সাধারণ জ্ঞানঃ
Movie: Dhananjoy
Director: Arindam Sil
Cast: Anirban Bhattacharya, Arjaa Banerjee, Mimi Chakraborty....
Release: 11 August, 2017
Genre: Mystery, Drama
IMDB Rt: 8/10
সারা বছর বিভিন্ন ধরণের সিনেমা দেখি, পরে ওয়াচ লিস্ট মিলিয়ে হতাশও হই। হতাশ হওয়ার যথেষ্ট উপসর্গও আছে, হতাশ লাগে এ কারণে যে, ওয়াচ লিস্টে বাংলা সিনেমা থাকে হাতেগোনা কয়েকটা। ওপার বাংলায় ভালো ভালো কিছু বাংলা সিনেমা নিয়মিত বিরতিতে হলেও সেগুলোর সন্ধান পাই না ঠিকঠাক, ওয়েবসাইটে বাংলা সিনেমা পাই না, পেলেও কোয়ালিটি ভালো থাকে না, সিনেমার মাঝেমাঝে কলিকাতা হারবালের বিজ্ঞাপনের অত্যাচার... নানাবিধ যন্ত্রণা। এরকম আকালে "ধনঞ্জয়" সিনেমার খবর পেলাম। আর কী! কাজকর্ম নেই, বেকার মানুষ। সিনেমা দেখা শুরু করতে খুব বেশি সময় লাগলোনা। ইউটিউবেই আছে সিনেমাটি। শুধু "Dhananjoy" লিখে সার্চ করলেই হবে।
ভূমিকা শেষ। প্রধাণ প্রসঙ্গে আসি। সিনেমার কাহিনীটা অনেকটা এরকম- আঠারো বছরের এক মেয়েকে প্রথমে ধর্ষণ এবং পরে খুন করা হয়। এবং সে খুনের জন্যে একমাত্র অভিযুক্ত ছিলো "ধনঞ্জয়" নামের এক সিকিউরিটি গার্ড। পরবর্তীতে তাকে পুলিশ গ্রেফতার করে এবং চৌদ্দ বছর পরে তাকে ফাঁসি দেয়া হয়। ১৯৯০ সালে গ্রেফতার হয় সে, ২০০৪ সালে তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
কিন্তু এখানেই সিনেমা শেষ না। বরং এখানেই ঘটনার ঘনঘটা শুরু। ধনঞ্জয়ের ফাঁসির চার বছর পরে এই কেস রি-ওপেন করে কলকাতার দুই আইনজীবী। সশরীরে না হলেও অশরীরে অর্থাৎ "কাগজে-কলমে" ধনঞ্জয় আবার ফিরে আসে আদালতে, কাঠের কাঠগড়ায়।
কাহিনীও মোড় নিতে থাকে অপ্রত্যাশিতভাবে। বাকিটা...
বাকিটা নিজেই দেখে নিন।
প্রথমেই বলে রাখি, "ধনঞ্জয়" কৃত্রিম কোনো চরিত্র না, ধনঞ্জয় চ্যাটার্জী নামের এক মানুষ সত্যিই ছিলেন, বেঁচে ছিলেন ফাঁসির দড়ির একপ্রান্তে মৃত্যুর সাথে জীবনের সওদা করার আগপর্যন্ত। আগ্রহীরা গুগলে ঢুঁ মারলে ধনঞ্জয় সম্পর্কে আরো অনেক তথ্য পাবেন।
এ সিনেমাটি ভালো লেগেছে কয়েকটি আলাদা আলাদা কারণে।
প্রথম কারণ- সত্য ঘটনা (মার্ক টোয়েন বলেছিলেন -Truth is stranger than fiction, সেটা আরেকবার উপলব্ধি করলাম এ সিনেমা দেখে।)
দ্বিতীয় কারণ- অভিনয়। চলচ্চিত্রে প্রত্যেকের অভিনয় অসাধারণ এবং যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক ছিলো। টালিউডের আর্টফিল্মের দুঁদে সব অভিনেতা-অভিনেত্রীরা এখানে অভিনয় করেছেন। পরাণ বন্দোপাধ্যায়, কৌশিক সেন, অনির্বাণ ভট্টাচার্য, মিমি চক্রবর্তী, মীর আফসার আলী, কাঞ্চন মল্লিক... এমনকি এক ক্যামিও দৃশ্যে টালিউডের খ্যাতনামা পরিচালক কমলেশ্বর মুখার্জীও ছিলেন, এ সিনেমার পরিচালক অরিন্দম শীলের গলাও শোনা গিয়েছিলো সিনেমার এক অংশে।
মিমি চক্রবর্তীকে নিয়ে কিছু বলি। এ সিনেমায় দারুণ অভিনয় করেছেন তিনি। আমার ব্যক্তিগত মতামত- মিমির আর্টফিল্ম বা ভিন্ন ঘরানার সিনেমাগুলোই বেশি করা উচিত। "প্রলয়", "বোঝেনা সে বোঝেনা"...তে মিমি যেরকম সাবলীল "কাটমুন্ডু" বা "বাঙ্গালী বাবু ইংলিশ মেম"... টাইপের সিনেমাগুলোতে সে সেরকমই বেমানান। সবাইকেই কেন কমার্শিয়াল ক্রেজিনেস এর পেছনে ছুটতে হবে? এটা একটা বিরাট প্রশ্ন।
তৃতীয় কারণ- ছিমছাম স্ক্রিপ্ট। এ সিনেমার যে ম্যাটেরিয়াল, তাতে ইচ্ছে করলে কিন্তু আবেগের বিস্ফোরণ ঘটানো যেতো, সিনেমা শেষে কান্নার স্রোত বইয়ে দেয়া যেতো দর্শকদের মধ্যে... কিন্তু পরিচালক সে পথে মোটেও হাঁটেননি। উনি একটা গল্প বলতে চেয়েছেন, একটা সত্য গল্প, সেটা বলে গিয়েছেন আবেগহীন ভাবে। আবেগের অত্যাচার, ইমোশনাল টর্চার কিছুই ছিলোনা এখানে।
চতুর্থ কারণ- এই কারণটা একটু আলাদা। সিনেমাটা পুরোপুরিই কোর্ট-রুম ড্রামা। আইনের ছাত্র হওয়ায় এই সিনেমা দেখে অন্যরকম এক তৃপ্তি পেয়েছি। সবাই পাবেনা অবশ্য, মেডিকেল থ্রিলার যেমন মেডিকেলের স্টুডেন্টদের একটু বেশি ভালো লাগে, সেরকম খানিকটা। আমার সুবিধা ছিলো, আমি সিনেমার সাথে সাথে অনেকগুলো বিষয়কে রিলেট করতে পারছিলাম। ভালো লেগেছে।
পঞ্চম কারণ- টাইম ম্যানেজমেন্ট। সিনেমা দেখে আপনার কোনোভাবেই মনে হবেনা যে, এ সিনেমার কোনো অংশে কাহিনী ঝুলে গেছে। অষ্টাদশী তরুণীর টানটান ত্বকের মত এ সিনেমার শুরু থেকে শেষটা ছিলো একরকম, এক গতির। ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের হানিফ বাসের মতই রেকলেস, স্পীডি।
ষষ্ঠ কারণ- পরিচালকের বিচক্ষণতা। অনেক সিনেমাতেই দেখা যায়, পরিচালক দর্শকের চেয়ে এক ধাপ এগিয়ে থাকতে চান, সিনেমা শুরু করেন দুর্বোধ্যভাবে। দর্শককে বোকা বানিয়ে শেষে গিয়ে কাহিনী মিলিয়ে দেন। এ সিনেমায় পরিচালক সোজাসাপ্টা রাস্তায় হেঁটেছেন। প্রথমেই দর্শককে বুঝিয়ে দিয়েছেন, ঘটনায় ঘাপলা আছে। দর্শকের সাথে পরিচালকের ধ্যানধারণার এ মেলবন্ধন, দর্শককে সমান প্রাধান্য দিয়ে গল্প বলে যাওয়া... অসাধারণ।
এ সিনেমা দেখতে দেখতে আমার আরো কয়েকটা সিনেমার নাম মনে পড়ে যাচ্ছিলো। "Sarbjit", "Miracle In Cell No. 7", "Silenced", "Talvar"... সিনেমাগুলোর সাথে "ধনঞ্জয়" এর কিছু কিছু অংশ তীব্রভাবে রিলেট করা যাচ্ছিলো। সবখানেই তো শেষে হতাশা, এখানেও তাই।
মাঝেমধ্যে অবাক লাগে, শুধুমাত্র পরিস্থিতির চাহিদা, সময়ের প্রয়োজন মেটাতে কত ধনঞ্জয়কে ফাঁসির দড়িতে ঝুলে যেতে হয়, যেকোনো বিষয়কে দুইদিক থেকেই না ভেবে, একচোখা পক্ষপাতিত্ব করে কত কলরবকে মাঝরাস্তায় স্তব্ধ করে দেয়া হয়। জাস্টিস, ন্যায়বিচার... শব্দগুলো মাঝেমধ্যে তাসের ঘরের মতই ঠুনকো হয়ে যায়। একটা রায়ের সাথে যখন পলিটিক্স, মিডিয়া ফুটেজ, টিআরপি, পাবলিক রিএ্যাকশন যোগ হয়ে যায়, তখন সত্যটাও কেমন মিথ্যে হয়ে যায়। ধনঞ্জয়দের জায়গাও তখন নো ম্যান'স ল্যান্ডে পাকাপাকি হয়ে যায়।
কেউ একজন বলেছিলেন (নাম ভুলে গেছি), যে গল্প আপনাকে কাঁদায়, সে গল্প আসলে কষ্টের না, বরং যে গল্প আপনাকে কাঁদতে দেয় না, ভেতরটা বোধশক্তিহীন করে দেয়, শূন্য করে দেয়, সেটাই খাঁটি কষ্টের গল্প। এ সিনেমা কাঁদায়নি, ভেতরটা খালি করে দিয়েছে কিছুটা।
শেষ করছি এই সিনেমারই এক সংলাপ দিয়ে- ছাই ঘেঁটে দেখে নিও, পাপ আছে কী না।
"জীবন" বেহিসাবি খরচে ঝরে যাওয়ার পরে, দিনশেষে এছাড়া আর কীই বা বলার থাকে!