চাকুরীর মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই অনেকটা বাধ্য হয়েই অবসর নিয়ে নেয় কমলগঞ্জ কে বি পাইলট হাই স্কুলের ইংরেজির সিনিয়র সহকারী শিক্ষক মাহাতাব উদ্দিন । স্কুলের কাজে শিক্ষাবোর্ডে আসতে গিয়ে এক সড়ক দুর্ঘটনায় মারাত্মক আহত হয়ে অনেকদিন হাসপাতালে ভর্তি ছিল মাহাতাব । জমানো টাকা যা ছিল তার সবটা চিকিৎসা ব্যয়েই চলে যায় উপুর্যপুরি স্ত্রীর গহনা বন্ধক দিয়ে টাকা জোগাড় করতে হয়েছিল । সেই সময় স্কুলের নিজস্ব তহবিল থেকে নামমাত্র অর্থ সহযোগিতা মিললেও তা ছিল করুণারই নামান্তর । তাঁর এমন খারাপ সময়ে পাশে খুব কাছের আত্মীয় স্বজনরা ছাড়া আর কেউ ছিল না ।
মন ব্যথায় ভরে উঠেছিল মাহাতাবের । সুস্থ হয়ে ফিরে সরাসরি চাকুরী থেকে স্বেচ্ছায় অবসরের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন ।
ফিরে আসবার সময় কেউ একটিবারও জিজ্ঞেস করেনি কেন চাকরি ছেড়ে দিচ্ছেন, এক তাঁর কিছু ঘনিষ্ঠ সহকর্মী ছাড়া । স্কুল কমিটির কেউ এসে সমবেদনা জানায়নি । এমন কি হাসপাতালে গিয়ে একটি মুহূর্তের জন্যে দেখে আসবার প্রয়োজন বোধ করেনি কেউ !
কথা গুলো ভাবলেই চোখের কোণে অনাহূত জল ঝাপসা করে দিয়ে যায় চারপাশ । তখন নিজেকে খুব অসহায় লাগে মাহাতাবের । ধিক্কার দিতে ইচ্ছে করে নিজেকে এই পেশাটি কেন বেছে নিয়েছিল এই মনে করে । যেদিন চলে আসে শেষবারের মতো স্কুল থেকে, সেদিন প্রিয় ছাত্র ছাত্রীরা ঘিরে ধরে ছিল তাঁকে । কেউ কেউ কান্নায় ভেঙে পড়েছিল । সে এক আবেগঘন মুহূর্ত । নিজেকে সেদিন সামলাতে পারেনি মাহাতাব । নয়ন জলে বুক ভাসিয়েছিল । অনেক সহকর্মীর চোখও ভিজে উঠেছিল সেদিন ।
মাহাতাব এখন বাড়িতে টিউশানি করে চলে । আয় বলতে এখন এটিই । ইংরেজির শিক্ষক হলেও ছাত্র ,ছাত্রী বেশি নেই । এখন চারপাশে অনেক শিক্ষক, গড়ে ওঠা কোচিং সেন্টার; তাই আগের দিনের মতো ছাত্র ছাত্রীরা কোন নির্বাচিত শিক্ষকের উপর নির্ভরশীল নয় । তাদের ইচ্ছায়ও কিছু হয়না । মা-বাবা তাঁদেরকে বেছে দিচ্ছেন শিক্ষক, কোচিং সেন্টার গুলো । এখন যে শিক্ষক বাঙলা পড়ায় সে-ও সমাজ বিজ্ঞান, ইতিহাস পড়িয়ে কামাই দ্বিগুণ করে নিচ্ছে । যে গণিতের শিক্ষক সে সাথে ইংরেজিটাও পড়িয়ে দিচ্ছে । মানের প্রশ্ন আগে নয় পরে । টু ইন ওয়ান অথবা থ্রি ইন ওয়ান ! অভিবাবকেরা চায় চাকচিক্য । ভেতরে কি আছে আর সন্তানেরই বা কতটুকু উপকারে আসবে তা যাচাই বাছাই না করে ছুটে যাচ্ছে এই পথে ।
ছাত্র ছাত্রী কম তবুও নিষ্ঠার সাথে পড়িয়ে যায় মাহাতাব । টিউশানির টাকায় সংসার চালাতে রীতিমতো হিমশিম খেয়ে যায় সে । অবসরসুবিধার টাকার জন্য আবেদন করেছে আজ প্রায় দুই বছরের উপরে কিন্তু হাতে টাকা আসেনি । কিছুদিন পরপর খোঁজ নিতে রাজধানীতে যায় কিন্তু ফিরে আসে আশাহত হয়ে। নিজের টাকা চায়তে গিয়ে রীতিমতো হয়রানির শিকার ।
মাহাতাব উদ্দিনের সংসার চলে কোনমতে । খেয়ে পড়ে সমান । তবুও আশা অবসরসুবিধার টাকা তুলে কিছু একটা করে খাবে । স্বপ্ন দেখতে থাকে মাহাতাব । এর মাঝেই বড় মেয়ের বিয়ের সম্বন্ধ আসে । নীলাকে দেখতে এসে ছেলে পক্ষের খুব পছন্দ হয়ে যায়। বিয়ের তারিখ পাকা করতে পারেনা মাহাতাব । কেমন করে পাকা করবে ? হাতে যে কোন টাকা নেই । সময় চায় ছেলে পক্ষের কাছ থেকে । সময় দ্রুত ফুরায়, বিয়ের তারিখও আর পাকা করতে পারেনা । একসময় পাত্র পক্ষ আর অপেক্ষা করেনা । অর্থাভাবে বিয়ের তারিখ পাকা করতে না পেরে কষ্টে বুক ভারি হয়ে যায় মাহাতাবের । জীবনে এমন সংকট দেখা দেবে তা কোনদিন ভাবেনি । জীবনের প্রতি কেমন যেন মায়া হারিয়ে ফেলে ।
যখন একা থাকে তখন তাঁর ভাবনায় আসে শুধু হতাশা আর হতাশা । মনে পড়ে দাদা’র কথা। মাহাতাব যখন ক্লাস নাইনে প’ড়ে তখন দাদা বলেছিলেন বড় হয়ে যেন মাহাতাব শিক্ষকতার পেশায় যোগ দেয় । অনেক সম্মান শিক্ষকতায় । অনেক মহৎ একটি পেশা এটি । এমনটিই বলত দাদা । মানুষ গড়ার কারিগর মানুষের মনে আলো জ্বালে । সমাজকে আলো দেয় এমন কথা বলে মাহাতাবের ভেতরে তোলপাড় করে দিত দাদা । মাহাতাবও স্বপ্ন দেখত বড় হয়ে একদিন সে শিক্ষক হবে । হয়েছেও তাই । যদিও দাদা শুনে যেতে পারেনি, দেখে যেতে পারেনি নাতির স্বপ্ন, সফলতার কথা । মাহাতাবের মেধা অনুযায়ী সে অনায়াসে অন্য কিছু হতে পারত শিক্ষক না হয়ে ।
নীলার বিয়ের বয়স যদিও পেরিয়ে যায়নি তবুও মাহাতাব উদ্দিন ও তাঁর স্ত্রী চেয়েছিল ভাল সচ্ছল পাত্রের হাতে মেয়েটিকে তুলে দিতে । আরও কিছুদিন পর আরেকটি সম্বন্ধ আসে এবং যথারীতি নীলাকে পাত্র পক্ষের পছন্দ হয়ে যায় । এবার মাহাতাব কোন কিছু চিন্তা, ভাবনা না করেই বিয়ের তারিখ পাকা করে ফেলে । পড়ে তাঁর স্ত্রী বলে- ‘’কি হল তোমার কেমন করে জোগাড় হবে এত টাকা ?’’
মাহাতাব উত্তর দেয় না বেরিয়ে পড়ে ঘর থেকে । ছুটে যায় বাধ্য হয়েই এলাকার সিরাজ মিয়া কাছে, যে সুদে টাকা ধার দেয় । সিরাজ মিয়ার কাছ থেকে টাকা পেতে হলে কিছু না কিছু গচ্ছিত রাখতে হয় । শুধু মুখ দেখে, সম্পর্কের খাতিরে টাকা দেবার মতো লোক নন সিরাজ । কিন্তু মাহাতাবের ক্ষেত্রে কিছুটা নমনীয়তা প্রদর্শন করে । শিক্ষক তাছাড়া একজন ভাল মানুষ বলে সিরাজ মিয়া ছাড় দেয় । মাহাতাব সোনা গহনা নয় সিরাজ মিয়ার কাছে গচ্ছিত রেখে আসে সারা জীবনের সম্মান ।
নীলার বিয়ের দিনই ঢাকা যেতে হয় মাহাতাবকে অবসরসুবিধার টাকা তোলবার জন্য । মাহাতাব আর তাঁর স্ত্রী’র মুখে হাসি ধরা দেয় অনেকদিন পর । আজ বেশ লম্বা সময়ের পর বাড়িটি আনন্দে,হইচইয়ে মুখতির হয়ে উঠে । মাহাতাবের মনটা খারাপ হয়ে যায় মেয়ের বিয়ের দিন উপস্থিত থাকতে পারবেনা বলে । কিন্তু কিছুই করার নেই । যেতেই হবে-যায়ও । মাহাতাব উদ্দিনের ঢাকা যাবার আগে এর ওর কাছে সব দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে যায় যাতে করে কোন অসুবিধা না হয় । বিয়ে সুষ্ঠু ভাবেই সম্পন্ন হয় । কথা ছিল বিকেল নাগাদ বাড়ি পৌঁছে যাবে মাহাতাব কিন্তু বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয় হয় ভাব কিন্তু পৌঁছে না ।
দুপুর থেকে মাহাতাবের মোবাইলে কল করে বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে । বাড়িতে বিয়ের আনন্দে অনেকেই ভুলে যায় মাহাতাব উদ্দিনের কথা । কিন্তু, মেয়ে নীলা আর তার মা অধীর অপেক্ষায় থাকে মাহাতাবের ফিরে আসবার । বিয়ে শেষে কনের বিদায়ের মুহূর্তে দূর থেকে একটি এম্বুল্যান্সের শব্দ ভেসে আসে । ঘড়ির কাঁটা যত এগিয়ে যায় শব্দটি তত কাছে আসতে থাকে । মুহূর্তের মধ্যে এম্বুল্যান্সটি মাহাতাবের বাড়ির গেটের বাইরে এসে থামে যেন সকল সমাপ্তির প্রতীক হয়ে ।
এম্বুল্যান্সের গায়ে ‘লাশবাহি’ লেখাটি দেখে সবাই কেঁপে ওঠে । মাহাতাবের স্ত্রীর পায়ের নীচে যেন মাটি সরে যায় । মুহূর্তেই অনাবিল আনন্দের শব্দ গুলো বাতাসে মিলিয়ে গিয়ে নামিয়ে আনে বিউগলের করুণ সুর । অপেক্ষার অবসান ঘটে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার ভেতর দিয়েই ।