‘আগামীকাল ভোর ছয়টায় পাবলিক লাইব্রেরীর সামনে আমি সাবিনাকে নিয়ে থাকবো তুমি তার আগেই ওখানে থাকবে’ । কথাটা ব’লেই গ্রন্থ আজকের মতো চলে গেলো বাসায় । মাহাবুব হাসান তৃপ্ত মনে একটি সিগারেটে আগুন ধরায় আর মনে মনে বলতে থাকে আহা, বৈশাখ তুমি কেন ঘনঘন আসো না ?
১৯৯৮ সালের এমনই এক বৈশাখে মাহাবুব হাসানের সাথে গ্রন্থ সরকারের হৃদয় বিনিময় হয় । বিনিময়টা এমন যে, কোন কিছুই তাঁদের কাছে কঠিন মনে হয়না, কোন কিছুই বিনিময়ে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনা তাঁদের সামনে । যদিও বেশ গোপনীয়তা রক্ষা করেই চলছিল ওরা । তবুও মাঝে মাঝে বিনিময় রক্ষা করতে যেয়ে ওরা দেখতে পায় কেউ কেউ, কিছু কিছু ব্যাপারে বাধা হয়ে সামনে দাঁড়িয়ে ওদের স্মরণ করিয়ে দিতে চায় যে- যাই করো না কেন ধর্মীয় দূরত্ব বজায় রেখে চলাই ভালো ।
কারো কারো এমন কথায় ওরা কর্ণপাত করেনি আবার প্রতিবাদও করেনি; কারণ কিছু মানুষ আছে যারা চিরকালই প্রেম ভালোবাসার বিরুদ্ধতা করে থাকে । এমনকি নিজ সম্প্রদায়ের হলেও । আর এখানেতো বিষয়টা সম্পূর্ণ ভিন্ন; সামাজিক, এবং রাষ্ট্রীয় অবস্থা বিবেচনায় ।
বাইশ আর ছাব্বিশের দুর্নিবার মানসিক শক্তি ওদেরকে দেয় পরাজিত না হবার মন্ত্র, তাছাড়া মন আর মানসিকতায় ওরা অনেক অনেক আধুনিক যা এতদিন দেখে পায়নি শিক্ষিত, উচ্চশিক্ষিত, এক সময় আধুনিক পরে প্রতিক্রিয়াশীল মানসিকতায় রূপান্তরিত হয়ে যাওয়া কোন কোন মানুষের মাঝে !
প্রেম, ভালোবাসার আকর্ষণ অতি তীব্র । মারাত্মক এর গঠনতন্ত্র । অনেক সময় তাকে ভাঙতে গেলে ভেঙে যায় হাতুড়িটা; তার বুকে ছুরি বসাতে গেলে বেঁকে যায় সেই ছুরিও !
গ্রন্থ আর মাহাবুব দেখে তাঁদের সম্পর্কের মাঝে দিনদিন বাধার উৎপাত বেড়েই চলেছে । ভাগ্যিস ঢাকা শহরে আছে বলেই এখন পর্যন্ত ফতোয়ার কবলে পড়েনি ওরা । গ্রামে থাকলে কী হতো ? ভাবলেই গা শিউরে ওঠে দু’জনেরই । নিটোল প্রেম, অসামান্য ভালোলাগা, ভালোবাসায় ওরা প্রতিটি মুহূর্ত পেরিয়ে যায় জগতের যাবতীয় অসুখ-বিসুখ । ‘‘কে বলেছে ভালোবাসা ধর্ম দিয়ে বিচার করা হয় ? কে বলেছে অসম প্রেমের সফল সমাপ্তি বন্ধ করতে পারেনা রক্তের ঝর্ণাধারা ? আমি তুমি ঘুচিয়ে দেবো সকল ব্যবধান । ব্যক্তি থেকে ব্যক্তির মাঝে, সম্প্রদায় থেকে সম্প্রদায়ের মাঝে এমন কী সমাজ রাষ্ট্রেরও । আমাদের পরিচয় হবে এক এবং একমাত্র মানুষ হিসেবে কোন জাত-পাত, সম্প্রদায় হিসেবে নয়’’ । কথা গুলো মাহাবুব বলছিল দৃপ্ত কণ্ঠে গ্রন্থকে । তার সঙ্গে সুর মিলিয়ে গ্রন্থ মানবতার গানকে টেনে নিয়ে নিয়ে যায় দূর থেকে বহুদূর ।
খালি ঘর, মোমের আলোতে সন্ধ্যার মুহূর্ত জায়গা করে নিয়েছে গভীর রাতের আবহ । ওরা ভেসে যায়, ওরা মিশে যায় ওরা ছুঁয়ে যায় গভীর থেকে আরো গভীরে । পৌঁছে যায় এমন এলাকায় যেখানে ঘৃণা, হিংসা আর অহংকারের কোন জায়গা নেই । জায়গা আছে কেবল তীব্র অনুভব আর অনুভূতির । মিলনই যেখানে মৌলিক । গ্রন্থ আর মাহাবুব একে অন্যকে চুমোতে চুমোতে ভরিয়ে তোলে । কেউ নেই, কোন বাধা নেই । ওরা এখন আদিম গুহাবাসী । পৃথিবীর যাবতীয় সুখ এখন ওদের ঠোঁটে, ওদের চোখে, ওদের হাতের দশ আঙুলে !
মাহাবুব কোনদিন চাঁদ ছুঁয়ে দেখেনি তবে আজ ছুঁয়ে দেখে শুধু চাঁদের সৌন্দর্যই নয় সুগন্ধও; তবে এর রূপ ও গন্ধ আরো মোহনিয়া আরো তীব্র । গ্রন্থ কোনোদিন সূর্য ছুঁয়ে দেখেনি, তবে আজ ছুঁয়ে দেখতে গিয়ে রীতিমতো ঝলসে যায় সে; ঝলসে গিয়ে নিজেকে পুনঃস্থাপন করে নিজেই । চাঁদ আর সূর্যের এক মহামিলন, এক অভূতপূর্ব দৃশ্য ও তার সৌন্দর্য ! এমন সুখ এবং সৌন্দর্য পৃথিবীর আর কোথায় আছে ? প্রশ্ন করে গ্রন্থ মাহাবুবকে । মাহাবুব হাসে, হেসেই একটা সিগারেটে আগুন ধরায় ।
বেশ চলে যাচ্ছিল দু’জনের । দুই হাজার সালের মাঝা মাঝিতে গ্রন্থ এবং মাহাবুব বুঝতে পারে তাঁদের সম্পর্কের বিরোধিতা করছে প্রায় সবাই । কিছু বন্ধু বান্ধব ছাড়া তাঁদের এই সম্পর্ককে কেউ স্বীকৃতি দিতে চায়না । মাহাবুব বুঝতে পারে পেরোতে হবে বহুপথ রক্তাক্ত হয়ে । গ্রন্থ বুঝে যায় ওর ফ্যামিলিতে কেউ সাপোর্ট করবেনা শুধু রাঙা ছাড়া । মাহাবুবের অবস্থা ঐ একই । ভাই বোন ছাড়া সবাই মোটামুটি বিরুদ্ধ অবস্থানে দাঁড়িয়ে গেছে এতদিনে । তবুও ওরা এগিয়ে যায় হাতে হাত রেখে । পেরিয়ে যায় এমন আরো অজস্র গোপন সন্ধ্যা, সুখকর মুহূর্ত গুলো । এর সবকিছুই গ্রন্থ প্রতিদিন তাঁর ডায়েরীতে দিনলিপির অংশ হিসেবে লিখে রাখত ।
একদিন মাহাবুব আর গ্রন্থ নিজেদেরকে আবিষ্কার করে রাষ্ট্রীয় প্রতিপক্ষ হিসেবে । দুই পরিবারই থানা পুলিশ পর্যন্ত করে ফেলে ! অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে গ্রন্থ মাহাবুব বনাম ধর্ম, গ্রন্থ মাহাবুব বনাম সমাজ, গ্রন্থ মাহাবুব বনাম রাষ্ট্র !
২০০১'র ভোর সাড়ে পাঁচটায় পাবলিক লাইব্রেরীর সামনে পৌঁছে যায় মাহাবুব । চারপাশে মানুষের ঢল এই ভোরেও । বেশ লাগে মাহাবুবের । আনন্দে মন ভরে ওঠে তাঁর । এমন দিনের অপেক্ষায় সারা বছর কাটে মাহাবুবের । অহিংস এক জাতীয় অনুষ্ঠান বলেই ওর কাছে মনে হয় । সকল ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে মানুষের এই একাত্মতা ওকে মুগ্ধ করে । এখানে কেউ হিন্দু নয়, কেউ মুসলমান নয়, কেউ খ্রিষ্টান বা বৌদ্ধ নয় । এইদিনে অন্তত সবাই আগে মানুষ তারপর অন্যান্য কিছু ,যদি বিবেচনা করা হয় ।
ছয়টার কিছু আগেই সাবিনার সাথে পৌঁছে যায় গ্রন্থ পাবলিক লাইব্রেরীতে । সাবিনা গ্রন্থকে মাহাবুবের কাছে রেখে ও চলে যায় শিহাবের সাথে । মাহাবুব আর গ্রন্থ কিছুক্ষণ বসে থেকে চারুকলায় কিছুটা সময় কাটিয়ে সাতটার মধ্যেই পৌঁছে যায় রমনা উদ্যানে । ওখানে বর্ষবরণের অনুষ্ঠান হচ্ছে সূর্যোদয়ের পর থেকেই ।
ওরা দুজন মিশে যায় গানের সুরে । ভাবনায় আজ কেবল বৈশাখ, কণ্ঠে সুন্দর আর সম্প্রীতির অবগাহন আর ঠিক তখনই তাঁদের থেকে প্রায় বিশ মিটার দূরত্বে বিকট শব্দে কেঁপে ওঠে গোটা এলাকা । গ্রেনেড হামলায় তছনছ হয়ে যায় সবকিছু । রক্ত আর লাশ পড়ে থাকে সকালের স্নিগ্ধ সবুজ ঘাসের উপর । সবার রক্তই লাল, সবারই পরিচয় এই মুহূর্তে মানুষ । কোন ভাবেই চিহ্নিত করা যাচ্ছেনা রক্ত দেখে কে কোন ধর্মের ।