১৪ খৃস্টাব্দে সুলতান মাহমুদ ত্রিলোচনপালের বিরুদ্ধে অগ্রসর হলে ত্রিলোচনপাল কাশ্মীরে পলায়ন করেন। কাশ্মীরে গমন করে মাহমুদ ত্রিলোচনপাল ও তার আশ্রয়দাতা রাজা তুঙ্গরকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেন।
(১০) থানেশ্বর বিজয় : সুলতান মাহমুদের সামরিক অভিযানের চমকপ্রদ ঘটনা ছিল থানেশ্বর বিজয়। ১০১৪ খৃস্টাব্দে হিন্দুধর্মের এ পবিত্র কেন্দ্রে মাহমুদ অভিযান করলে স্থানীয হিন্দু রাজা বশ্যতা স্বীকার করেন এবং থানেশ্বর দুর্গ থেকে মাহমুদ প্রচুর ধনরত্ন লাভ করেন।
(১১) কাশ্মীর অভিযান : ১০১৫-১৬ খৃস্টাব্দে মাহমুদ দ্বিতীয় বারের মতো কাশ্মীরে অভিযান করলেও প্রাকৃতিক দুর্যোগ, প্রতিকূল পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও লোহকোট দুর্গের দুর্ভেদ্যতা এ অভিযান ব্যর্থ করে দেয।
(১২) কৌনজ অভিযান : ১০১৮ খৃস্টাব্দে সুলতান মাহমুদ তার বিশাল বাহিনী নিয়ে কনৌজের দিকে অগ্রসর হন। হর্ষবর্ধণের রাজধানী কনৌজ সুসমৃদ্ধ ছিল এবং এ নিরাপত্তার জন্য সাতটি দুর্ভেদ্য দুর্গ ছিল। সুলতানের আগমনে ভীত-সন্ত্রস্ত প্রতিহার রাজা রাজ্যপাল বিনাশর্তে আনুগত্য স্বীকার করে।
(১৩) চান্দেলা রাজার বিরুদ্ধে অভিযান : কনৌজের রাজা রাজ্যপাল সুলতান মাহমুদের আনুগত্য স্বীকার করলে অন্যান্য পরাক্রমশালী রাজপুত অধিপতিগণ অপমান বোধ করেন। কালিঞ্জরের চান্দেলা রাজা গোন্তা গোয়ালিয়রের রাজপুত রাজার সাথে জোটবদ্ধ হয়ে রাজ্যপালের বিরুদ্ধে অভিযান করেন এবং তাকে যুদ্ধ ক্ষেত্রে পরাজিত ও হত্যা করেন। নৈতিক দিক থেকে চিন্তা করে সুলতান মাহমুদ তার মিত্র হিন্দু রাজা রাজ্যপালের হত্যার প্রতিশোধকল্পে ১০১৯ খৃস্টাব্দে চান্দেলা রাজার বিরুদ্ধে সমরাভিযান করেন। চান্দেলা রাজা গোন্তা মাহমুদের বাহিনীর প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হয়ে রণক্ষেত্র থেকে পলায়ন করেন। সুলতান বিজয়ীর বেশে চান্দেলার রাজধানীতে প্রবেশ করেন।
( (১৪) গোয়ালিয়র অভিযান : চান্দেলা রাজার সাথে গোয়ালিয়রের রাজার ষড়যন্ত্রের ফলে রাজ্যপালের হত্যার প্রতিশোধকল্পে কেবল চান্দেলা রাজাকে সমুচিত শিক্ষা দিয়েই সুলতান মাহমুদ ক্ষান্ত ছিলেন না। ১০২১-২২ খৃস্টাব্দে তিনি গজনী থেকে ভারতবর্ষের উদ্দেশ্যে চতুর্থদশবারের মতো অভিযান করেন। পাঞ্জাবে একটি সুপরিকল্পিত প্রশাসনিক কাঠামো প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সুলতান এ অভিযানে অসংখ্য ছুতার, রাজমিস্ত্রী ও কামার সাথে নিয়ে যান। সীমান্ত অঞ্চলের সোয়াত, বাজাউর এবং কাফিরিস্তানের বিদ্রোহী উপজাতিদের বিদ্রোহ নির্মূল করে তিনি গোয়ালিয়রের দিকে ধাবিত হন। গোয়ালিয়রের হিন্দু রাজা সুলতানের বশ্যতা স্বীকার করলে তিনি গজনীতে ফিরে যান।
(১৫) কালিঞ্জর বিজয় : সুলতান মাহমুদ ১০২২-২৩ খৃস্টাব্দে পশ্চদশবারের মতো রতবর্ষে অভিযান করেন। গোয়ালিয়র অধিকৃত হলে তিনি একটি শক্তিশালী বাহিনী নিয়ে কালিঞ্জরের হিন্দু রাজা নন্দার বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। নন্দা প্রচুর উপঢৌকন প্রদান করে সুলতানের আনুগত্য স্বীকার করেন।
(১৬) সোমনাথ বিজয় : সুলতান মাহমুদের ভারতবর্ষে অভিযানসমূহের মধ্যে সবচেয়ে রোমাঞ্চকর ও গুরুত্বপূর্ণ ছিল সোমনাথ বিজয়। হয়। সোমনাথ মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণ এবং যাবতীয় ব্যয় নির্বাহের জন্য ভারতীয় হিন্দু রাজন্যবর্গ দশ হাজার গ্রাম মন্দিরের সম্পত্তিরূপে দান করেন। সোমনাথ মন্দিরের পূজা-পার্বন ও অন্যান্য অনুষ্ঠানাদি পালনের জন্য এক সহস্র ব্রাহ্মণ নিয়োজিত ছিল। সর্বদা দেবতার তুষ্টির জন্য পাঁচশ' নর্তকী এবং দু'শ' গায়িকা নৃত্য-গীত করতো। ভারতবর্ষের হিন্দু রাজাগণ তাদের কুমারী কন্যাদের এ মন্দিরের সেবিকার জন্য উৎসর্গ করে কৃতার্থ হতেন। ১০২৫-২৬ খৃস্টাব্দে সুলতান মাহমুদ গজনী হতে তাঁর সুশিক্ষিত বাহিনী এবং ত্রিশ হাজার স্বেচ্ছাসেবকসহ গুজরাটের দিকে অগ্রসর হন। হিন্দু রাজপুত নৃপতিগণ সংঘবদ্ধ হয়ে মাহমুদের নেতৃত্বাধীন মুসলিম বাহিনীর গতিরোধ করেন। কিন্তু মুসলিম বাহিনীর প্রচন্ড আক্রমণে সম্মিলিত হিন্দু বাহিনী শোচনীয়ভাবে পরাজিত ও বিধ্বস্ত হয়। ১০২৬ খৃস্টাব্দের ৬ জানুয়ারি সোমনাথ মন্দিরের প্রাচীর ভেঙ্গে মন্দিরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে মুসলিম বাহিনী।
(১৭) জাউদের দমন : ১০২৭ খৃস্টাব্দে সুলতান মাহমুদ সপ্তদশ ও সর্বশেষবারের মতো দুর্ধর্ষ জাঠ উপজাতিদের বিদ্রোহ দমনে গজনী থেকে ভারতবর্ষে সমরাভিযান করেন। তার এ অভিযান ছিল বিশেষভাবে আকর্ষণীয়। চৌদ্দশত নৌকার একটি সুসজ্জিত নৌবহর তৈরি করে সুলতান মাহমুদ মূলতান থেকে জাঠদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাভিযান করেন। প্রতিটি নৌকায় বিশজন তীরন্দাজ এবং অগ্নি নিক্ষেপণের সরঞ্জাম ছিল। মুসলিম বাহিনীর প্রচন্ড আক্রমণে বিদ্রোহী ও বিশ্বাসঘাতক জাঠগণ শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয় এবং অসংখ্য জাঠ প্রাণ হারায়।
সুলতান মাহমুদ তার জীবনের শেষ যুদ্ধ করেছিলেন অসুস্থ অবস্থায় । সেলজুকিদের সাথে সেই যুদ্ধে তিনি শ্ত্রুদের পরাজিত করে ফেরার পর আরও ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন । তখন সুস্থ হওয়ার জন্য হাওয়া বদল করতে বলখে যান। এখানে আসার পরও সবার পরামর্শ অমান্য করে রাষ্ট্রিয় কাজে ব্যাস্ত থাকার দরুন আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন । এরপর উনি গজনী ফিরে আসেন। গজিনী আসার সাথে তিনি অগগান হয়ে যান । তার ব্যাক্তিগত চিকিৎসক তাকে পরিক্ষা করতে যেয়ে নিজেই কাঁদতে লাগলেন। চিকিৎসক তাড়াতাড়ি সুলতানের মুখের কাছে কান লাগিয়ে বললেন আমাদের উদ্দেশে কিছু বলুন। সুলতান মাহমুদ হাত উঠিয়ে কিছু বলতে চেয়ে বলতে পারলেন না তার আগে উনার উত্তোলিত হাত সবেগে উনার বুকের উপর পড়ে গেল ।
১০৩০ সালের ৩০ এপ্রিল এই মুসলিম বীর সুলতান মাহমুদ তার মালিকের অলংঘনীয় ডাকে সাড়া দিয়ে চির বিদায় নিলেন।
ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রজেউন ।
সেই দিন এশার নামাযের পর গজনীর ফিরোজি বাগে
উনাকে দাফন করা হয়।
তথ্য সংগ্রহ ঃ ইন্টারনেট, ঈমানী দাস্তান, মুসলিম ইতিহাস ।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই অক্টোবর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:০১