প্রদর্শনী শুরুতেই ক্যাথরীন মাসুদ এসে তারেকের এক্সিডেন্ট, কি কি দেখানো হবে আর প্রচারের অনুরোধ নিয়ে ৪/৫ লাইন বল্লো। প্রথমেই দেখানো হচ্ছে "একুশ" নামক একটি ভিজুয়াল ডকুমেন্টারী ক্লিপ। ২১শে ফেব্রুয়ারীতে শহীদমিনারে শ্রদ্ধা জানাতে আসা মানুষের ঢল, হেলিকপ্টার থেকে বিভিন্ন এংগেল থেকে দেখানো হয়। নিচ থেকে মিনার দেখতে অভ্যস্ত আমাদের জন্য এটা একটা মজার অভিজ্ঞতা বটে।
ছোট ক্লিপটি শেষ হবার সাথে সাথেই শুরু হয় নরসুন্দর। '৭১ সালের ঘটনার প্রতিকী চিত্রায়ন এই স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রটি। টানটান উত্তেজনাময় কাহিনী, সিনেমাটোগ্রাফী, ক্যামেরার কাজ আর সাউন্ড সব মিলিয়ে মনে হবে আপনি এই দাড়িওয়ালা নায়কের সাথেই পুরোটা সময় জুড়ে আছেন। এছাড়া মুভিতে মুজাহীদ ও গোলাম আজমের রেডিও বার্তা শোনানোর মাধ্যমে বুঝিয়ে দেয়া হয় '৭১ এর দেশদ্রোহী কারা ছিলো।
এরপর শুরু হয় ৯০ মিনিটের ফিচার ফিল্ম রানওয়ে। কাহিনী ২০০৫-০৬ সালের, বাস্তব। মূল চরিত্র রুহুল যে থাকে এয়ারপোর্টের রানওয়ের পাশে, দাদা-মা-ছোট বোন সহ। বাবা মিডেল ইস্টে গেছে কিন্তু অনেকদিন ধরে কোনো খবর নাই। মাদ্রাসায় ১০ম শ্রেনী পর্যন্ত পড়া রুহুলের জীবন কাটে হতাশায়। ছোটবোন গার্মেন্টসে কাজ করে আর মা মাইক্রো ক্রেডিট লোন নিয়ে গরুর দুধ বিক্রি করে সংসার টানলেও রুহুল কোনো কাজ জুটাতে পারে না। যদিও সে মামার সাইবার ক্যাফেতে গিয়ে টুকটাক কম্পিউটার শিখার চেষ্টা করে।
তো একদিন মামার শিখানো মত ইন্টারনেট এক্সপ্লোরার দিয়ে ওয়েব পেইজ খুলছে না দেখে তার পাশে বসা আরিফ ওকে দেখায় দেয় কিভাবে মোজিলা ফায়ারফক্স দিয়ে আরো সুন্দর ভাবে নেট ব্রাউজ করা যায় ( )। রুহুলকে আরো কিছু টিপস শিখানোর পর আরিফের বন্ধু হয়ে যায় রুহুল। এরা প্রায়ই একসাথে সময় কাটায় এবং রুহুলের অলস মস্তিষ্ক কাজে লাগিয়ে তাকে আল্লাহর রাস্তায়(!!) নেয়ার চেষ্টা করে। "জীবনের মানে কি? বেদায়াতী ও বেশরীয়তী কাজে বাধা দিয়ে ইসলামের আইন কায়েম করা - এটাই প্রত্যেক মুমিনের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য স্থির করে কাজ করে যেতে হবে" - এইভাবে ভুংভাং বুঝিয়ে জংগী ট্রেনিংএ রুহুলকে নিয়ে যায়।
ছবি - ওরা জংগী ট্রেনিংএ একটা নদীর চরে যাচ্ছে। যাওয়ার সময় এই মহিলার বিলবোর্ড দেখে হুজুরগুলা নাউজুবিল্লাহ বলতে থাকলেও বিলবোর্ড থেকে চোখ সরায় না
এরপর এরা বাংলাদেশে বোম ফুটানো শুরু করে। আরিফ ছিনেমা হলে বোম ফুটায়। রুহুল জিজ্ঞাসা করে, যদি ওখানে তোমার মা-ছোট বোন থাকতো? আরিফ বলে তাদেরকেও মরতে হবে! কেননা তারা সাচ্চা মুসলিম হলে অবশ্যই ছিনেমা হলে যেত না!
এরপর রুহুল দ্বিধায় পড়ে যায়। সত্যের রাস্তা খুজতে গিয়ে সে অদ্ভূত অন্ধকার এক রাস্তা খুজে বের করে যেখানে চোখের বদলে চোখ তুলে ফেলাটাই নিয়ম।
বাকি কাহিনী আর বল্লাম না... ৫০ টাকা দিয়ে হলে গিয়ে দেখে নিয়েন।
এই মুভির কয়েকটা দৃশ্য মাথা খারাপ করে দেয়ার মত। প্রথমেই বলতে হয় রানওয়েতে দাড়িয়ে প্লেনের দিকে তাক করে এক পিচ্চির গুলতি মারা। গুলতি মেরে ঘুরে দাড়িয়ে সে যেই কটমটে ক্ষোভওয়ালা লুক দেয় - প্রাইসলেস!! মনে হবে এক ঢিলেই দুনিয়ার সব পুজিবাদীদের মাটিতে মিশিয়ে দিবে।
আরেকটা ছিলো, রুহুল যখন পুকুরের পানিতে উদাস হয়ে তাকিয়ে থাকে, পানিতে রুহুল-আকাশ-মেঘের প্রতিবিম্ব পড়ে। ঠিক তখনই প্রতিবিম্বের মধ্যে দিয়ে একটা প্লেন যায়। আরেকটা দৃশ্যে রুহুলকে তার মা গরুর দুধ দিয়ে মুখ ধুইয়ে দেয়। ভাগ্যক্রমে মুভি শেষ হবার পর বাইরে রুহুলকে (ফজলুল হক) পেয়ে যাই। উনাকে জিজ্ঞাসা করে দৃশ্যটার অর্থ মিলিয়ে নিলাম। এটা একটা প্রতিকী দৃশ্য, মুভি দেখলে আপনারা আরো ভালো বুঝতে পারবেন।
সিরিয়াস কাহিনী হলেও যথেষ্ঠ হিউমার ছিলো। অভিনেতা-নেত্রীরা তথাকথিত তারকা না, দেখতেও সুন্দর না। মুখেও মেকাপ নাই। তারপরেও উনারা যথেষ্ট স্বতস্ফূর্তভাবে ডায়ালগ দিছে, অভিনয় করছে। অনেকগুলা ডায়ালগ ছিলো মজার এবং মনে রাখার মত। যেমন রুহুল যখন আরিফের উস্কানীতে ধর্মান্ধ হয়ে যায়, তখন এক বান্ধবীর সাথে ওর কথা হয়। কথা বলার সময় মাটির দিকে তাকিয়ে ছিলো রুহুল। তখন ঐ মেয়ে বিরক্ত হয়ে টিটকারী মারে, "অহন গলাতেও (voice) পর্দা দেওন লাগবো নাকি?"
ক্যামেরার কাজ উপভোগ করার মত। প্রতিটা ফ্রেমিং যেনো মিশুক মনীরের এক একটা কবিতা। তবে সবচেয়ে অবাক হইছি ৩টা ছবিরই কালার কোয়ালিটি নিয়ে। আজকালের বাংলা ছিনেমা বা নাটকের মত মুভি প্রিন্ট না। যথেষ্ট ইনটেনসিভ, ট্রু কালার এবং উন্নত মানের। পাশের দেশেও এত চকচকে প্রিন্টের মুভি বের করে বলে মনে হয় না। আর সাউন্ড কোয়ালিটিও সেরকম। ১৬:৯ রেশিও আর ডলবি ডিজিটাল ৫.১ এ বানানো রানওয়ের মেকিং দেখার মত বটে!
শুধু ভিজুয়াল ইফেক্ট না, রানওয়ের গল্প নিয়ে চিন্তা করার মতও অনেক কিছু আছে। ধর্মকে ব্যাবহার করে কিছু মানুষ যে সবসময়েই খারাপ কাজ করছে সেটা খুব সুন্দর করে বুঝায় দেয়া হইছে। মাদ্রাসা মানেই ধর্মান্ধ ফ্যানাটিক বোমারু না। উগ্র মৌলবাদী শক্তির উত্থান, বিস্তার লাভ , এদের আশ্রয়দাতা, কর্মপদ্ধতি সবকিছুই অত্যন্ত দক্ষতার সাথে তুলে আনা হয়েছে এখানে। এখান থেকে বের হবার সহজ রাস্তাটাও তারেক বলে দিছেন গল্পের মধ্য দিয়েই। শত জনসভা আর হাজারটা টক শো যা না করতে পারবে তা "রানওয়ে" একবারের প্রদর্শনীতেই পারবে।
ওদের ফেসবুক স্ট্যাটাস বলছে প্রতিটি শো হাউজফুল। "বাংলা" সিনেমা দেখার জন্য মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কেটে সিনেমা দেখতেছে। ৩টার শো-র টিকেট না পেয়ে ৫টার শো-র টিকেট কেটে পাবলিক লাইব্রেরীর সিড়িতে অপেক্ষা করতেছে মানুষ। তারেক বলতেন আমি মানুষের জন্য সিনেমা বানাই। কথাটা যে কতটা সত্য তা "রানওয়ে" না দেখলে বোঝানো যাবেনা।
আদমসুরত ছাড়া তারেক মাসুদের বাকি সব মুভি দেখা শেষ (রুহুল বলছে আদমসুরতের প্রদর্শনী নিয়ে উনাদের আপাতত কোনো পরিকল্পনা নাই)। উনার শেষ মুভি রানওয়ে দেখে বলতেই হয় উনি আস্তে আস্তে আরো পরিপক্ক হইতেছিলেন মুভি বানানোতে। এভাবে আরো কয়েকটা দিন বেচে থাকলে দেশটা হয়তো অস্কারে ভরে যেত না, কিন্তু আমার মত মুভি পাগলের চোখ ও মনের পূজো হতো, দেশের মুভি বানানোর ট্রেন্ড আরো আধুনিক হতো আর মুভি দেখে বিনোদনের পাশাপাশি কিছু শেখাও যেত।
তারেক মাসুদ আর মিশুক মনির মারা গেছেন এ খবরটা শোনার পর একবারও মনে হয়নি তাদের কতটুকু প্রয়োজন আছে আমাদের কাছে কিন্তু রানওয়ে দেখার পর বাকরুদ্ধ হয়ে ভেবে অস্থির হয়েছি "আমরা কাকে হারালাম"!
ধুরো.. এত ভালো একটা মুভি দেখার পর এসব ভেবে মনটাই খারাপ হয়ে গেলো
▼ রানওয়ে @ আইএমডিবি
▼ রানওয়ে @ ফেসবুক
▼ রানওয়ে অফিসিয়াল সাইট
▼ রানওয়ে ট্রেইলার