শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সদ্য নিয়োগ প্রাপ্ত কর্মকর্তা বিভাস । মেধাবী, একসময় মানবিক চরিত্রের অধিকারী বিভাস এখন আর মানবিকতার ধারে কাছেও নেই । স্কুল, কলেজ এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে স্নাতক পর্যন্ত এই গুণটি ধরে রেখেছিল সে । সহপাঠী, শিক্ষকরা ওর সৎ চরিত্রের গুণগান গাইত । জীবনে কোন রাজনৈতিক দলের সমর্থক ছিল না । রাজনীতি বেশ অপছন্দের একটি বিষয় ছিল ওর কাছে । স্নাতকোত্তর শেষ না করেই বেরিয়ে যায় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে । পারিবারিক অর্থ দৈন্যতা ছিল সারাজীবনের সঙ্গী । ছাত্রাবস্থায় টিউশনি করেই চালাত লেখাপড়ার খরচ । বিভাগের শিক্ষকদের প্রিয় ছাত্র বিভাস পাল্টে যায় শিক্ষা বিভাগে চাকুরী পাওয়ার পর থেকেই ।
বাবা মারা যাবার পর থেকে ও বুঝতে পেরেছে এই পৃথিবীর মানুষেরা কতটা স্বার্থপর, কতটা নির্মম, অমানবিক । সম্পর্কের খাতিরে কেউ কেউ হয়ত পাশে থেকেছে তবে সেই সম্পর্কের মাঝে বিভাস কোনদিন আন্তরিকতা দেখেনি । কোন সহমর্মিতা পায়নি কারো কাছ থেকে । সম্পর্ক বরাবরই স্বার্থ সংশ্লিষ্ট; একমাত্র বাবা মায়ের সাথে সম্পর্ক ছাড়া । নিজের ভাই, বোনটি পর্যন্ত আজকাল সম্পর্ক ধরে রাখে স্বার্থের জন্য !
বিভাস ভেবে পায়না এই একমুখী জীবনে এত জটিলতা কেন । ক্ষণিকের জীবনে মানুষ এত স্বার্থপর এত আবেগহীন, প্রেমহীন হয় কেমন করে ।
বিভাস বুঝে উঠবার পর থেকেই স্বপ্ন দেখে এসেছে একটি সুন্দর, সচ্ছল, পরিচ্ছন্ন জীবনযাপনের । সেই জীবনে থাকবে আবেগের স্ফুরণ, অসীম ভালোবাসা, কাতর প্রেম- প্রেমিকার সাথে প্রেমিকের, মানুষের সাথে মানুষের । কিন্তু বিভাসের মানবিক গুণাবলিকে, দারিদ্রতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে শেমন্তি হয়ে যায় বিত্তবান চরিত্রহীন শুভ্রের ঘরনি । আর বিভাস মানবিকতাকে বোতল বন্দী করে নষ্ট হবার প্রস্তুতি নেয় । বিভাস এখন কারোর নয়, কেউ বিভাসের নয় । ও এখন সম্পূর্ণ এক নতুন মানুষ । নতুন পোশাকে নিজেকে সাঁজিয়ে বসে থাকে ন’টা পাঁচটার সরকারী অফিসে ।
একদিন মাকিদ যায় ওর অফিসে এক দরকারি কাজে । বলে- ‘বিভাস আমার ছোট বোনটির একটি চাকরি হবার পথে বিদ্যাসাগর বালিকা বিদ্যালয়ে কিন্তু দুই লাখ চাচ্ছে । তুই যদি বলে দিস একটু সহজ হয়ে যায়’ । ‘’কিছু মনে করিস না মাকিদ, হবে কিন্তু অন্তত এক লাখ টাকা লাগবে । বাকিটা আমি ম্যানেজ করে নেব’’ । কষ্ট পায় মাকিদ, ফিরে আসে ।
স্কুল জীবনের খুব প্রিয় শিক্ষক গৌরাঙ্গ রায় কেমন করে খোঁজ নিয়ে পৌঁছে যায় বিভাসের অফিসে । ষোল বছর পর দেখা বিভাসের সাথে । কিন্তু কি আশ্চর্য এখনো ঠিক সেই পুরনো দিনের মতোই বেশ মায়াবী কণ্ঠে কাছে এসে ডাক দেয়- ‘মানু কেমন আছ ?’ পরিবর্তন শুধু তুই থেকে তুমি । একমাত্র গৌরাঙ্গ রায়ই বিভাসের অজানা, অচেনা নামটি জানতো । কেমন করে আজ আর তা মনে পড়েনা । ‘মানু, শহরে এসেছিলাম চোখের চিকিৎসা করাতে । একটা দরকারি কাজেও। আজকাল খুব একটা ভাল দেখিনা চোখে । এই জীবনে তোমার সাথে আর দেখা হবে কিনা জানিনা তাই খোঁজ নিয়ে তোমার কাছে আসা । ছেলেটাকে খুব কষ্ট করে মানুষ করেছি । ওর একটা চাকরি খুব দরকার । ওর জন্যে সেইসাথে আমাদের জন্যও । আর পারি না বাবা’ ।
বিভাস বলে হবে স্যার কিন্তু... কথাটি বলেই থেমে যায় । ‘কিন্তু কি মানু ?’ ‘’কিছুনা স্যার, আমি দেখছি । বিভাস এই একটি জায়গায় এসে প্রচণ্ড ভাবে বিবেকের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হয় । মনে পড়ে এই প্রিয় শিক্ষকেরই শেখানো একটি কথা। বহু বছর আগে যিনি বলেছিলেন- ‘মানু, দান করে কোনদিন প্রতিদানের আশা করবিনা । তাতে দানের মাহাত্ম্য, সৌন্দর্য দুটিই নষ্ট হয়ে যায়’। কথাটি ভাবতেই বিভাসের ভেতরের বিভাস নতুন পোশাক পড়া বিভাসকে পূর্বের বিভাসে ফিরে আসবার তাগাদা দেয় যেন !