আমি যখন প্রথম মানিক ভাইকে দেখি তখন আমার বয়স কত ছিল মনে নাই । কারন তখন আমি ছোট ছিলাম। যতটুকু মনে পড়ে আমি স্কুলে যাছ্ছিলাম , যাওয়ার পথে বিশাল বাগান বাড়ি ওলা একটা বাড়ির সীমানা প্রাচীরের ভাংগা অংশ দিয়ে ছিটকে বের হল হালকা পাতলা গড়নের কালো রংগের ছেলেটি । পড়নে লুংগী কাছা দেওয়া । এক হাতে গাছ হতে সদ্য পাড়া চার পাঁচটা পাকা আম । আমরা কয়েকজন বান্ধবী উপরের ক্লাসের আপাদের সাথে স্কুলে যাছ্ছিলাম । এই সময় ছেলেটি দৌড়ে বের হয়ে আমাদের সামনে এসে থমকে দাড়াল । আমরা হঠাৎ ওকে দেখে দাড়িয়ে গেলাম। এক সাথে এতগুলো মেয়েকে দেখে ছেলেটি লজ্জা পেয়ে তাড়াতাড়ি লুংগীর কাছাটা নামিয়ে দিল। এই সময় ঐ সীমানা প্রাচীরের ভাংগা অংশ দিয়ে একটা কুকুর ঘেউ ঘেউ করতে করতে বের হয়ে এল। ছেলেটি কুকুরটি দেখেই আবার দৌড় দিল। ছেলেটি যেন বাতসে উড়ছে। পিছনে কুকুরটিও ওকে কামড় দেওয়ার জন্য ছুটছে ।
এদিকে আমরা মেয়েরা ভয়ে স্তব্দ হয়ে দাড়িয়ে দেখছি শেষটা কি হয় । ছেলেটি প্রাণপনে দৌড়াতে দৌড়াতে রাস্তা মধ্যেখানে সেতু ছিল । সে সেখান থেকে লাফ দিয়ে খালে পড়ল।
আমরা মেয়েরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম । আবার হাটতে লাগলাম। এইবার আমাদের মধ্যে যারা ওকে চিনে তাদের মধ্যে একজন বলল " বাপরে কি বিছ্ছুরে বাবা। হারাডা দিন গ্রামডাকে যেন্ মাথায় তুইল্লা রাখে । "
আরেকজন মেয়ে বলল " ঠিক কইছস । এই হেদিন আমাগো কলা গাছের এক কাঁদি কলা হাওয়া । এইডা এই মানিক্কার কাম। "
" আরে রাখ । তোগোত খালি এক কাঁদি কলা । আমাগোত এক রাইতে গোটা পুকুরের মাছই ছাফ কইরা ফালাইছে এই মানিক্কা চোরা।"
আমি অবাক হয়ে দেখি সবাই মানিকের বিরুদ্ধে । এর মধ্যে একজন মানিকের পক্ষে কথা বলে উঠল।
"সাহস থাকলে ওর সামনে কথাগুলি তোরা কইছ দেখি । কামাইল্লা চোরা করলে মানিকের দোষ । সুমন চোরা করলে মানিকের দোষ । পোলাডার বাপ নাইত সবাই হেরে নরম পাইচছ। কামাইল্লা মেম্বারের পোলা , সুমইন্না আড়তদাড়ের পোলা, হেইল্লিগা হেগো বিরুদ্ধে কিছু কস না। "
সাথে সাথে আরেকজন বলল " ঠিক কইচ আপা । মানিক্কা গরীবত তাই সবাই তারে দোষে । এই তোগো যে গাছের কলা আর পুকুরের মাছ চুরি অইছে তোরা কি দ্যাখছস মানিক্কা করছে ?
ওরা কোন কথা বলল না ।
কিরে কথা কছ না ক্যা ?
তারপরও ওরা চুপ করে থাকল।
" গরিব বইলা সবাই মানিকেরে দোষ দেছ । যদি স্কুলের হেড মাষ্টার পোলাডারে না দেখত, তাইলে মাইনষে এতদিনে ওর হাড্ডি গুড্ডি এক কইরা ফালাইত। আরে, এই গ্রামের কথা বাদ দিলাম ,আশেপাশে দশটা গ্রামে মানিকের মত পোলা কয়ডা আছে ক দেহি ? জানি দেখাইতে পারবি না । প্রত্যেক বছর পরিক্ষায় ফাষ্ট কে অয় ? আমাগো মানিক্কা "
যাদের গাছের কলা চুরি হয়েছে সে বলল " সারাদিন দুইন্নার শয়তানি কইরা রাইতে মাত্র এক ঘন্টার মত পড়ে এতেই ফাষ্ট অইয়া যায় । কি মেধারে বাবা !
আরেকজন বলল "এই তাড়াতাড়ি থুক ফেল নইলে নজর লাইগ্যা যাইব। "
আমরা সবাই এক সাথে থু থু ফেলতে লাগলাম। এরপর পর প্রায় সময় মানিক ভাইকে দেখতাম আমার স্কুলে যাওয়া আসার পথে । কখনও গাছের ডালে বসে কিছু খাছ্ছে । কখনও খেলাধুলা করছে, কখনও মাছ ধরছে । তখন জৈষ্ঠ মাস । ডোবা ও পুকুরের পানি প্রায় শুকিয়ে গেছে । আমাদের বাড়ীর পাশে এক পুকুরের সব পানি সেচা হল । আমরা গ্রামের বড় ছোট সবাই হাত দিয়ে মাছ ধরছি । পুকুরের এক পাশে জংলা মত একটা জায়গা আছে । সেদিকে কেউ যাছ্ছে না । কারন সবাই জানে সেখানে সাপ আছে । তাও যেই সেই সাপ না ! বিষাক্ত পদ্ম গোখরা সাপ ! ওদিকে মাছ থাকলেও কেউ যাছ্ছে না । আমি মাছ ধরতে ধরতে কখন ওদিকে চলে গেছি নিজেও জানি না । হঠাৎ ফোঁস আওয়াজ শুনে চিৎকার করে দৌড় দিলাম । আমার এত কষ্ট করে ধরা মাছ সব ছিটকে পুকুরে কাদায় পড়ে গেল। আমার চিৎকার শুনে মাছ ধরা রত সবাই থমকে গেল । মনে করল আমাকে সাপে কামড়েছে। আমি ভয়ে দৌড়াতে যেয়ে জংলা জায়গাটার সামনে কাদায় পা আটকে তখন পড়ে গেছি। ভয়ে হাঁচড়ে পাঁচড়ে উঠতে যেয়ে বার বার পড়ে যাছ্ছি । সাপের ভয়ে আমাকে ধরার জন্য কেউ এগিয়ে এল না । শুধু মানিক এল। সে এসে আমকে দাড় করাল ।
" এই মাইয়া এত ডরাস ক্যা।
সাপে কামড় দিছে ?
তখন ভয়ে আমার দুই চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। মাথা নেড়ে না বললাম।
ও এবার আমাকে ছেড়ে দিয়ে জংলার কাছে এগিয়ে গেল। ওকে জংলার দিকে এগিয়ে যেতে দেখে সবাই চিৎকার করে নিষেধ করল। কিন্তু কে শোনে কার কথা । ও আস্তে আস্তে এগিয়ে গিয়ে হঠাৎ ভিতরের দিকে হাত দিয়ে ঝটকা মারল। সাথে সাথে দেখি ওর হাতে প্রায় চার-পাঁচ হাত লম্বা গোখরা সাপ মোচড়াছ্ছে । মানিকের ডান হাতের মুঠায় সাপের মাথাটা শক্ত করে ধরা । ভয়ে মাছ ধরা রত দুই একজন বাদে সবাই পুকুর ছেড়ে পাড়ে উঠে গেল। আমিও যে কখন পাড়ে উঠে গেছি নিজেও জানি না । মানিক সাপটাকে নিয়ে পাড়ে উঠে বিলের দিকে গিয়ে আস্তে করে সাপটাকে ছেড়ে দিল । সাপটাও মাটির ষ্পর্শ পেয়েই একেবেকে চলে গেল। ও আবার পুকুরে নামার পর সবাই বলতে লাগল " তুই সাপটারে মারলি না কেন ?"
" সাপ আমাগো উপকার করে হের লিগা মারি নাই । তয় যদি মাইয়া ডারে কামড় দিত তহন মাইরা ফালাইতাম। "
আমি আর সেদিন মাছ ধরিনি । বারবার শুধু মনে হছ্ছিল মানিক ভাইয়ের কি সাহস ! কত্ত বড় সাপটাকে এক ঝটকায় ধরে ফেলল ।
আমি বাড়িতে এসে মাকে ঘটনাটা বললাম । মা ঘটনা শুনে অবাক গেলেন। এরপর আমি মাকে বললাম " মা আমি নলকূপে যাই, গোসল কইরা আসি ।
আমি গোসল করে ফিরে এসে দেখি মা মাছ কুটছে । সদ্য তাজা মাছ দেখে মাকে বললাম " মা মাছ কই পাইলা ?
" মানিক দিয়া গেছে । কইল ওর মায়ে পাডাইছে ।
আমি অবাক হয়ে গেলাম, ওর মা আমার মাকে কি ভাবে চিনে যে মাছ পাঠাবে ।
" ওর মা কি তোমারে চিনে ? "
মা মাছ কুটা ক্ষ্যান্ত দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বলল " চিনবা ক্যা ? মানিকের মা আমার বাল্যকালের সাথী । "
এর কয়েকদিন পর এক শুক্রুবার মা আমাকে বললেন আইজকা বিকালে তোরে লইয়া আমার সাথীর বাসায় যামু । ঘরে থাকিস।
সেদিন বিকালে আমি আর মা মানিক ভাইদের বাসায় বেড়াতে গেলাম । গ্রামের একবারে শেষ মাথায় মানিক ভাইদের বাড়ি । গাছগাছালি ঘেরা পাখির কলরবে ভরা , নিকানো উঠানে সুন্দর একচালা বাড়ি । আমরা উঠানে পা রাখতেই মানিক ভাইয়ের মা দৌড়ে এল।
"কিরে সই তুই কারে নিয়া আইলি ? "
এই বলে আমার দুই গালে চুমু দিয়ে আমাকে কোলে তুলে নিল । আমি কিশোরী হলেও দৈহিক গঠন বাড়ন্ত হওয়ায় আবার নামিয়ে দিলেন।
" ডাঙ্গর হইয়া গেছস ।"
আমি আর মা ঘরে ঢুকলাম । ভিতরে ঢুকতেই পিছনের দরজা দিয়ে বাইরে পিছনের উঠান দেখা যায়। সেখানে মানিক ভাই একটা বাঁশের বানানো খাচায় বন্দি একটি ধান শালিকের বাচ্চাকে আদার খাওয়াছ্ছে । আমি সেদিকে এগিয়ে গেলাম । পিছনে উঠানে নামতেই দেখলাম উঠানের মধ্যেখানে বাঁশের মাচার কবুতরের টং ( বাসা ) । সেখানে অনেক কবুতর । উঠানে কিছু গাছের ডালে কিছু বাকবাকুম করছে ।
আমি মানিক ভাইয়ের সামনে এসে দাড়ালাম । সে আমার দিকে না তাকাল না । পাখির বাচ্চাটাকে আদার খাওয়ানোর পর খাঁচায় রেখে আমাকে প্রশ্ন করল " কখন এসেছিস ? "
" এইত এখন । মানিক ভাই তোমার এখানে এত কবুতর কইথ্থিকা আনছ ? "
" কিছু বাজার থিকা কিছু বন্ধুগ থিকা ।"
কবুতরগুলির নাম কি ? এই যে লেজডারে ময়ুরের পেখমের মত ছড়াইয়া রাখছে ।
" এইডার নাম ময়ুরী । "
" কাউয়ার মত গলাডা ফুইল্লা রইছে ঐডার নাম কি ? "
" ঐডা বহুত দামি কবুতর । নাম পিনবল । '
মানিক ভাই এর মাঝে ঘরে বেড়ার সাথে ঠেস দিয়ে রাখা কয়েকটা বড়শির ছিপ থেকে একটা তুলে নিল ।
" কই যাইবা ?"
" মাছ ধরতে । তুই যাবি ? "
' যামু । মারে কইয়া আহি ।"
" খালাম্মারে কইলে আর যাইতে অইব না । তাইলে তুই থাক ।"
" ঠিক আছে কমু না । চল।
আমরা দুইজন বাড়ির পিছন দিয়ে নাল জমিতে নেমে গেলাম তারপর কিছু দুর একটা ছাড়া ভিটার ভিতর দিয়ে জংগলে প্রবেশ করলাম। জগংলটা ছোট ছিল ওটা পার হতে বেশিক্ষন লাগল না । জংগলের পরেই কবরস্থান তারপর খাল। কবরস্থানটা অনেক পুরানো । এখন এখানে লাশ দাফন করে না । আগে যখন গ্রামে কলেরা বা বসন্ত হত তখন এখানে ঐসব লাশ দাফন করত। কবর স্হানে প্রচুর বিশাল বিশাল গাছ । এই গাছগুলোর কখনও ডাইনে কখনও বায়ে পাশ কেটে খাল পাঁড়ে এসে আমরা পৌছলাম । খালটা মোটামুটি বড় ধরনের । পানিতে তেমন একটা স্রোত নাই। জোয়ার-ভাটা হয় তবে বোঝা যায় না । মনে হয় পানি সব সময় এক রকম থাকে । এই রকম খালে প্রচুর মাছ থাকে । মানিক ভাই সুবিধা মত একটা জায়গা দেখে বসে পড়ল। তারপর সাথে আনা পলিথিনের মুখ খুলে জ্যান্ত কেচো বের করে বড়শীতে গেথে পানিতে ছেড়ে দিল । আমি মানিক ভাইয়ের পাশে বসে খালের অপর পাড়ে মানুষের আনাগোনা দেখতে লাগলাম । কিছুক্ষনের মধ্যে মানিক ভাই দশ -পনরটা কই আর শোল মাছ ধরে ফেলল । সেগুলো সাথে আনা বেতে টুকরির ভিতর রাখল । হঠাৎ আমি বললাম " মানিক ভাই আমরে দাও আমি কয়েকটা ধরি ।
আমার কথায় সায় দিয়ে মানিক ভাই বলল " পারবি ? পারলে ল । আমি খালে নাইম্মা পাড়ের ফুটের মধ্যে হাতাইয়া দেখি কোন মাছ পাই কিনা, ""
মানিক ভাই আমাকে ছিপটা দিয়ে লুংগী কাছা মেরে খালে নেমে গেল।
এই সময় আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলাম ঈশান কোন লাল হয়ে আসছে ।
" মানিক ভাই তুফান আইব মনে অয় । "
মানিক ভাই মাছ ধরা অবস্থায় পিছন ফিরে ঈশান কোনে তাকাল ।
" হরে ঠিক কইছস । চল আর মাছ ধরনের দরকার নাই । তুই না থাকলে আমি যাইতাম না । "
এই বলে মানিক ভাই পানি থেকে উঠে গেল । তাড়াতাড়ি সব কিছু গুছিয়ে নিতে লাগল । ইতি মধ্যে ঝড়ো বাতাস শুরু হয়ে গেছে।
চলবে.....।
সম্পূর্ন কাল্পনিক ।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা মে, ২০১৪ রাত ১০:৩১