somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

প্রাচীন বাংলার মুন্সীগঞ্জ - একটি ঝটিকা সফর

০৯ ই জুন, ২০১২ সকাল ১০:৫২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

- মুন্সীগঞ্জ !!!
- সেখানে কিছু দেখার মত, ঘোরার মত কি আছে ভাই !!!
- অইখানে তো খুব ভালো আলুর চাষ হয়, তাইনা !!! আলু খেতেই যাচ্ছিস তো !!!

আজ্ঞে না।

আমার জানামতে ঢাকার ধারেকাছে ওই একটা জায়গাই আছে (নারায়ণগঞ্জ বাদে), যেখানে গেলে মনে পড়ে যায় স্বাধীন সুলতানী আমলের কথা, মনে পড়ে বৌদ্ধ গুরু আতীশ দীপঙ্কর আর প্রাচীন বাংলার সমৃদ্ধ জনপথের কথা, মনে পড়ে হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে এদেশে আসা আরব সুফীদের কথা, যারা আলোকিত করেছিলেন সারা বাংলাকে।

ইন ফ্যাক্ট, গুলিস্তান থেকে পঞ্চাশ টাকার টিকেট কেটে ঢাকা ছাড়িয়ে নদীর পাশ দিয়ে দিয়ে ভাঙ্গা রাস্তায় যখন আমরা লাফাতে লাফাতে যাচ্ছিলাম, উপরের শোনা প্রশ্নগুলো মনকে আবারো কিঞ্চিত দুর্বলই করে দিচ্ছিলো। তবে চমৎকার রোদমুক্ত আবহাওয়া আর নদীর ভেজা বাতাসে কনফিডেন্স আবার ফিরে এলো। কি আছে কপালে, দেখাই যাক না !

ইদ্রাকপুর কেল্লার প্রবেশপথ

জেলা শহর হিসেবে মুন্সীগঞ্জ যথেষ্টই উন্নত, অন্তত ইনফ্রাস্ট্রাকচারে। রাস্তাঘাটগুলোও চমৎকার। আমরা নামলাম একটা চৌরঙ্গী টাইপের জায়গায়। সকালের নাস্তা হয়নি, ফেরদৌস মামা হনহন করে একটা মিষ্টির দোকানে ঢুকে গেলো। সে ইদানিং আইনের পড়াশুনা কমিয়ে দিয়ে দর্শন পড়া শুরু করেছে। দোকানটায় বাবা লোকনাথ ব্রম্মচারী, মসজিদে নববী আর কাবা শরীফের ছবি পাশাপাশি টাঙ্গানো। সেক্যুলারিজম নিয়ে বোরিং আলোচনা শুরু হতে না হতেই পরোটা খেয়ে টেয়ে আমরা দৌড়।
প্রথম গন্তব্য ইদ্রাকপুর কেল্লা। সুবাদার মীর জুমলা চারশো বছর আগে কি জিনিস বানিয়ে গেলেন দেখার জন্য রাস্তাঘাটের লোকজনকে জিজ্ঞেস করলাম, কেউই বলতে পারে না কোথায়। অবশেষে শহরের কাচারী মোড়ে সন্ধান পাওয়া গেলো কেল্লার। আর তার অবস্থাও তথৈবচ। পোড়ো বাড়ির মত, মোটা পাচিলে ঘেরা জায়গাটার কোন আলাদা অ্যাট্রাকশন নেই। ভেতরে একটা বিশাল দোচালা ঘর, টালির চাল। কড়ি বর্গা সব ভেঙ্গে পড়েছে। যাক, তবুও তো দুর্গ, মুঘল কেল্লা বলে কথা !

ইদ্রাকপুর কেল্লা - নির্মাণকাল ১৬৬০

এরপর আমরা একটা অটো ঠিক করলাম, শহরের আশপাশ মিলিয়ে চার-পাচটা স্পট ঘুরবো, সাড়ে তিনশো টাকা। কোথায় কোথায় যাবো যখন নামগুলো বলছিলাম, অটোড্রাইভার অবাক হয়ে বলল - ভাই এইগুলান জায়গার নাম জানলেন ক্যাম্নে !!! হু ! সামুতে জহির ভাইয়ের ব্লগ আর জেলা তথ্য বাতায়নের সাইট ঘেটে এসেছি আমরা, সেটা আর না ভেঙ্গে একটা সবজান্তা টাইপের ভাব নিয়ে যাত্রা শুরু !

মদীনা থেকে আগত বারো আউলিয়ার মাজার

প্রথম স্টপ কেওয়ার গ্রাম। সদর থানার মহাকালী ইউনিয়নের এই গ্রামে আছে হাজার বছরের পুরনো শেখ দ্বার আল বলখী (রঃ) এর মাজার। লোকেমুখে সেটা হয়ে গেছে শিকদার সায়েবের মাজার। এই গ্রামটাতে বেশ অনেক অলী-আউলিয়ার মাজার রয়েছে দেখা গেলো। আরো কিছুটা এগোতেই বারো আউলিয়ার মাজার। এটাও হাজার বছরের পুরনো; খোদ মদীনা থেকে বারো জন মহান আউলিয়া এসেছিলেন এখানে। পর পর দু’টো দুর্ঘটনায় এখানকার লোকজন একটু ঝামেলায় আছে। গত সাতদিন আগে এই মাজারে একটা ডাকাতি হয়। লোকেরা যে দান বা নজর-নিয়াজ পাঠায়, সেই সিন্দুক লুট হয়ে গেছে। আর তার দু’দিন পরেই এই মাজারের প্রধান খাদেম স্ট্রোক করে মারা গেছেন (হয়তো সেই শোকেই !!!)। সব মিলিয়ে কেমন একটা মূহ্যমান অবস্থা। শতাব্দি প্রাচীন একটা তেতুল গাছ ছায়া দিয়ে রেখেছে আল্লাহর দ্বিনের এই অকুতোভয় সৈনিকদের। তার পাশেই একটা পুরনো বিশাল পুকুর। শুনশান নীরবতা আর চারপাশের আলুখেতের মাথা ছুয়ে ছুয়ে আসা মিষ্টি বাতাস.................. পুকুর পাড়ে আমরা বসে রইলাম বেশ কিছুক্ষন।

এরপরের স্টপ বজ্রযোগিনী গ্রাম। এই গ্রামেই অষ্টম শতাব্দিতে জন্ম নেন বৌদ্ধ ধর্মগুরু অতীশ দীপঙ্কর। তার জন্মস্থানটির নাম এখন পন্ডিতের ভিটা। সেখানে চীন সরকার একটা স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করে দিয়েছে ২০০৬ সালে। সমতল এই চিরাচরিত গ্রামীণ বাংলার পরিবেশে চাইনিজ প্যাটার্নের টেম্পল আর ড্রাগনের মূর্তি কেমন যেন একটু বেমানান মনে হয় ! অতীশ দীপঙ্কর এখানে জন্মলাভ করেছিলেন বটে, কিন্তু সেখান থেকে তিনি চলে যান তিব্বতে এবং সেখানেই মোক্ষ লাভ করেন। একটা অফ টপিক - চাইনিজদের সব কিছুই আমার ভালো লাগে............ শাওলিন টেম্পলের মার্শাল আর্ট থেকে শুরু করে চাইনিজ খাবার-দাবার, তাদের দুর্দান্ত টেকনোলজী আর পরিশ্রম করার মানসিকতা, কিন্তু ওই তিব্বতের উপর ছড়ি ঘোরানোটা খুবই অপছন্দের। পুরো তিব্বতকে নিষিদ্ধ করে রেখেছে তারা, স্রেফ সাম্রাজ্যবাদী নীতি থেকে।

পন্ডিতের ভিটা - অতীশ দীপঙ্করের জন্মস্থান

পন্ডিতের ভিটা থেকে এরপর দরগা বাড়ী। মসৃণ পিচঢালা সরু রাস্তা, পথেই পড়ল বিশাল সুখবাসপুর দীঘি। স্থানীয় লোকেরা বলে সুভাসপুর। বিশাল দীঘি, বরষার পানি টলটল করছে। শীতকালে নাকি এখানে প্রচুর অতিথি পাখি আসে। মীরকাদিম পৌরসভায় একদম মেইন রাস্তার সাথেই দরগা বাড়ী। এতে আছে বাবা আদম শহীদের মাজার, আর একটা মসজিদ। সেন রাজা বল্লাল সেনের সাথে এই সুফী মুজাহিদ বাবা আদম (রঃ) আঠারো দিন ধরে যুদ্ধ করছিলেন। একদিন যুদ্ধের মাঝখানে নামায পড়তে দাড়ান তিনি, আর তখনই বল্লাল সেন তাকে নিজ হাতে হত্যা করেন। তার স্মরনে বানানো মসজিদটাও খুব সুন্দর, মজবুত স্ট্রাকচার। লোকে বলে, মসজিদটির ভিত্তি নির্মাণ করে দিয়েছিল দুইটি জিন।

বাবা আদম শহীদের মসজিদ


ধলেশ্বরীর বুকে আমরা, দূরে মুক্তারপুর ব্রীজ

মুন্সীগঞ্জ চ্যাপ্টার এবারের মত ক্লোজ করে আমরা চলে আসলাম মুক্তারপুর, ধলেশ্বরীর ঘাটে। নদীর পাড়ে একটা হোটেলে আমি আর ফেরদৌস মামা ধলেশ্বরীর বেলে মাছের টেস্ট নিলাম, দাঈম যথারীতি মুরগী আর ফ্রায়েড চিকেনে অভ্যস্ত জাকি ভাই ভাত স্পর্শ না করে আবারো পরোটা দিয়েই কষ্টে মস্টে চালিয়ে নিলেন। ঝালে ঝোলে গলদঘর্ম, নদীর ভেজা বাতাস আর ভেসে চলা নৌকা লঞ্চ দেখতে দেখতে খাওয়া শেষ, নদীতে নৌকা নিয়ে যাত্রা শুরু। ওপারেই নারায়ণগঞ্জ। সেখান থেকে পঞ্চবটি হয়ে নারায়ণগঞ্জ শহর। এখানে পুরাকীর্তি আছে দু’টি - হাজীগঞ্জ কেল্লা আর বিবি মরিয়মের মাজার, নূন্যতম টুরিস্ট আকর্ষণের মতও কিছু নেই এখানে। তবুও সংক্ষেপে ঘুরে ফিরে দেখে নিলাম। পাশেই শীতলক্ষ্যা নদী। ওপারের নবীগঞ্জ ঘাট আর এপারের হাজীগঞ্জ ঘাট - অসংখ্য লোক খেয়া পারাপার হচ্ছে বিরামহীন ভাবে। মজার ব্যাপার হলো সবগুলো নৌকাই দেখলাম বৈঠা টানা, ইঞ্জিন বোট নেই। ৫ই জুন তো পরিবেশ দিবস, তারই মান রাখতেই সম্ভবত খোলা আকাশ, হু হু করে বয়ে চলা বাতাস আর আশে পাশের অসংখ্য মানুষ (ইনক্লুডিং মহিলা) সবকিছু ছাপিয়ে জাকি ভাই আর ফেরদৌস মামা মূত্র বিসর্জনের মাধ্যমে শীতলক্ষ্যাকে ধন্য করে দিলেন !!! :P:P

হাজীগঞ্জ কেল্লা

বিবি মরিয়মের মাজার

শহরের চাষাড়া স্টেশন থেকে লোকাল ট্রেনের ছয় টাকার টিকেট কেটে আমরা নামলাম কমলাপুর। প্রচন্ড ভিড়ের মধ্যে আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম এক পায়ে, আর তার মধ্যে মামা শুরু করলেন রসালো আলোচনা। (বিষয় সেক্যুলারিজম, নারী এবং রাজনীতি) যাক, নেহায়েত পয়তাল্লিশ মিনিটের জার্নি বলে তাড়াতাড়িই মুক্তি পেলাম :p

শীতলক্ষ্যায় খেয়া পারাপার চলছে অবিরাম

একদিনের ট্যুর হিসেবে পদ্মা-মেঘনা-ধলেশ্বরী নদীঘেরা এই প্রাচীণ জনপদ একটি দুর্দান্ত জায়গা। প্রকৃতি আর পুরাকীর্তি............ সব মিলিয়ে বিক্রমপুর নামে ইতিহাসে সুপরিচিত এই জেলাটা আমাদের মনে দাগ কেটে গিয়েছে গভীরভাবে.........।।

সময় পেলে ঘুরে আসুন !!!
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই জুন, ২০১২ সকাল ১০:৫৬
১৩টি মন্তব্য ১৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৩২



জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন

এখানে সেরা ইগো কার?

লিখেছেন শূন্য সারমর্ম, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪






ব্লগারদের মাঝে কাদের ইগো জনিত সমস্যা আছে? ইগোককে আঘাত লাগলে কেউ কেউ আদিম রোমান শিল্ড ব্যবহার করে,নাহয় পুতিনের মত প্রটেকটেড বুলেটপ্রুফ গাড়ি ব্যবহার করে।ইগো আপনাকে কোথায় নিয়ে গিয়েছে, টের পেয়েছেন... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবং আপনারা যারা কবিতা শুনতে জানেন না।

লিখেছেন চারাগাছ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮

‘August is the cruelest month’ বিশ্বখ্যাত কবি টিএস এলিয়টের কালজয়ী কাব্যগ্রন্থ ‘The Westland’-র এ অমোঘ বাণী যে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এমন করে এক অনিবার্য নিয়তির মতো সত্য হয়ে উঠবে, তা বাঙালি... ...বাকিটুকু পড়ুন

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

মার্কিন নির্বাচনে এবার থাকছে বাংলা ব্যালট পেপার

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:২৪


আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বাংলার উজ্জ্বল উপস্থিতি। একমাত্র এশীয় ভাষা হিসাবে ব্যালট পেপারে স্থান করে নিল বাংলা।সংবাদ সংস্থা পিটিআই-এর খবর অনুযায়ী, নিউ ইয়র্ক প্রদেশের ব্যালট পেপারে অন্য ভাষার সঙ্গে রয়েছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×