তথ্য
Movie: Trapped
Director: Vikramaditya Motwane
Genre: Drama, Thriller
Cast: Rajkumar Rao, Geetanjali Thapa, Yogendra Vikram Singh...
Release: March 16,2017
IMDB: 7.7/10
বলিউড মাঝেমধ্যে অবাক করার মত দুয়েকটা সিনেমা বানিয়ে ফেলে। এবং এ সিনেমাগুলো অবশ্যই মেইনস্ট্রীম মিডিয়ায় খুব বেশি কাভারেজ পায়না, বক্স অফিসে ব্যবসাও করতে পারেনা। অধিকাংশ মানুষ এ সিনেমাগুলো সম্পর্কে জানেও না। প্রচারের যুগে প্রচারটাই বড় কথা... এ নির্মেদ সত্য প্রকট হয়ে দেখা দেয়। আমরা সালমান খানের “টিউবলাইট” মুক্তি পেয়েছে, জানি। কিন্তু, গত মার্চেই যে রাজকুমার রাও অভিনীত এক অসাধারণ সিনেমা “ট্রাপড(Trapped)” মুক্তি পেয়েছে, কয়জন জানি? দেখেছি কয়জন? আজকের কথাবার্তা "ট্রাপড" নিয়েই।
কাহিনী সংক্ষেপ
শৌর্য (রাজকুমার রাও), এক ছোটখাটো ট্রাভেল এজেন্সিতে চাকরি করে। কর্মক্ষেত্রেরই এক সহকর্মী নুরি (গীতাঞ্জলী)র সাথে শৌর্যের ভালোবাসার সম্পর্ক। নুরির বিয়ে দুইমাস পরে, শৌর্যের সাথে না, অন্য এক ছেলের সাথে। এরকম অবস্থায় দুজনে মিলে সিদ্ধান্ত নেয় পালিয়ে বিয়ে করবে। কিন্তু, পালিয়ে গিয়ে উঠবে কোথায়? থাকার তো একটা জায়গা চাই। শৌর্য থাকে মেসে। পালিয়ে বিয়ে করে সেখানে স্ত্রীকে নিয়ে ওঠা সম্ভব না। অগত্যা, মুম্বাই শহরে হন্যে হয়ে সে ফ্ল্যাট খুঁজতে থাকে। কিন্তু, সমস্যা হলো, তার বাজেট মাত্র ১৫০০০ টাকা এবং ফ্ল্যাট পেতে হবে একদিনের মধ্যে। মুম্বাই শহরে ভালো ফ্ল্যাট একদিনের নোটিশে পাওয়া আর পনেরো হাজার টাকার মধ্যে পাওয়ার চেয়ে বাঘের দুধ পাওয়াও সহজ...এ নির্দোষ সত্য জানার পরেও শৌর্য আশাহত হয়না সন্ধান চালিয়ে যায়।
এবং একটি ফ্ল্যাট পেয়েও যায়, পুরোপুরি অজ্ঞাত এক ছেলের (বাসার দালাল) কাছ থেকে, ফ্ল্যাটটা সুন্দরও। এলসিডি টিভি, এয়ার কন্ডিশনার, ফ্রীজ আগে থেকেই দেয়া আছে। দুই রুম, দুই বাথরুম, কিচেন, বিশাল ব্যালকনি। মানে, পনেরো হাজার টাকায় যেন ত্রিশ হাজার টাকার বাসা। এক দেখাতেই বাসা পছন্দ হয়ে যায় শৌর্যের। দেরী না করে বাসার দখল নিয়ে নেয়। নুরি আগামীকাল বাড়ি থেকে পালালে বিয়ে করে এখানে এনেই ওঠাবে তাকে, এমনই পরিকল্পনা শৌর্যের।
রাতেই মেসের পাট চুকিয়ে নতুন ফ্ল্যাটে চলে আসে শৌর্য। ঝেড়েটেড়ে কিছুটা গুছিয়ে রাখে বাসা। রাত পার হয়, সকাল হয়। নুরিকে আনতে বাইরে যাবে শৌর্য, কিন্তু বাইরে আর যাওয়া হয় না। দরজা বাইরে থেকে লক হয়ে গেছে। লক হয়েছে অবশ্য নিজের দোষেই। চাবিও বাইরে রয়ে গেছে। পুরো বিল্ডিং এ শৌর্য ছাড়া আর কেউ নেই। সে আটকে গেছে অজ্ঞাত এক বিল্ডিং এর ৩৫ তলায়। যে বিল্ডিং এ সে ছাড়া আর কোনো জনমনিষ্যিও নেই।
ভাবছেন, এ আর এমন কী কথা? এরকম তো হতেই পারে। মোবাইলে কাউকে কল দিয়ে সাহায্য করতে আসতে বললেই তো হত? এত কাহিনীর কী দরকার ছিলো? আমিও ঠিক এমনটাই ভেবেছিলাম। কিন্তু, এ দিকে কাহিনী তখন আরেকটু জটিল হয়ে গেছে। আগের রাতে "ব্যাটারি লো” থাকা অবস্থায় মোবাইল চার্জে দিয়েছিলো শৌর্য। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে সারারাতে একটুও চার্জ হয়নি। সকালে উঠে সে দেখে রুমে বিদ্যুৎ নেই, কোনো কলে একফোঁটা পানি নেই। মোবাইলের চার্জও তলানিতে এসে ঠেকেছে। বাইরে থেকে দরজা আটকানো। নানামুখী বিপদের ত্রিশঙ্কু অবস্থায় নাজেহাল শৌর্য সেই দালালকে ফোন দিয়ে সাহায্য পাঠাবার কথা বলার সাথে সাথেই মোবাইলের চার্জ পুরোপুরি চলে যায়। গোটা দুনিয়া থেকে একরকম বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় শৌর্য। সিনেমার কাহিনী এখান থেকেই শুরু. ..
৩৫ তলার তালাবদ্ধ বিল্ডিং এ খাবার, পানি, বিদ্যুৎ ছাড়া বেঁচে থাকা, সেখান থেকে কীভাবে বের হওয়া যায়, তার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করা... সিনেমা এভাবেই এগোয়। এক ঘন্টা একচল্লিশ মিনিটের সিনেমায় বিরক্ত হওয়ার সুযোগ এক সেকেন্ডের জন্যেও নেই।
শৌর্য কী পারবে এখান থেকে অক্ষত অবস্থায় বেরোতে? নুরির সাথে কী শেষমেশ বিয়েটা কী হবে শৌর্যের...? এই অসরল সমীকরণগুলোর সমাধান হবে ক্রমশ, সিনেমার পরিণতির সাথে সাথে।
কাহিনী সংক্ষেপ কে তাই আর দীর্ঘায়িত না করাই বোধহয় ভালো। বাকিটা পর্দায় দেখে নেবেন।
অভিনয়
এ সিনেমা এককভাবেই রাজকুমার রাও এর। বাকিরা খুব কম সময়ের জন্যেই স্ক্রিন শেয়ার করেছেন। তাই এটা রাজকুমার রাওয়ের “ওয়ান ম্যান শো” বলাই ভালো। বলিউডের এ এক প্রতিভাবান অভিনেতা, বানিজ্যিক ঘরানার বাইরের এ জাতীয় সিনেমাগুলোতেই তাকে বেশি দেখা যায়। দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন এখানেও। আপনি, আমি এরকম অবস্থায় থাকলে যা করতাম, পরিচালক হুবহু সেরকম ভেবেছেন এবং রাজকুমার রাও একেবারে সেটাই পর্দায় তুলে এনেছেন। অনেকটা মনে হবে যেন, পরিচালক আমাদের মনের ভেতরে কী চলছে তা আগে থেকে ভেবে নিয়েই সিনেমাটা বানিয়েছেন। কোনো সিনেম্যাটিক মোমেন্ট নেই, নেই নীল সোফাসেটে মিঠে খুনসুটি... যা প্রাসঙ্গিক, শুধুমাত্র এবং শুধুমাত্র সেটাই উঠে এসেছে পর্দায়।
এ সিনেমার এক দৃশ্যে রক্ত দিয়ে ফ্রিজের বাক্সে “হেল্প মেসেজ” লিখে নীচে ফেলে দেয়ার দৃশ্য আছে। এ দৃশ্যটাকে বাস্তবসম্মত করার জন্যে রাজকুমার রাওয়ের রক্তই ব্যবহার করা হয়েছে সিনেমায়, লাল রঙ এর রক্ত বা টমেটো কেচআপ দিয়ে রক্ত বানানো হয়নি। বডি ট্রান্সফর্মেশনের জন্যে টানা বিশ দিন শ্যুটিং এ শুধু গাজর আর কফি খেয়ে ছিলেন রাজকুমার রাও। ডেডিকেশন লেভেলের পর্যায়টা এ থেকেই বুঝে যাওয়ার কথা সবার।
বাকিদের অভিনয় নিয়ে খুব বেশি কিছু লেখা যাচ্ছেনা, স্ক্রিনে খুব অল্প সময়ই ছিলেন তারা। তবে, এরমধ্যে “নুরি” চরিত্রে অভিনয় করা গীতাঞ্জলির অভিনয় ভালো ছিলো।
দৃশ্যায়ন
সিনেমার প্রায় গোটা শ্যুটিং হয়েছে ৩৫ তলার ওপরের এক ফ্ল্যাটে। তবে, প্রশস্ত ব্যালকনি থেকে মুম্বাই শহরের দৃশ্য ভালো লেগেছে।
সিনেমার শৌর্য নিরামিষাশী। কিন্তু, বেঁচে থাকার তাগিদে যখন সে বাসার ব্যালকনিতে বসে থাকা কবুতরকে মেরে ফেলার পরেও খাবে কী খাবে না...এরকম আত্মদ্বন্দ্বে ভোগে, এ বিষয়টি ভালো লেগেছে। কোনো একটি জিনিস না খাওয়ার অভ্যাস আর বেঁচে থাকার সংগ্রামে সেই জিনিসটিরই একটুকরো রসদ হয়ে মুখোমুখি দাঁড়ানোর যে গভীর লড়াই আছে, যে মনস্তাত্ত্বিক দ্বৈরথ আছে, ব্যতিব্যস্ত শৌর্যের অভিব্যক্তিতে তা যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক লেগেছে।
সিনেমার শৌর্য ইঁদুর দেখতে পারতোনা। কিন্তু, নিঃসঙ্গ অবস্থায় ফ্ল্যাটের মধ্যে আটকে থাকা এক ইঁদুরের সাথেই সম্পর্ক পাতিয়ে ফেলে সে। তাকে কৌতুক শোনায়, গল্প বলে সে। এ দৃশ্যের মধ্যেও একধরণের মানবিক টান আছে। এরকম দৃশ্য দেখা গিয়েছিলো “কাস্ট এ্যাওয়ে” সিনেমায়, টম হ্যাঙ্কস যেখানে মিঃ উইলসন নামক ভলিবলের সাথে গল্প করে সময় পার করতো বিচ্ছিন্ন এক দ্বীপে।
পানিবিহীন অবস্থায় অনেকদিন থাকার পরে যখন বৃষ্টি নামলো, তখন শৌর্যের চোখের আদিম উল্লাস, পানি সংগ্রহ করার ক্লান্তিহীন প্রচেষ্টা চোখে লেগে থাকবে।
এরকম টুকরো টুকরো আরো অসংখ্য দৃশ্য আছে এ সিনেমায়।
ভালো লাগা
পুরো সিনেমাই ভালো লেগেছে। অযথা কোনো গানের অত্যাচার নেই, আবেগী কোনো জিনিসপত্র নেই, পুরোটাজুড়েই এক মানুষের বেঁচে থাকার লড়াই। অদ্ভুত পরিস্থিতিতে বেঁচে থাকার আয়োজন নিয়েই গোটা সিনেমার গাঁথুনি।
সিনেমাজুড়ে টুকরো টুকরো কিছু আয়রনি ছিলো, সেগুলোও ভালো লেগেছে। যেমনঃ শৌর্য যে ফ্ল্যাটে উঠেছিলো, তার নাম ছিলো স্বর্গ, অথচ সেখানে তার জীবন নরকের মতই অসহ্য ছিলো। নতুন বাসার দেয়ালে কয়েকটা বেলুন ছিলো। অবরুদ্ধ হওয়ার দ্বিতীয় দিন শৌর্যের ঘুম ভাঙ্গে দেয়ালের বেলুন ফাটা শব্দে। এখানেও রূপক অর্থে, আশার বেলুনগুলো যে চুপসে যাচ্ছে, তা বোঝানো হয়েছে। শৌর্যের নামটাও তো বিরাট এক আয়রনি। তার নামের অর্থ সাহস, অথচ বাস্তব জীবনে প্রচন্ড ভীতু এক মানুষ সে। যে সামান্য এক ইঁদুরকেও সহ্য করতে পারেনা। এরকম ছোট ছোট আয়রনিতে ভর্তি এ সিনেমা।
সিনেমার ট্যাগলাইন ভালো লেগেছেঃ Freedom Lies Beyond Fear". এটাই এক বাক্যে সিনেমার সারাংশ, জীবনেরও।
খারাপ লাগা
সিনেমার এক দৃশ্যে দেখা যায়, পানির অভাবে শৌর্য নিজের প্রস্রাব পান করছে। এই টিপিক্যাল দৃশ্যটা প্রায় সব পানিবিহীন অবস্থায় থাকা মানুষের দুর্দশা দেখাতেই ব্যবহার করা হয়। অনেক সিনেমাতেই দেখেছি। বিখ্যাত সারভাইভাল এক্সপার্ট বেয়ার গ্রিলস "ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড" অনুষ্ঠানে বিভিন্ন মরুভূমিতে নিজের "মূত্রপান" করে করে বিষয়টিকে জনপ্রিয়ই করে ফেলেছেন। এই দৃশ্যটি গতানুগতিক লেগেছে, অনেকের কাছে হয়তো লাগবেনা। কারণ, কবি বলেছেন, নানা মুনির নানা মত।
শৌর্য যখন নতুন বিল্ডিং এ আসে, তার সাথে কী দারোয়ানের দেখা হয়নি? দারোয়ান জানে না যে, সে এ বাসায় এসে উঠেছে। কেন জানেনা? শৌর্য নিজে না জানালেও তো ঐ দালালের দারোয়ানকে জানানোর কথা। সে কেন জানায়নি? এ রহস্য উন্মোচিত হয়নি।
শৌর্যের সাথে নুরির সম্পর্কের ব্যাপ্তি অতটা গভীরভাবে দেখানো হয়নি, আরো কয়েক মিনিট সময় তাদের দেয়া যেতে পারতো।
ব্যক্তিগত মতামত
রুশো বলেছিলেন, “Man is born free, but everywhere he is in chain.” যথার্থ বলেছিলেন।
এ সিনেমাকে খুব গভীর এক রূপক হিসেবেও দেখা যেতে পারে। সম্প্রতি দেখেছি, শন পেনের পরিচালিত সিনেমা “Into The Wild.” সে সিনেমার ক্রিস অথবা মালয়লাম “চার্লি” সিনেমার চার্লির মত পরিবারের, সম্পর্কের, সংসারের শেকল ছিঁড়ে কয়জনই বা বেরোতে পারে দিনশেষে? আমরা তো একেকজন শৌর্যই, যারা কী না ঘরের কোনে বন্দী থেকেই একজীবন কাটিয়ে দিই। আমাদের সাথে শৌর্যের একটাই পার্থক্য, শৌর্য জানতো, বাইরে যাওয়ার দরজাটা বন্ধ, তাই সে খোলার চেষ্টা করেছিলো। আমরা জানি, বাইরে যাওয়ার দরজাটা বন্ধ না, আমরা চাইলেই খুলে ফেলতে পারবো, তাই আর আমরা খোলার চেষ্টা করি না। আমরা বন্দী হয়ে থাকি হাতের মুঠোফোনে, সর্পিল অন্তর্জালে অথবা পরিবারের শেকলে। আমরাও তো ট্রাপড।
আবার, সিনেমাটিকেও এভাবেও বিবেচনা করা যেতে পারে, আমাদের সুবিধের জন্যেই তো কতকিছু তৈরী হয়েছে, অথচ সেই জিনিসগুলোই কিন্তু সময়ের ফেরে মারাত্মক জীবনগ্রাসী হয়ে উঠতে পারে, একটু হিসেবের ভুলে গরমিল হয়ে যেতে পারে গোটাটাই। একটুখানি ফাঁদে জীবনটাই বরবাদ হয়ে যেতে পারে।
“ট্রাপড” হয়তো সেরকমই এক হিসেবের ভুলে আটকে পড়া এক মানুষের গল্প। “ট্রাপড” এমন এক শৌর্যের গল্প, যার চরিত্রের মধ্যে দিনশেষে আমরা আমাদেরকেই খুঁজে পাই।
সূক্ষ্ম বিশ্লেষণে “ট্রাপড” হয়তো আমাদের নিজেদেরই যাপিত জীবনের গল্প।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা জুলাই, ২০১৭ রাত ৯:২২