ঠাকুরগাঁওয়ের প্রিয়জিত মল্লিক বিয়ে করেন খুলনার মেয়ে অদিতিকে। বিয়ের তিন বছর যেতে না যেতেই প্রিয়জিত তার স্ত্রীর প্রতি অবহেলা করতে থাকেন। এক পর্যায়ে অদিতিকে স্ত্রীর মর্যাদা দিতেই অস্বীকৃতি জানান। অদিতি চেষ্টার কোনো ত্রুটি করেন না স্বামীর মন জোগাতে। এভাবে কাটতে থাকে সময়। এ দিকে রাজধানী ঢাকার জিগাতলা নিবাসী প্রশান্ত চৌধুরী ও মিনা চৌধুরীর একমাত্র ছেলে সাগর চৌধুরী তার স্ত্রী সুবর্ণা চৌধুরীকে নিয়ে বিদেশে যেতে চাইলে অ্যাম্বাসি তাদের কাছে বিয়ের প্রমাণপত্র চাইলে তারা বিপদে পড়েন। অদিতি আর সাগর-সুবর্ণা দম্পতির মতো হাজারো হিন্দু নারীর দুর্বিষহ সমস্যার কথা আমাদের অনেকেরই অজানা। হিন্দু আইনে বিয়ে, বিয়ে রেজিস্ট্রেশন, হিন্দু নারীর সম্পত্তির অধিকার, স্বামীপরিত্যক্তা নারীর অধিকার, বিধবা নারীর সম্পত্তির অধিকার, হিন্দু কন্যার অধিকার প্রভৃতি বিষয় বহু যুগ থেকে সমাজ-সংস্কারকদের আলোচনার বিষয় হলেও কার্যত তা প্রত্যাশিতভাবে সফল হয়নি। বেশির ভাগ হিন্দু ধর্মাবলম্বী এ ধরনের সংস্কারের বিপক্ষে থাকলেও এ বিষয়ে জোরালো কোনো ভূমিকা পালন করেনি কোনো ব্যক্তি, সংগঠন বা সংস্খা। প্রিয় পাঠক, আসুন আমরা বিদ্যমান হিন্দু আইনে নারীর কিছু ক্ষমতার চিত্র সম্পর্কে ধারণা লাভ করি। বিধবা স্ত্রীর অধিকার : ১৯৩৭ সালে সম্পত্তির ওপর হিন্দু নারীর স্বত্বেবর আইন পাস হওয়ার পর থেকে মৃত ব্যক্তির পুত্রদের সাথে বিধবা স্ত্রীও সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবেন। অবশ্য তিনি সীমিত মালিকানায় সম্পত্তির অধিকারী হবেন। এ আইন প্রবর্তিত হওয়ার পর থেকে মৃতের বিধবা, মৃত পুত্র, মৃত পৌত্র ও মৃত প্রপৌত্রের বিধবা স্ত্রীরা সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হন। মেয়ের সম্পত্তির অধিকার : মৃত ব্যক্তির পুত্র, পৌত্র, প্রপৌত্র ও বিধবা স্ত্রী না থাকে সে ক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তির কন্যাদের মধ্যে অবিবাহিত কন্যা ও পরে পুত্রবতী ও পুত্রসম্ভবা কন্যারা সম্পত্তি পান। উল্লেখ্য, কোনো মৃত ব্যক্তির পুত্র, পৌত্র, প্রপৌত্র, বিধবা স্ত্রী, কন্যা যদি জীবিত না থাকে সে ক্ষেত্রে দৌহিত্র (মেয়ের ছেলে) সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়। কারা নারীর সম্পত্তির অধিকারী : হিন্দু আইনে সম্পত্তির অধিকার তাকে দেয়া হয়েছে যিনি মৃত ব্যক্তির পিণ্ড দিতে পারেন। বাংলাদেশে প্রচলিত দায়ভাগ আইনে পাঁচজন নারীকে সম্পত্তির উত্তরাধিকারিণী করা হয়েছে। এর মধ্যে বিধবা স্ত্রী, কন্যা, মা, পিতামহী ও প্রপিতামহী। এ অধিকার তারা জীবদ্দশা পর্যন্ত ভোগ করতে পারেন। কোনো নারী এ সম্পত্তি আইনসঙ্গত ও বৈধ কারণ ছাড়া বিক্রি, দান বা কোনোরূপ হস্তান্তর করতে পারেন না। বিধবার সম্পত্তি কী : হিন্দু আইনানুযায়ী স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রী তার সম্পত্তি পাওয়ার অধিকারী হন। এ সম্পত্তিকে বিধবার সম্পত্তি বলে। বিধবা যত দিন বেঁচে থাকবেন তত দিন সম্পত্তি ভোগ করতে পারবেন, বিধবার মৃত্যুর পর সম্পত্তি স্বামীর উত্তরাধিকারীদের কাছে চলে যায়। স্বামীর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া ও শ্রাদ্ধকাজ, মৃত স্বামীর বকেয়া রাজস্ব ও ঋণ পরিশোধ, মৃত স্বামীর ব্যবসায় চালু রাখতে গিয়ে ঋণগ্রস্ত হলে তা পরিশোধের জন্য, তার পোষ্য ব্যক্তিদের ভরণপোষণ ও অবিবাহিত কন্যা, পৌত্রী ও প্রপৌত্রীদের বিয়ের খরচের জন্য বিধবা স্ত্রী ওই সম্পত্তি বিক্রি করতে পারেন। ভরণপোষণ : হিন্দু আইনের বিধান হচ্ছে একজন হিন্দু পুরুষ তার সামর্থ্য থাক আর না থাক স্ত্রী, নাবালক পুত্র, অবিবাহিত কন্যা, বৃদ্ধ পিতা ও মাতাকে ভরণপোষণ দিতে বাধ্য, নাবালক পুত্র এবং অবিবাহিত কন্যার বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত পিতা কন্যার ভরণপোষণের জন্য আইনত এবং নীতিগতভাবে বাধ্য, কন্যা সাবালিকা হলেও এ দায়িত্ব বহাল থাকবে। পিতার মৃত্যুর পরও পিতার সম্পত্তি থেকে অবিবাহিত কন্যা ভরণপোষণ পাবে। কোনো কন্যা নি:সন্তান অবস্খায় বিধবা হলে এবং তার স্বামীর সম্পত্তি থেকে ভরণপোষণের কোনো ব্যবস্খা না থাকলে বাবা নীতিগতভাবে ওই কন্যারও ভরণপোষণের ব্যবস্খা করবেন। একইভাবে পিতা-মাতা, স্ত্রী ও বিধবা স্ত্রী ভরণপোষণ পাওয়ার অধিকারী। বিয়েবিচ্ছেদ : বাংলাদেশে হিন্দু আইনে বিয়েবিচ্ছেদ হয় না। তবে কোনো পক্ষ ১৯৪৬ সালের বিবাহিত নারীর পৃথক বাসস্খান ও ভরণপোষণ আইনের অধীনে মামলা দায়ের করে আদালতের রায়সাপেক্ষে একে অপরের কাছ থেকে পৃথকভাবে বসবাস করতে পারেন। স্বামীর কাছ থেকে আলাদা থেকেও স্ত্রী স্বামীর কাছ থেকে ভরণপোষণ যথারীতি পাবেন। হিন্দু আইনে বিয়ে রেজিস্ট্রেশন সময়ের দাবি। বিভিন্ন কারণে নববিবাহিত হিন্দু দম্পতিরা মনে করেন সব বাধা-প্রতিকূলতা দূর করে হিন্দু বিবাহে রেজিস্ট্রেশনের ব্যবস্খা চালু করা অতীব জরুরি হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশে হিন্দু আইনের সংস্কার ও সংশোধন প্রসঙ্গে জাতীয় হিন্দু মহাজোটের মহাসচিব গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক বলেন, হিন্দু আইন সংশোধনের চেয়ে নির্যাতিত হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা অধিকতর জরুরি। তিনি বলেন, দেশ স্বাধীনের পর তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা হিন্দুদের সম্পত্তি কেড়ে নেয় এবং শত্রু সম্পত্তি আইনের অপপ্রয়োগ করে। তিনি বলেন, হিন্দু আইনের সংশোধন এবং সংস্কার প্রয়োজন হলে হিন্দু ধর্মীয় নেতারা আলোচনা করবেন। কিন্তু বর্তমানে কিছু এনজিও এ প্রসঙ্গে অতিরঞ্জিত ও বাড়াবাড়ি করছে মর্মে তিনি উল্লেখ করেন। গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক আরো বলেন, হিন্দু আইনের উৎপত্তি বা উৎস না জেনে এনজিওগুলোর কর্মতৎপরতা শুভ নয়। অ্যাডভোকেট নির্মল চন্দ্র রায় চৌধুরী বলেন, হিন্দু আইন সংশোধন বা সংস্কারের নামে ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে এনজিওগুলো। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন থেকে চলে আসা হিন্দু আইনের কিছু বিষয় সংশোধন করার প্রয়োজন হলে তা অবশ্যই করা উচিত। তবে তা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের দাবি হতে হবে। ঠাকুরগাঁওয়ের হিন্দু ধর্মীয় নেতা অ্যাডভোকেট ইন্দ্রনাথ রায় বলেন, হিন্দু বিয়ের রেজিস্ট্রেশন করা সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। তিনি বলেন, হিন্দু আইন সংশোধন বা সংস্কার করতে হলে একটি জাতীয় কমিটি বা কাউন্সিল করতে হবে। এতে হিন্দু ধর্মীয় নেতা, আইনজীবী ও সরকারের প্রতিনিধির সমন্বয়ে হতে পারে। এ কথা সত্যি যে, সময়ের চাহিদাকে অস্বীকার করা যাবে না। যুগ পরিবর্তনের সাথে সাথে প্রথা আর স্খানীয় সংস্কৃতির ওপর নির্ভরশীল হিন্দু আইনের সংস্কার নিয়ে ভাবার সময় এখনি। প্রয়োজন শক্তিশালী হিন্দু আইন, যা হিন্দু নারী-পুরুষের অধিকার রক্ষায় সহায়ক হবে। হিন্দু নারীর অধিকারের বিষয়টিকে অধিকতর গুরুত্ব দিতে হবে। পাশের দেশ ভারতে যদি সময়ের প্রয়োজনে হিন্দু আইনের সংস্কার হতে পারে তাহলে বাংলাদেশে তা সম্ভব নয় কেন
সুত্র: http://wordpress.com