আকস্মিক এই ব্ল্যাকআউটের জন্য আমার নাগরিক জীবন একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। উত্তরায় আমার সেক্টরে খুব একটা বিদ্যুৎ ইদানীং যায় না বলে মোমবাতি কেনা কবেই বন্ধ করেছি। চার্জারেও এখন মিয়ানো আলো। আর স্মার্টফোন তো সুখের পায়রা, আধুনিক প্র্রেমের মত। স্ট্যাটাসের খাতিরে একটা পুষতেই হয়, কিন্তু কাজের সময় ও জিনিসের পাত্তা থাকে না। তাই, তেনাকে আগেই বন্ধ করে রেখে দিয়েছি। এখন এই অপ্রত্যাশিত অসীম অবসর কী করে কাটাব সেটাই ভেবে পাচ্ছিলাম না।
এই অন্ধকারে শুয়ে থাকতে থাকতে অনেকরকম অভিজ্ঞতা হল। মশাগুলো ঘণ্টাখানেক আগেই হুল ফোটানো বন্ধ করেছে। এখনো আসছে, গায়ে বসছে। কিন্তু সেটা অনেকটাই নিয়মরক্ষার্থে। এখন আমি বিনা আয়াসেই ওদের মারতে পারছি। কেবল হাতটা ওদের শরীরে ছোঁয়ালেই ওরা নতিস্বীকার করছে, আমার রক্তে টইটম্বুর করা শরীরটাকে আমার হাতেই শেষ হতে দিচ্ছে। শিকার তাড়া করার মধ্যে একটা সুখ আছে। সে মশাই হোক, বাঘই হোক, আর মানুষই হোক। অথচ আমি এবং আমার তথাকথিত শত্রু –উভয়পক্ষই সেই সুখ থেকে বঞ্চিত। এই অন্ধকারে আমারই রক্তে ভারি হয়ে ওঠা ওদের বিড়ম্বিত শরীর নিয়ে ওরা ভারি বিপদে আছে- শেষ হওয়ার অপেক্ষায় প্রহর গুনছে যেন। তাই এই হার মানা শিকারকে মারার আমারও বিশেষ তাগিদ নেই।
রাত আনুমানিক ৯টা। আমার মধ্যবিত্ত অন্ধকার ঘরের জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে কয়েকটা উচ্চবিত্ত ঘরের জানালা দিয়ে ভেসে আসা জেনারেটরের আলো। সে আলোয় না আছে উষ্ণতা, না আছে প্রয়োজনীয় আলো। অনেকটা মিল্টনের নরকবর্ণনার মত- নরকের অন্ধকার কতটা দুর্বিষহ হতে পারে সেটা বোঝাতে ভদ্রলোক বলেছিলেন, “কোথা থেকে এমন এক চিলতে আলো ভেসে আসছে যার ফলে অন্ধকার আরো ঘণীভূত হচ্ছে।“
সেই অসহ্য আলোর অপ্রয়োজনীয় ছটার দিকে তাকিয়ে আমি চুপচাপ শুয়ে আছি। সুনীলের সেই ‘কেউ কথা রাখেনি’ কবিতাটা মনে পড়ল। ওখানে বোধহয় বড়লোকের বাড়ির বাজির আলোর একটা বর্ণনা ছিল। বাচ্চা ছেলেটা সেই আলোর দিকে চেয়ে থাকত। লাইনগুলো ঠিকঠাক মনে পড়ছে না। আলো জ্বালিয়ে লাইনগুলো দেখে নেব সে উপায়ও তো নেই।
ইসস! এই ধরণের ভুলে যাওয়াটা একদম মানা যায় না। সঠিক সিচুয়েশনে সঠিক লাইনগুলো আওড়ে যাওয়ার মধ্যে একটা অদ্ভূত আনন্দ আছে। সে আনন্দ আমার কপালে কোনদিন জোটে না।
আচ্ছা, মৃত্যুশয্যায় যদি এমন হয়! আমার প্রিয় কোন কবিতার লাইন যদি তখন মনে মনে আবৃত্তি করতে ইচ্ছে করে! সেটা যদি না পারি! কাওকে জিজ্ঞেস করার মত বাকশক্তি যদি না থাকে! ইয়াক! অক্সিজেন মাস্ক পরা আমার মুখটা কল্পনা করতেই ভারি বিরক্ত লাগল। মৃত্যুর আগমুহুর্তে আমার উদগ্রীব চোখদুটো দেখে সেই মুহুর্তে পাশে থাকা প্রিয়জন ভাববেন, আমি হয়তো খুব জরুরী কিছু বলতে চাইছি! সন্তান-সন্ততি শ্রেণীর কেউ হলে নিশ্চয় ভাববে আমি কোন সম্পত্তির খোজ দিয়ে যেতে চাইছি! সে বেচারী ভাবতেও পারবে না, আমি কোন কবিতার লাইন হাতড়াচ্ছি। নিজের মৃত্যুমুহুর্তের সেই উপায়হীনতা কল্পনা করতে গিয়ে নিজেই শিউরে উঠছি।
না বাবা, দরকার নেই এমন উপায়হীন মৃত্যুর। কাল থেকেই কবিতা মুখস্থ করে রাখতে হবে। আমার মৃত্যু হোক আমার প্রিয় কবিতাগুলোকে নিয়ে। স্মৃতিহীনতায় নয়, আমার মৃত্যু হোক-একরাশ স্মৃতি নিয়ে। মানুষগুলো যদি পাশে নাও থাকে, তবু আমার স্মৃতির বোতামে চাপ দিলেই যেন পাই সব্বাইকে একসাথে।